ফরিদ আহমেদ

২৩ এপ্রিল, ২০১৭ ১১:৩৭

পথের পাঁচালি, ঘরে বাইরে এবং সত্যজিৎ রায়

‘পথের পাঁচালি’ নয়, সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি হতে পারতো ‘ঘরে-বাইরে’। সেটা হয়নি। না হয়ে কী হয়েছে বা হয়নি, সেটা নিয়ে আজকে এতো সময় পরে এসে মতামত দেওয়াটা একটু দুরূহ। আমার নিজস্ব ধারণা না হয়ে ভালোই হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের নিজেরও ধারণা ছিলো সেটা হলে তাঁর ভবিষ্যৎ হয়তো ভিন্ন ধরনের হতো।

১৯৪৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের বয়স যখন মাত্র পঁচিশ বছর বয়স, তখনই ফিল্মের পোকা মাথায় ঢুকে যায় তাঁর। সেই পোকার তাড়নাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’-র চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন। চিত্রনাট্য লিখলেও এটার পরিচালনার ইচ্ছা তাঁর ছিলো না। পরিচালক হিসাবে কাজ করার কথা ছিলো তাঁর বন্ধু হরিসাধণ দাশগুপ্তের। নানা কারণে সেই কাজটা তখন করা হয়ে ওঠেনি। এর পরিবর্তে আরো প্রায় দশ বছর পরে তৈরি হলো ‘পথের পাঁচালি’। ‘পথের পাঁচালি’ ছবির ধারণা এসেছিলো ইটালিয়ান পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’ দেখার কারণে। অনেকেরই ধারণা ‘ঘরে-বাইরে’ থেকে সরে যাবারও অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ‘বাইসাইকেল থিভস’।

‘বাইসাইকেল থিভস’ ফিল্মি জগতের নিউ রিয়ালিমজম ধারার প্রথম দিকের ছবি। ফিল্মের এই নিউ-রিয়ালিজম ধারার সূত্রপাত হয়েছিলো ইটালিতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরপরই। সামরিকজান্তা ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির হাত থেকে মুক্তি পাবার পরে ইটালির সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রে যে সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনার মুক্তি ঘটে, সেটিই মূলত নিউ-রিয়ালিজম। সামাজিক বাস্তবতা, সামাজিক বিষয়বস্তু, ঐতিহাসিক বাস্তবতা, রাজনৈতিক মতাদর্শগত দৃঢ়তা, বাস্তবতাকে তুলে ধরার প্রচেষ্টাই ছিলো নিউ-রিয়ালিজমের মূল উদ্দেশ্য।

ফরাসি লেখক আন্দ্রে ব্যাজিন নিউ-রিয়ালিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এর সৌন্দর্যের ভিত্তিতে। একে তিনি সত্য এবং পুনর্গঠিত বাস্তবতার সিনেমা হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। এই বাস্তবতা উৎসারিত হয়েছে ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধতা থেকে। এই সময় অসংখ্য নিউ-রিয়ালিস্ট অপরিণত চিন্তাভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পরিণত করেছেন নিজেদের, করেছেন ঋদ্ধ এবং বোদ্ধা। ব্যাজিনের মতে, নিউ-রিয়ালিজম চলচ্চিত্র প্রচলিত এবং নাটকীয়, এই দুই ধরনের চলচ্চিত্র ধারাকেই বাতিল করে দিয়েছিলো। নিউ-রিয়ালিস্ট চলচ্চিত্রকারেরা প্রচলিত স্টুডিও সেটে শুটিং করাকে অব্যাহতি দিয়ে আসল লোকেশনে শুটিং করা শুরু করেন। সেই সাথে চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুর সাথে সংগতি রেখে এর অভিনেতাদের বাস্তবের মতো করেই সাজ-পোশাক পরান এবং বাস্তবের মতো করেই অভিনয় করতে বলেন। এই সব সিনেমার পাত্র-পাত্রীদের আলাদা অভিনেতা-অভিনেত্রী বলে চেনার কোনো সুযোগ থাকে না। এরা সাধারণ মানুষের মতো দেখতে, তাদের মতোই পোশাক-আশাক পরা, তাদের মতোই অ-নাটকীয় চলাফেরা তাদের, কথাবার্তাতেও নেই কোনো কৃত্রিমতা।

নিউরিয়ালিজমের ল্যান্ডমার্ক ফিল্ম হিসাবে ‘ওপেন সিটি’-র কথা বলা যেতে পারে। এর পরিচালক ছিলেন রোজলেনি। এই ছবিটা মুক্তি পায় যুদ্ধ শেষ হবার সাথে সাথেই, ১৯৪৫ সালে। যুদ্ধোত্তর ইটালির পুনর্গঠন তখনও শুরু হয়নি। রোজলেনির ‘ওপেন সিটি’এই সময়কে বুকে ধারণ করে নতুন চলচ্চিত্রযাত্রার শুভ সূচনা ঘোষণা করে। রোজলেনির পথ অনুসরণ করে এগিয়ে আসেন আরো অনেকেই। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন ডি সিকা। তিনি তৈরি করেন ‘বাইসাইকেল থিভস’। অতি সাধারণ মানুষজনকেও পর্দায় উপস্থিত করে যে চলচ্চিত্রের পর্দাকে পরম সৌন্দর্য দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, সেটার চূড়ান্ত রূপ দেখান ডি সিকা এখানে।

ইটালিতে নিউ-রিয়ালিজমের ধারা শুরু হলেও, এটা বলাটা অবশ্য অনুচিত হবে যে, এই ধারা পুরো চলচ্চিত্র জগতকেই প্রভাবিত করেছিলো। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত ইটালিতে মোট ৮২২টা চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিলো। এর মধ্যে নিউ রিয়ালিজম ধারার ছবি ছিলো মাত্র এগারো ভাগ। বাকি ঊননব্বই ভাগ চলচ্চিত্রই পুরোনো সেই প্রচলিত ধারাতেই হেঁটেছে। যে কটা নিউও রিয়ালিস্টিক চলচ্চিত্র হয়েছে, তার নব্বই ভাগই আবার চরমভাবে ব্যবসা অসফল ছবি ছিলো। এদের অনেকগুলোই বাইরের বিশ্বে নাম-ডাক করেছে, পুরস্কার পেয়েছে, কিন্তু দেশে সেভাবে সমাদর লাভ করতে সক্ষম হয়নি।

ডি সিকার এই ‘বাইসাইকেল থিভস’ ছবিটা লন্ডনে থাকা অবস্থায় দেখেন সত্যজিৎ রায়। ছবিটা দেখে এতোই অভিভূত হয়ে যান যে তিনি তাঁর প্রথম ছবি নিউ-রিয়ালিজম ধারায় করার সিদ্ধান্ত নেন। কোথায় যেন পড়েছিলাম তিনি নাকি কমপক্ষে পঞ্চাশবার এই ছবিটা দেখেছিলেন। যাঁরা ‘বাইসাইকেল থিভস’ এবং ‘পথের পাঁচালি’, এ দুটো ছবিই দেখেছেন, তাঁরা জানেন দুটো ছবির মেকিং কতো কাছাকাছি ধরনের। এর দর্শন প্রায় হুবহু এক। ‘বাইসাইকেল থিভস’ যে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন, এর প্রভাব যে তাঁর বানানো ছবিতেও পড়েছে, সেটা সুস্পষ্ট এবং সুবিদিত। নয়া-বাস্তবতার ধারার এই ছবি ‘পথের পাঁচালি’ দিয়েই চলচ্চিত্র বিশ্বকে মাত করে ফেলেন তিনি।

‘পথের পাঁচালি’-র পরে আরো অনেক ছবিই তিনি করেছেন। কিন্তু, সেই প্রথম তারুণ্যের করা ‘ঘরে-বাইরে’-র চিত্রনাট্যকে তিনি ভুলতে পারেননি। ভুলতে পারেননি এটা নিয়ে সিনেমা করার কথা। সে কারণে প্রৌঢ় বয়সে এসে তিনি তৈরি করেন ঘরে বাইরে। সালটা ১৯৮৫। অবশ্য এই পর্যায়ে এসে আগের সেই চিত্রনাট্যকে বদলে ফেলেন তিনি। তরুণ বয়সে করা নিজের চিত্রনাট্য দেখে নিজেই লজ্জা পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। এই ছবিটা তখন করেননি বলে ভালো কাজ করেছেন এটাই ছিলো তাঁর মতামত। সেই চিত্রনাট্যে হলিউডের প্রভাব ছিলো খুব বেশি মাত্রায়। ফলে, সেটা বাস্তবতার সাথে অতো বেশি সমন্বিত ছিলো না, ছিল বেশ খানিকটা কৃত্রিম।

সত্যজিৎ রায়ের নিজের মুখেই শুনি সে কথা।

“প্রথমে ‘ঘরে-বাইরে’ করার কথা ছিল, ‘পথের পাঁচালি’র আগে; কিন্তু সেই ‘ঘরে-বাইরে’-র তখন যে আমি চিত্রনাট্য করেছিলুম, সেই চিত্রনাট্য পড়ে পরে আমার নিজের লজ্জা হয়েছিল এবং সত্যি করে সে ছবি যদি তখন হত তাহলে কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ অন্যরকম হত। সেখানে আমি কোনও রকম স্থান করে নিতে পারতাম না, মোটামুটি হয়তো অন্যদের তুলনায় একটা ভালো ছবি হত।”

১৯৪৬ সালে যে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য প্রথমে তিনি লিখেছিলেন, সেই চলচ্চিত্র তিনি করেছেন প্রায় চল্লিশ বছর পরে। এই চল্লিশ বছরে সময় এগিয়েছে, সময় পাল্টেছে, তিনিও তরুণ থেকে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁর চিন্তা-ভাবনা বদলেছে, আগের চেয়ে নিঃসন্দেহে পরিণতও হয়েছে। ফলে, স্বাভাবিকভাবে এই চলচ্চিত্র রূপান্তরিত হয়েছে আগের চিত্রনাট্য থেকে ভিন্ন চিত্রনাট্যে। ছবিটা ১৯৮৫ সালে মুক্তি পেলেও এর কাজ শুরু হয়েছিলো বিরাশি সালে। এই ছবির শুটিং চলাকালে পরপর দুইবার হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন তিনি। যার কারণে ছবির কাজ শেষ করতে হয় তাঁর একমাত্র পুত্র সন্দীপকে। যদিও পরবর্তীতে ছবির পুরো সম্পাদনাই হয়েছিলো তাঁর তত্ত্বাবধানে।

যাক, ভাগ্যিস তিনি তখন ঘরে বাইরে করেননি। অন্যদের তুলনায় একটা ভালো ছবির চেয়ে বিশ্বসেরা একটা ছবি তাঁর হাত দিয়ে প্রথম বের হয়ে এসেছে, বাঙালি হিসাবে এটা গর্ব আমাদের। অনেকের তুলনায় সামান্য ভালো করলে এই সত্যজিৎ রায়কে আমরা হয়তো পেতাম না। তিনি হয়তো চেষ্টা করতেন ক্রমান্বয়ে ভাল করার, নিজের মানকে অতিক্রম করে যাবার। কিন্তু প্রথম ছবির অতি উচ্চমানের হবার কারণে সারাজীবন তাঁকে নিজের সাথেই লড়াই করতে হয়েছে বাকি সিনেমাগুলোর মানকে সেই পর্যায়ে রাখতে। আর সে কারণেই আমরা তাঁর হাত থেকে পেয়েছি অসংখ্য অসাধারণ মানের চলচ্চিত্র।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত