আল আমিন হোসেন মৃধা

০৫ মে, ২০১৭ ১৮:০২

একদিকে এ প্লাস ঝড়, অন্যদিকে ঝরে পড়ছে লক্ষাধিক!

গতকাল বিকেলে রিক্সায় ফিরছিলাম শাহবাগ থেকে। হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশের মিষ্টির দোকানে উপচে পড়া ভিড়। রাস্তার ওপরেই একজন অন্যজনের মুখে তুলে দিচ্ছে মিষ্টি। সবার মুখেই হাসির ফোঁয়ারা। এসব দেখে রিক্সাচালক উৎসুক জনতার মতো আমাকে প্রশ্ন করলো, "মামা মানসের (মানুষের) মনে আজগে এত আনন্দ ক্যান?" উত্তরে বললাম, "আজ এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে, তাই এতো আনন্দ।"

রিক্সাচালক আমার কথা শুনেই থেমে গেলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন, এবার তাঁর ছেলেও পরীক্ষার্থী ছিলো। কিন্তু ফরম পূরণের টাকা যোগাড় করতে না পারায় পরীক্ষা দিতে পারে নি। এখন রুটির কারখানায় কাজ নিয়েছে। তাঁর এই কাঁপা কন্ঠের কথাগুলো কেমন যেন ভেতরটাকে নাড়া দিল। শিক্ষার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার যদি রাষ্ট্র নিতো, হয়তো আজ তাঁর ঘরেও এমন আনন্দ থাকতো, থাকতো বাঁধভাঙা উল্লাস।

মাধ্যমিক (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৭শ' ৬১ জন। আজকের পত্রিকা জুড়ে ছাপা হয়েছে এই শিক্ষার্থীদের হাসিমাখা মুখ। পত্রিকার প্রথম পাতায় ভরে আছে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের উল্লাসমুখর দলবদ্ধ ছবি। চারদিকে আজ এ প্লাসের বন্যায় যেন প্লাবিত হয়েছে আনন্দ।

আর এই সীমাহীন আনন্দ দেবার কৃতিত্ব নিতে সরকার নিশ্চয়ই বসে থাকবে। তারা বলবে, 'শিক্ষাখাতকে আমরাই একমাত্র উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিয়েছি। সংযোগ করেছি ডিজিটাল পাঠ্যসূচি। ঢেলে সাজিয়েছি শিক্ষাব্যবস্থা। আনয়ন করেছি অভিনব প্রশ্নপত্র। আমাদের শাসনামলেই বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি। উপবৃত্তিও বাড়িয়েছি শতকরা হারে। যার ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষাখাত এখন রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।'

সরকারের এহেন এ প্লাসের কৃতিত্বের জন্যেই বোধেহয় পাঠ্যপুস্তুকে সংযুক্ত হয়েছে, 'শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।'

আজ চারদিকে এ প্লাসের বন্যায় প্লাবিত আনন্দের মাঝে কেউ নিশ্চয়ই মনে রাখবে না রিক্সা চালকের ছেলের কথা, যে টাকার অভাবে পরীক্ষা দিতে পারেনি। মনে রাখবে না পিএসসি থেকে জেএসএসি, এসএসসি ও এইচএসসি পর্যন্ত ঝরে পড়া কয়েক লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর কথা। এ দেশে ক্রমেই নাতিদীর্ঘ হচ্ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর মিছিল। কালের বিবর্তনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এসব ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের খবর।

কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক-

প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষার মোট পরীক্ষার্থীঃ
♦ ২০১৬ সালে মোট পরীক্ষার্থী ৩২,৩০,২৮৮
♦ ২০১৫ সালে মোট পরীক্ষার্থী ৩২,৫৪,৫১৪
♦ ২০১৪ সালে মোট পরীক্ষার্থী ৩০,৯৪,২৬৫
♦ ২০১৩ সালে মোট পরীক্ষার্থী ২৯,৫০,১৯৩
♦ ২০১২ সালে মোট পরীক্ষার্থী ২৯,৬৯,৪০২
♦ ২০১১ সালে মোট পরীক্ষার্থী ২৬,৩৭,২৩৫

জেএসসি-জেডিসি সমাপনী পরীক্ষার মোট পরীক্ষার্থীঃ
♦ ২০১২ সালে ১৯ লাখ ০৮ হাজার ৩৬৫ জন
♦ ২০১৩ সালে ১৯ লাখ ০২ হাজার ৭৪৬ জন
♦ ২০১৪ সালে ২০ লাখ ৯০ হাজার ৬৯২ জন
♦ ২০১৫ সালে ২৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৩৩ জন
♦ ২০১৬ সালে ২৪ লাখ ১২ হাজার ৭৭৫ জন
♦ ২০১৭ সালে ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯৫৯ জন

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার মোট পরীক্ষার্থীঃ
♦ ২০১৪ সালে ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৪২৭ জন
♦ ২০১৫ সালে ১৭ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭ জন
♦ ২০১৬ সাল ১৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৩৮ জন
♦ ২০১৭ সালে ১৬ লাখ ৫১ হাজার ৫২৩ জন

এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার মোট পরীক্ষার্থীঃ
♦ ২০১৪ সালে ১০ লাখ ১২ হাজার ৫৮১ জন
♦ ২০১৫ সালে ১১ লাখ ৪১ হাজার ৩৭৪ জন
♦ ২০১৬ সালে ১২ লাখ ১৮ হাজার ৬২৮ জন
♦ ২০১৭ সালে ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮৬ জন

অর্থাৎ, ২০১১ সালে পিএসসি ও সমমান পরীক্ষার পরীক্ষার্থী ছিল ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ২৩৫ জন। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০১৪ সালে জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৪২৭ জন এবং ২০১৭ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮৬ জন।

২০১২ সালে জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ০৮ হাজার ৩৬৫ জন। এই শিক্ষার্থীরা ২০১৫ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলো ১৭ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭ জন এবং ২০১৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮৬ জন।

২০১১ সালের পিএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়া পরীক্ষার্থীরা ২০১৪ জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় এসে ১২ লাখ ০৪ হাজার ৮০৮ জন এবং ২০১৭ এসএসসিতে এসে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৮ জন ঝরে পড়ে। অর্থাৎ পিএসসি থেকে এসএসসি পর্যন্ত আসতে ঝরে পড়ে মোট ১৪ লাখ ৪৮ হাজার ৮৮৬ জন শিক্ষার্থী।

অপরদিকে, ২০১২ সালের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার্থী ২০১৫ সালে এসএসসিতে এসে ১ লাখ ২২ হাজার ও এইচএসসিতে এসে ৬ লাখ ২ হাজার ৩৬১ জন ঝরে পড়ে। অর্থাৎ জেএসসি থেকে এইচ এস সি পর্যন্ত মোট ঝরে পড়ে ৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৭৯ জন।

এই ঝরে পড়ার সংখ্যাটি সবচেয়ে বেশি পিএসসি থেকে জেএসসি-জেডিসি পর্যন্ত। বয়স হিসেবে ধরলে ১২ বছর বয়সের আগেই সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। অর্থাৎ শিক্ষা থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার শিশুরা।

শিক্ষাখাত নিয়ে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের রসালো দাবির অপ্রিয় বাস্তবতা এখন অনেকটাই ফিকে হতে বসেছে এই তথ্যগুলোতে। কারণ, এগিয়ে যাওয়ার এ দেশে ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর মিছিল। ঝরে পড়া লম্বা এ মিছিলের শুরুটা চোখে পরলেও শেষটা মনে রাখার মত কেউ নেই।

গত কয়েক বছরের ব্যবধানে কয়েক লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে রয়েছে নানা বাধা। প্রধান কারণ হিসেবে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক না করায় অষ্টম শ্রেণিতে যাওয়ার আগেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া রয়েছে দারিদ্র্য, নদীভাঙ্গন, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অভাব, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের কারিকুলামের সমন্বয়হীনতা, বাল্যবিবাহ, ছেলেদের কাজে যোগদান, দুর্গম এলাকায় শিক্ষার সুযোগের অভাব ইত্যাদি।

এসব নানাবিধ সমস্যাকে দায়ী করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকে ৬টি বই পড়া একজন শিক্ষার্থীকে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেই ১৩ থেকে ১৪টি বই পড়তে হচ্ছে। অনেকেই এই বইয়ের চাপ নিতে পারছে না।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঝরে পড়ার সংখ্যা ৪০ শতাংশের বেশি।

এই ঝরে পড়ার হার শুধু প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করা শিক্ষার্থীর এক তৃতীয়াংশই উচ্চতর ডিগ্রির সুযোগ পায় না। বাংলাদেশের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে খুব বেশি হলে ২০-২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে পারে।

অথচ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের কথা ভাবাই যায় না। একটি রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি আর যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল মানসম্মত শিক্ষার সহজলভ্যতা। শিক্ষার আর্থিক সম্পূর্ণ ব্যয়ভার রাষ্ট্র যতদিন নেবে না, ততদিন এ সমস্যার সমাধান হবে না। এজন্য প্রয়োজনে সামরিকসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় কমিয়ে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

শেখ সাদি বলেছিলেন, 'একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি আরেকজন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত করতে পারে না।' আমাদের সরকার মহোদয়েরা শিক্ষা সম্প্রসারণে ঘুমন্ত। এই জাতিকে শিক্ষিত করে জাগ্রত করবে কে?

শিক্ষা হলো সভ্যতার রূপায়ন, জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষাই উন্নয়নের হাতিয়ার, মুক্তির লাল নিশান। শিক্ষা ছাড়া জীবন অপূর্ণ। এটা কোন সুযোগ নয়, কারো দান নয়, এটা অধিকার। তাই আসুন, শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌছে দিতে শিক্ষার অধিকার আদায়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।

 

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত