আল আমিন হোসেন মৃধা

০৪ এপ্রিল, ২০১৭ ১৬:২৪

রাজধানীর সাত সরকারি কলেজ ঢাবির অন্তর্ভুক্ত, না অধিভুক্ত?

পুরনো গল্প এক ভিক্ষুক রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তির কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে, ব্যক্তি ভিক্ষুকরে জিজ্ঞেস করছে- এই যে, তুমি যে ভিক্ষা চাইছো, কিভাবে বুঝবো যে তুমি কানা?
ভিক্ষুক- এই যে দূরে একটা গরু দেখতাছেন, ওইটা আমি দেখতাছি না।

আমাদের হয়েছে ঠিক তাই তিনটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি, রাবি, চবি) অধীনে ছিল দেশের  সরকারি কলেজগুলো। দীর্ঘ সেশনজটের কারণে ও উচ্চ শিক্ষার মান ধরে রাখতে না পারার কারণে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি ও বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানের কলেজগুলো পরিচালনার ভার দেওয়া হয়।

আবার, উচ্চশিক্ষার গুনগত  মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও সেশনজট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় ( প্রাথমিক ভাবে সাতটি পর্যায়ক্রমিক সব সরকারি কলেজ) সাতটি সরকারি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হলো।

কেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হল; এর ওয়েবসাইটে কারণ হিসেবে লেখা আছে (অ্যাক্ট), ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অধিভুক্ত কলেজের তদারকি করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বাড়তি চাপে ছিল। সেই চাপ কমাতে ও অধিভুক্ত কলেজগুলোর মান উন্নয়নে ১৯৯২ সালে সংসদে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২ নামের আইন পাসের মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে সমস্যায় জর্জরিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধিভুক্ত ২৮১টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ে পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করার নির্দেশনা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক ভাবে রাজধানীর সাত সরকারি কলেজ ঢাবির অধিভুক্ত করা হলো। কলেজগুলো হচ্ছে, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। এই কলেজ গুলোর মোট শিক্ষার্থী ১ লক্ষ ৬৭ হাজার ২৩৪ জন। মোট শিক্ষক ১ হাজার ১৪৯ জন।

কি সমস্যা ও সংকটে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভাঙ্গতে হলো:
১। সেশনজট (৪ বছরের স্নাতক শেষ করতে ছয় বছর ও এক বছরের মাস্টার্স দুই থেকে আড়াই বছর)
২। উচ্চ শিক্ষায় গুনগত মান দিতে ব্যর্থ হওয়া
৩। পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান সমস্যা হিসেবে এগুলো দেখিয়েছে)
৪। কলেজগুলোর ক্লাসরুম সংকট
৫। শিক্ষক সংকট (অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক নিয়োগ দেয় পিএসসি ফলে শিক্ষক সংকট এখানে চিরন্তন ও বিশ্ববিদ্যালয় ধারনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী)।
৬। লাইব্রেরী সেমিনারে বই সংকট যা আছে প্রাচীন আমলের)।
৭। আবাসন সংকট।
৮। পরিবহন সংকট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত হলে কি এ সমস্যার সমাধান হবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ ছিল ১০৪টি। নতুন সাতটি যোগ হওয়ায় এ সংখ্যা এখন ১১১টি। এই সাতটি কলেজ যুক্ত হওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ১০৪টি কলেজ ও ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার ৬৯৮ জন, শিক্ষক সাত হাজার ৫৯১ জন। ফলে নিজস্ব ৩১ হাজার ৯৫৫ জন শিক্ষার্থীর বাইরে আরও দুই লাখ আট হাজার শিক্ষার্থীর দেখভালের দায়িত্ব এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁধে। এই সাতটি কলেজগুলোকে ঢাবি শুধু প্রশাসনিক সুবিধা দেবে। অর্থাৎ ভর্তি পরীক্ষা, কলেজে সকল পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন সহ অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রম।  ক্লাস, পরীক্ষা, লাইব্রেরীও সেমিনার সুবিধা, আবাসন ও ট্রান্সপোর্ট সুবিধা স্ব কলেজ থেকেই পেতে হবে। অর্থাৎ মূল সংকট গুলো থেকেই গেলো। যে উচ্চশিক্ষার গুনগত  মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও সেশনজট নিরসনের কথা বলে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেড় করে সরকারি  কলেজ গুলোকে নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলো সেই একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবার এই আগের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে গিয়ে যে আদৌ উচ্চ শিক্ষার মান বৃদ্ধি সহ অন্যান্য সংকট সমাধান হবে কিনা তা বিচার্য।

অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা  কি ঢাবির নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মত একই সার্টিফিকেট পাবে? নিজেকে ঢাবিয়ান বলতে পারবে কি?

এ বিষয় নিয়ে এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ জল্পনা কল্পনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্র কয়েকটি  জাতীয় পত্রিকাগুলোকে  জানিয়েছে, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বর্তমানে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে আছে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল, টেক্সটাইল এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ। ১০৪টি কলেজের মতোই চলবে সম্প্রতি যুক্ত হওয়া অধিভুক্ত সাত কলেজ। অধিভুক্ত অন্যান্য কলেজের মতো নতুন সংযোজিত সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীরা পাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট। তবে সার্টিফিকেটে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে অধিভুক্ত স্ব-স্ব কলেজের ও বিভাগের নাম। সাধারণত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটে হল ও বিভাগের নাম উল্লেখ থাকে।" অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই নিজেদের ঢাবির শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেয়ার সুযোগ নেই।

কলেজগুলো কি ঢাবির অধিভুক্ত না অন্তর্ভুক্ত?
কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা থেকে জানা যায়, এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সাতটি কলেজ ঢাবির অধিভুক্ত অন্যান্য কলেজের মতো শুধু প্রশাসনিক সুবিধা পাবে। ওইসব কলেজে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সহযোগিতা করবে। এটি কোনোভাবেই ঢাবির অন্তর্ভুক্ত নয়।

প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন কিছুর পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিয়ে আলোচনা-সেমিনার করতে হয় সে ক্ষেত্রে অতীত শিক্ষা কি বা ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা বিস্তারিত জানা যেতো। আর আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার গুনগত  মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও সেশনজট নিরসনের কথা বলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া এই সরকারি কলেজ গুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেড় করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই একই কথা বলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙ্গে আগের অবস্থানে ফিরছে।  শিক্ষার প্রকৃত সমস্যার সমাধান না করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরা আমাদের এই লক্ষাধিক শিক্ষার্থীদের জীবনকে বিপন্ন করবেন না।

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত