আলতমাস পাশা

২৬ এপ্রিল, ২০১৭ ১৩:১৯

বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বাস্তবসম্মত নয়

জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রের একটি পাইপ ছিদ্র হয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ১২ টন তেজস্ক্রিয়তা মিশ্রিত পানি নির্গত হয়েছে। এ পানির একটি অংশ প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবাহিত হতে পাবে বলে খবরে প্রকাশ পেয়েছে। পরিবেশ সচেতন মানুষ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।

বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের জন্য জোরালো দাবি উঠেছে। জার্মানিসহ বিশ্বেও বহু দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিকল্প জ্বালানি যেমন সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি এবং জিও থার্মাল শক্তির ব্যবহার বাড়ছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় বিশ্বেও এরূপ অবস্থায় পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে  বাংলাদেশ সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে। রাশিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্রযুক্তি রয়েছে। তবে সে প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায় ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রের দুর্ঘটনার কথা এখনও আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায় নি।

উল্লেখ্য যে, গত বছরের ২ নভেম্বর রূপপুরে একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কাঠামোগত চুক্তি হয়। চুক্তির ফলে উক্ত স্থানে দু’হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হবে। যেখানে দু’হাজার মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিট থাকবে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আগামী দশকে আরো এধরনের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বর্তমান সরকারের। এক্ষেত্রে পরিবেশগত বিষয়গুলো সরকার বিবেচনায় নিয়েছে কী না তা দেশের মানুষের কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার ও পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তেমন অবগত নয়। তাই সরকারের উচিত ছিল যেকোনো চুক্তির পূর্বে দেশের সাধারণ জনগণকে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো। পরমাণু শক্তি ব্যবহারের নেতিবাচক দিকসমূহ সম্পর্কে জানার অধিকার এদেশের মানুষের রয়েছে।

প্রথমত আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পারমাণবিক শক্তি অসঙ্গতিপূর্ণ একটি শক্তির আধার। কারণ প্রতিটি নতুন জেনারেশন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে খরচ অনেক বেশি পড়ে। এমনকি দেখা গেছে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বর্তমানের গ্যাস চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়েও অনেক বেশি ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে খরচের হার খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বিলিয়ন ডলার থেকে ট্রিলিয়ন ডলারে রূপ নিয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের পক্ষে এ খরচের বোঝা বহন করা অসম্ভব হয়ে যাবে, কারণ অনেক বেশি দামে তাদের এই বিদ্যুৎ কিনতে হবে।

দ্বিতীয় আশংকার কারণ হচ্ছে বিজ্ঞানীরা আজও জানেন না কীভাবে নিরাপদে পারমাণবিক বর্জ্য পরিবহন, সুবিন্যস্ত বা সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভবপর হবে। বর্তমানে সারা বিশ্বব্যাপী ব্যবহার করা পারমাণবিক চুল্লির রড জমা করে রাখা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাভাদার উটাকা পর্বতের মাটির গভীরতম অংশে গর্ত করে বিশেষভাবে পারমাণবিক চুল্লির রড বা বর্জ্য পুঁতে রাখা হয়েছে। মাটির নীচের এই গর্ত বা ভল্টে ১০,০০০ বছরেও কোন লিক বা ছিদ্র হবে বলে না বলে দাবি করা হলেও খোদ মার্কিন পরিবেশ সংরক্ষণ এজেন্সি বলেছে যে মাটির নীচের এই ভল্টে ছিদ্র বা লিক হবার আশংকা তীব্র হয়ে উঠছে।

এছাড়া ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি এজেন্সির পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে ইউরেনিয়ামের উৎস কমে আসছে। সম্ভবত ২০২৬ সালের মধ্যে তা চাহিদাপূরণের ক্ষমতা হারাবে।

সবচেয়ে চিন্তার কারণ দুটি পারমাণবিক স্থাপনা থেকে যে বর্জ্য উৎপন্ন হয় তার স্থানান্তরণে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। যদিও বলা হচ্ছে বাংলাদেশের রূপপুরে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হবে তার বর্জ্য রাশিয়া নিয়ে যাবে। তবে সে দেশে বর্জ্য নিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত তা কোথায় রাখা হবে সে সম্পর্কে আমরা সঠিক কোন তথ্য জানি না। রাশিয়া তা সমুদ্রপথে নিয়ে যাবার সময় বঙ্গোপসাগরেই যেকোনো লিকেজ হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? এরকম প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রগুলো সন্ত্রাসী আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ২০০৫ সালে এ রকম একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করা হয়েছিল। এছাড়া বলা হয়ে থাকে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ শক্তি কেন্দ্রগুলো আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর  ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট। বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে এর কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের এখন খুঁজতে হবে আরো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। ভাবতে হবে পুনঃব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি নিয়ে। যেমন, সৌরশক্তি, বায়ু, জিওথার্মাল, পানি এবং জৈবপ্রযুক্তি। আমাদের ভবিষ্যৎ জ্বালানি শক্তি আসবে সূর্য থেকে, ইউরেনিয়াম থেকে নয়।

সবচেয়ে আশংকার কথা হচ্ছে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে। দেশের ষোল কোটি মানুষ আতংকিত। ভূমিকম্পপ্রবণ একটি এলাকায় এরূপ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। যতরকমের আধুনিক সতর্কতা মেনেই এই কেন্দ্র বানানো হোক না কেন সব জেনেশুনে কেন আমরা ঝুঁকির মুখে যাবো? আর পাকিস্তান আমলের প্রস্তাবিত একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে কেনইবা আমরা এতো আগ্রহী? সৌরশক্তি ব্যবহার জনপ্রিয় করতে, সহজ করতে, সৌর প্যানেল বসানোর খরচ কমিয়ে আনতে কেন আমরা চেষ্টা করবো না?

আজ তাই সময় এসেছে পারমাণবিক শক্তিকে না বলার; আর বিকল্প জ্বালানি তথা পুনঃব্যবহারযোগ্য জ্বালানি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার।

  • আলতমাস পাশা: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও গবেষক; একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। ইমেইল: [email protected]
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত