আল আমিন হোসেন মৃধা

২১ এপ্রিল, ২০১৭ ২৩:৫৩

কল্পনা থেকে রমেল চাকমা, এটাই কি বাংলাদেশ?

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন। পাহাড় পর্বতে ঘেরা অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির এই অঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা ভিড় করে নিয়মিত। কিন্তু কেউ খবর রাখে না এই অঞ্চলের উপজাতিদের খবর রাখে না সেনাবাহিনী-বাঙালি সেটলার কর্তৃক নিপীড়িত নির্যাতিত আদিবাসীদের করুণ ইতিহাসের।

সেনাবাহিনী কর্তৃক এই আদিবাসীদের হত্যা, ধর্ষণ, গ্রেপ্তার, হয়রানি, সেনা হেফাজতে শারীরিক অত্যাচার, সামরিক কর্মকর্তা ও সেটলারদের ভূমি দখলের খবর যেমন কেউ রাখে না তেমনি তাদের এই অত্যাচার নিপীড়নের খবরের কথা কখনোই আসে না মিডিয়ায়। মিডিয়ার ‘ব্ল্যাক আউট’ এবং ‘সেন্সরশিপ’-এর অন্ধকারে পাহাড়ের খবর কখনোই আলোর দেখা পায়নি।

রাঙামাটি জেলার নান্যাচর উপজেলার পূর্ব হাতিমারা গ্রামের কান্তি চাকমার ছেলে, ডানচোখে দেখতে না পাওয়া আংশিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রমেল চাকমা ছিল এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। গ্রামের বাড়ি থেকে পরীক্ষা কেন্দ্র দূরে হওয়ায় বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন নান্যাচর উপজেলা পরিষদ এলাকায়। ২ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষায়ও অংশ নিয়েছিলেন।

৫ এপ্রিল পরীক্ষা না থাকায় রমেল চাকমা তরিতরকারি ও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে নান্যাচর বাজারে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে উপজেলা পরিষদ এলাকা থেকে আনুমানিক সকাল ১০টার সময় সেনাবাহিনীর নান্যাচর জোনের একদল সেনা সদস্য তাকে আটক করে টেনেহিঁচড়ে জোনে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর দিনভর তার উপর অমানুষিকভাবে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। দিনভর এই অমানুষিক নির্যাতনের ফলে রমেল চাকমা গুরুতর অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে পড়লে সেনা সদস্যরা সন্ধ্যায় তাকে থানায় হস্তান্তরের চেষ্টা করে। কিন্তু থানার কর্তৃপক্ষ তার শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর সেনারা তাকে স্থানীয় উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে সেখানে ভর্তি না করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণের পরামর্শ দেয়।

সেনারা সেদিনই তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে সেনা নজরদারি ও পুলিশি পাহারায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৯ এপ্রিল মারা যান পিসিপির এই নেতা।

এদিকে সেনাবাহিনীর অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ট্রাকে আগুন দেওয়ার অভিযোগে রমেল চাকমাকে গ্রেপ্তার করা হয় । পরে রমেল চাকমা বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশের প্রহরায় মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রমেলের মৃত্যুর বিষয়ে একটি অনলাইন পত্রিকার জিজ্ঞাসায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, একটি ট্রাক পোড়ানো ও দুটি বাস লুটের মামলার ওই আসামিকে গত ৫ এপ্রিল আটক করা হয়েছিল। সেদিনই তাকে নানিয়ারচর থানা পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়।

“পুলিশের হেফাজতেই সে চিকিৎসাধীন ছিল। সেনাবাহিনীর নির্যাতনে মৃত্যুর বিষয়টি ঠিক নয়, এটি ভিত্তিহীন অভিযোগ,” বলেন এই সেনা কর্মকর্তা।

রমেল চাকমার মৃতদেহ পরিবারকে দিয়ে আবার পুনরায় পরিবার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আজ এই সেনাবাহিনী পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। সুযোগ দেয়নি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার।

১৯৯৬ সালের ১১ জুন রাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির গভীর রাতে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের হিল উইমেনস ফেডারেশনের অর্গানাইজিং সেক্রেটারি ছিলেন কল্পনা চাকমাকে। অভিযোগ, সেনাসদস্যরা অপহরণ করেছিল তাকে। আজ অবধি মেলেনি তার খোঁজ, হয়নি বিচার।

কল্পনা চাকমা, রমেল চাকমাদের অপরাধ পাহাড়িদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার ছিল।

সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও ৩১ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের কথা থাকলেও পাহাড়িদের ভাগ্যে মেলেনি এই অধিকারের সুযোগ।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপর বিচার বহির্ভূত এই অত্যাচার খুন ধর্ষণ শুরু ১৯৭৯ সাল থেকেই।

১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকার কাউন্টার ইনসার্জেন্সির পদক্ষেপ হিসাবে বাঙালি পুনর্বাসন শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় ৪ লাখ বাঙালি পাহাড়ে পুনর্বাসন করেছিলেন, যাঁদের ‘সেটলার’ বলা হয়৷ শান্তি বাহিনীর গেরিলা আক্রমণ ঠেকাতে সেটলারদের ‘মানবঢাল’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে শান্তিবাহিনীর যুদ্ধকে জাতিগত সংঘাতে রূপ দেওয়া হয়েছিল সেটলারদের মাধ্যমে৷ দু’টি জনগোষ্ঠীকে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ভিডিপি ও আনসার বাহিনীতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সেটলারদেরকে।

পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসার কথা ছিল৷ কিন্তু চুক্তির পর জেএসএস (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি) গেরিলা যুদ্ধ থেকে নিরস্ত হলেও, থামেনি সরকারি বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক এ অত্যাচার।

সেনাবাহিনী রাষ্ট্রচরিত্রকেই ধারণ করে৷ ২০ বছর আগে পার্বত্যচুক্তির মাধ্যমে আদিবাসী জুম্মরা গেরিলা যুদ্ধ থামিয়েছে বটে, কিন্তু আদতে সেখানে আজও যুদ্ধ থামেনি।

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত