আল আমিন হোসেন মৃধা

০৪ এপ্রিল, ২০১৭ ২৩:০২

শিশুদের অধিকার ও আমাদের রাকিব-রাজনরা

অধিকার হলো সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত প্রত্যেক নাগরিকের সমান সুযোগ-সুবিধা, যা ভোগের মাধ্যমে নাগরিকের পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। আর শিশু অধিকার হলো সুস্থ-সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার সুবিধা, তার দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খাদ্য-পুষ্টি, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ, শিক্ষা-বিনোদন, সামাজিক নিরাপত্তার ও সুরক্ষার অধিকার, মানবিক আচরণ ও শোষণ-বঞ্চনা থেকে রক্ষা পাওয়া।

জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে শিশুর অধিকার সম্পর্কে বলা আছে ( জাতিসংঘের শিশু সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন)- 'শিশুর বেঁচে থাকা তাদের জন্মগত অধিকার। এরই সাথে শিশুর জন্য নিচের অধিকারগুলির কথাও মনে রাখতে হবে আমাদের।

ক) স্নেহ, ভালবাসা ও সমবেদনা পাওয়ার অধিকার, খ) পুষ্টিকর খাদ্য ও চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার অধিকার, গ) অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ, ঘ) খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ঙ) একটি নাম ও নাগরিকত্ব, চ) পঙ্গু শিশুদের বিশেষ যত্ন ও সেবা শুশ্রূষা পাওয়ার অধিকার, ছ) দুর্যোগের সময় সবার আগে ত্রাণ ব্যবস্থা পাওয়ার অধিকার, জ) সমাজের কাজে লাগার উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠার এবং ব্যক্তি সামর্থ অর্থাৎ সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ঝ) শান্তি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ঞ) এ সব অধিকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে বিশ্বের সব শিশুর ভোগের অধিকার থাকবে।'

বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার রক্ষা ও তাদের বিকাশের জন্য রয়েছে নানা আইন। কিন্তু তারপরেও কেন বাংলাদেশে লঙ্ঘিত হচ্ছে শিশু অধিকার? কেন সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে শিশু-কিশোরদের যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার কথা তা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? কেন শিশুনীতিকে পাশ কাটিয়ে শিশুদের ভারী গৃহশ্রমসহ বেআইনি কাজে যুক্ত করা হচ্ছে? দেশে ১৪ বছরের কম বয়সীদের গৃহশ্রমে নিযুক্ত না করার হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পরও তা কেন কার্যকর হচ্ছে না?

বাংলাদেশে গৃহকর্মে নিয়োজিতদের সিংহভাগই কিশোর-কিশোরী ও শিশু। দেশের প্রচলিত আইনে শিল্প কারখানায় শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও জীবিকার প্রয়োজনে শৈশব অবস্থায় অনেক শিশুকে নানা ধরণের শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হচ্ছে।

একটি রাষ্ট্র যখন শিশুর জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, তখন আইন শুধু মাত্র বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়, তাদের ঘরে সন্তান এলে সে শিশুটি হয় অবহেলিত, নিগৃহীত ও বঞ্চিত। পরিবারের মধ্যেই সে শিশু পরগাছার মত বেড়ে ওঠে। দারিদ্রের কারণেই শিশুরা একটি কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ায়। অতি অল্প বয়সে ভারী শ্রমের পথ বেছে নিয়ে মেনে নেয় সম্ভাব্য পঙ্গুত্বকে। নানা প্রতিবন্ধকতার সাথে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠে অধিকার বঞ্চিত শিশুরা।

মনে আছে সিলেটের ১৩ বছরের শিশু সামিউল আলম রাজনের কথা, যাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল? মনে পড়ে খুলনার শিশু রাকিব ও নারায়ণগঞ্জের শিশু সাগর বর্মণকে পায়ুপথে বাতাস ঠুকিয়ে হত্যার কথা? হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের চার শিশুর বুকের পাঁজর ভেঙে ও শ্বাসরোধে হত্যাড় কথা? বরগুনার শিশু রবিউল ইসলাম আউয়ালকে কথিত মাছ চুরির অপরাধে শাঁবল দিয়ে পিটিয়ে ও খুঁচিয়ে হত্যা করে জলার মধ্যে ভাসিয়ে দেয়ার (শুধু তাই নয়, তার একটি চোখও তুলে নেয়) কথা? নিশ্চয় আমরা ভুলে গেছি। ভুলে যাবারই কথা!

আজ পুনরায় রায় হয়েছে রাকিব হত্যার। মৃত্যুদন্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে আসামিদের। কারণ শিশু রাকিবকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়নি; বরং এটি ছিল দুষ্টুমির ছলে একটি দুর্ঘটনা। আর এ বিষয়ে চাক্ষুস কোনো সাক্ষীও নেই, তাই এই রায়।

সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যার মামলার প্রধান আসামি কামরুল ইসলামসহ চার জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন (১১ জুলাই ২০১৬) আদালত। এখনও সেই রায় কার্যকর হয় নি। হবিগঞ্জের চার শিশু হত্যা মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন বাচ্চু মিয়া কথিত র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। এ বিচার শেষ হবার নয়।

এ বিশ্ব আজ শিশুদের জন্য নিরাপদ নয়। বিশ্বব্যাপী আজ শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে যুদ্ধে, শ্রমে, উটের দৌঁড়ে ও বিভিন্ন অবৈধ কাজে। শিশুরা আজ পৃথিবীতে বড় অসহায়। প্রতিদিন এই সুন্দর পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ শিশু বিভিন্ন রোগে মারা যায়, কোটি কোটি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, কোটি কোটি শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, কোটি কোটি শিশু জীবন যাপন করে রাজপথে। বিশ্বব্যাপী শিশুদের পুষ্টিহীনতা, অশিক্ষা ও নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে অর্থের অভাব। অথচ প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপী ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে তথাকথিত প্রতিরক্ষা খাতে।

কবি নজরুল লিখেছিলেন-
'তুমি নও শিশু দুর্বল, তুমি মহৎ ও মহীয়ান
জাগো দুর্বার, বিপুল বিরাট অমৃতের সন্তান।'

তিনি এ সময়ে বেঁচে থাকলে হয়তো লিখতেন। কারণ আমাদের শিশুরা ভালো নেই, আমাদের শিশুরা আজ নিরপদে নেই।

আজকের শিশুরাই জাতির সোনালী ভবিষ্যতের স্থপতি। সুন্দর ও কল্যাণকর জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন এমন সুন্দর পরিবেশ, যেখানে জাতির এই ভবিষ্যত স্থপতিগণ সুস্থ, স্বাভাবিক, স্বাধীন, মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও সামাজিকভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারবে। শিশুদের জন্য এরূপ একটি পরিবেশ গঠন করতে হবে। দুর্নীতি, লুটপাটতন্ত্র বন্ধ করে ও সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে শিশুদের পূর্ণ বিকাশে সম্পূর্ণ ব্যয়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। নাহলে ৪৬ বছরেও সোজা না হওয়া মেরুদন্ডহীন এ জাতীর মেরুদন্ড কোন দিনই সোজা হবে না।

 

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত