আব্দুল করিম কিম

০৪ জুন, ২০১৭ ১৪:৫৩

একজন সুলতানা কামাল

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ-এর উত্তাল আন্দোলন চলছে। শাহবাগে সে আন্দোলন বিরামহীন ভাবে চললেও সিলেটে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমরা অবস্থান নিতাম। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বাইরের রাস্তায় বিকেল ৩টা থেকে শুরু করে রাত ৮টা বা ৯টায় প্রতিদিনের অবস্থান জাতীয় সংগীত গেয়ে সমাপ্ত হত।

সে সময়ের কথা; একদিন মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল'কে দেখলাম শহীদ মিনারের ভেতর বক্তব্য রাখছেন। একটি সামাজিক সংগঠনের জেলা সম্মেলন চলছিল সকাল থেকে। উনি প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন। ৩টা বেজে গেছে। আমাদের লোকজন রাস্তায় অবস্থান নেয়া শুরু করেছে। ভেতরের অনুষ্ঠানের আয়োজকদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হল গণজাগরণ মঞ্চ-এর অনুষ্ঠান দেরিতে শুরু করতে। আমরা বিকাল ৪টায় শুরু করবো জানালাম। কিছুক্ষণপর ভেতরের অনুষ্ঠান সভাপতির বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হল। সুলতানা কামালকে দেখলাম শহীদ মিনার থেকে বেড়িয়ে আসছেন। উনার সাথে সুপ্রিয় চক্রবর্তী। আমি পাশে গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, আপা, গণজাগরণ মঞ্চ-এর অনুষ্ঠান এখনই শুরু করবো। আপনি সংহতি বক্তব্য রাখলে আমরা অনুপ্রাণিত হব।

উনি বললেন, কিম, আমি তোমাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে পারবো না।

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বললাম, আপা, আপনার কথা বুঝলাম না?

উনি বললেন, তোমাদের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই দাবির সাথে সংহতি জানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথমত: একজন মানবাধিকার কর্মী হিসাবে আমি মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে। দ্বিতীয়: আমি অপরাধের বিচার চাইতে পারি কিন্তু তোমাদের মত ফাঁসির কথা বলতে পারবো না।
-এই হলেন সুলতানা কামাল।

এ বন্ধ্যা সময়ে আদর্শকে জলাঞ্জলি দেয়া দলদাস ও দলকানা বুদ্ধিজীবীদের ভিড়ে নিজের বিশ্বাস ও আদর্শকে সমুন্নত রেখে লড়ে যাওয়া একজন নির্লোভ,নির্মোহ, সাহসিকা তিনি। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে স্পষ্ট ভাষায় নির্ভীক উচ্চারণে সত্য প্রকাশ করে যাচ্ছেন। এই মুহূর্তে জাতির বিবেক হিসাবে সুলতানা কামাল ছাড়া আর কে আছেন?

মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামালকে আমরা ২০০৬ সালের জাতীয় সংকটকালে দেশের অভিভাবক হিসাবে দেখেছিলাম। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করা সম্ভব নয় উপলব্ধি করে ইয়াজউদ্দীন-এর উপদেষ্টা পরিষদ থেকে তিনি নির্দ্বিধায় পদত্যাগ করেছিলেন। ইয়াজউদ্দীন-এর অধীনে বিএনপি-জামাতের নীলনকশার নির্বাচন পণ্ড হওয়ার পেছনে এই পদত্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার সড়কের বাসিন্দা হিসাবে কবি সুফিয়া কামাল পরিবার বঙ্গবন্ধু পরিবারের শুধু প্রতিবেশী নয়, সর্বসময়ের পারিবারিক বন্ধু। কিশোরকাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সুলতানা কামাল-এর সইয়ালা। দু'জন দুজনকে 'তুই' বলেই সম্বোধন করেন। মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় দুজনের লক্ষ্য এক। নিজের অবস্থান থেকে উনারা সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হওয়া সত্ত্বেও সুলতানা কামাল নিজের পরিচয় নিয়েই আত্মসম্মান ও ব্যক্তিত্ব সমুন্নত রেখে চলেন। সরকারের বিশাল কর্মযজ্ঞে চাইলেই তিনি অংশীদার হতে পারেন কিন্তু নিজের কাজ নিয়েই তিনি ব্যস্ত।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী ও টিআইবির চেয়ারপার্সন হিসাবে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যপালনে কোন রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলে গেছেন। ২০০২ সালের বিএনপি-জামাত জোট আমলে সংখ্যালঘু নির্যাতন, সুশাসন বিরোধী কার্যকলাপ, বিচার বহির্ভূত হত্যা সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনে যেভাবে সোচ্চার ছিলেন, ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকারের মহাজোট আমলেও একইভাবে সোচ্চার থেকেছেন।

২০১৫ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) থেকে পদত্যাগ করার পর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর একজন সহ-সভাপতি হিসাবে দেশের পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হোন। বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাপার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিয়মিত নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এ অবস্থায় বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপালে ভারতের সহযোগিতায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হলে পরিবেশবাদী ও বামধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলো-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সরকার প্রধানের রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় অবস্থানের কথা জানা সত্ত্বেও সুলতানা কামাল নিধিরাম সর্দারের মত সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বগ্রহণ করেন।

বাম রাজনৈতিক সংগঠন সমূহের নেতৃত্বে পরিচালিত তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বিভিন্ন ইস্যুতে দীর্ঘদিন থেকে সরকারের 'জাতীয় সম্পদ' বিষয়ক নীতির বিরোধিতা করছে। বাম রাজনৈতিক সংগঠনের আন্দোলনের গতি প্রকৃতি ও শক্তি সম্পর্কে ধারনা থাকায় রামপাল আন্দোলন নিয়ে সরকারের খুব একটা উৎকণ্ঠা ছিল না। কিন্তু প্রায় অর্ধশত পরিবেশবাদী ও নাগরিক সংগঠন নিয়ে গড়ে ওঠা 'সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি'র আহবায়ক হিসাবে সুলতানা কামাল সরকারের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিলে, সরকার বেকায়দায় পড়ে যায়। সরকারের বাচাল মন্ত্রীরা সুলতানা কামাল-এর নির্দয় সমালোচনা করতে গিয়েও প্রধানমন্ত্রীর কথা ভেবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন।

মানবাধিকার ও সুশাসন ইস্যুতে সুলতানা কামাল সরকারের সমালোচনায় কোন কার্পণ্য করেননি। তাঁর এ সমালোচনাকে কিশোরবেলার বান্ধবী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহজ ভাবেই নিয়েছেন। এসব সমালোচনার কারণে অতীতে দুই বান্ধবীর সম্পর্ক শীতল হয়নি কিন্তু সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন-এর কারণে শীতল হয়েছে বলে কাছের মানুষদের ধারনা। শুধু প্রধানমন্ত্রীর সাথে নয়, রামপাল ইস্যুতে উনার দৃঢ় অবস্থানের কারণে ভারতের দালাল, 'র-এর এজেন্ট হিসাবে ডানপন্থীদের অপপ্রচারের শিকার সুলতানা কামাল'কে ভারতীয় দূতাবাস এ বছরের জানুয়ারিতে ভিসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। এ খবর কোথাও আলোচিত হয়নি।

ব্যক্তিগত এক আলাপচারিতায় ভারতীয় ভিসা না পাওয়ার কথা শুনে বলেছিলাম, আপা, ইনকিলাব, সংগ্রাম ও নয়াদিগন্তকে এ খবর জানানো দরকার।

উনি হেসে বলেছিলেন, এ খবর শুনেও তাদের বিশ্বাস বদলাবে না। কে কি মনে করলো, আমি সেসব ভেবে কাজ করি না।

সুলতানা কামাল-এর এমন মনোভাবের জন্য উনার শুভানুধ্যায়ী সীমিত। আওয়ামীলীগে ঘাপটি মেরে থাকা দলীয় আদর্শের বিরোধী মুখোশধারীরা সুলতানা কামাল-কে পছন্দ করে না। আওয়ামীলীগের জন্য সুলতানা কামাল অনেকটা ন্যায়পাল সম। আবার উনি আওয়ামীলীগের নন, ডজন খানেক বাম দলেরও নন। বিএনপিরতো প্রশ্নই আসে না। তবুও সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন'কে সরকার বিরোধী আন্দোলনে মোড় নেয়ানোর ইচ্ছায় বিএনপি পরিবেশবাদী এক আলোচিত নেত্রীকে এসাইনমেন্ট দিয়েছিল। বিএনপির ইচ্ছা ছিল সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটিকে দিয়ে সুন্দরবন ইস্যুতে হরতালের মত রাজনৈতিক কর্মসূচীর ঘোষণা আদায় ও রাজপথে সমান্তরালে আন্দোলন করার সুযোগ। কিন্তু সুলতানা কামাল দূরদর্শিতার সাথে সে দুরভিসন্ধি সামাল দেন।

গড়পড়তা শারীরিক গঠনের মধ্যবয়সী বাঙ্গালী নারী সুলতানা কামাল-কে আপোষহীন ব্যক্তিত্বের কারণে সবাই সমীহ করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় উনার দৃঢ় অবস্থান চিহ্নিত অপশক্তি কোন ভাবেই মানতে পারে না। তাই উনার বিরোধিতা করতে যেয়ে এই অসভ্য অপশক্তি ব্যক্তিগত জীবনকে টেনে নিয়ে আসে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেয়া বক্তব্যকে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে উপস্থাপন করে সুলতানা কামাল-এর বিরুদ্ধে রাস্তায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই অপশক্তি ধর্মীয় উস্কানি দেয়া শুরু করেছে। একজন মানবাধিকারকর্মীর প্রকাশ্যে দেয়া বক্তব্যকে দুরভিসন্ধিমূলক উপায়ে উপস্থাপন জঘন্য মিথ্যাচার।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে পারল না, তার রোজা রেখে পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৫৭)।

পবিত্র রমজান মাসে জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমে জুম্মার নামাজ শেষ হেফাজতের নেতাদের সুলতানা কামাল-এর বক্তব্য নিয়ে করা মিথ্যাচার দেখে বুঝতে পারলাম ইসলামের হেফাজত করার সামান্যতম যোগ্যতা তথাকথিত এই আলেমদের নেই। এরা ইচ্ছাকৃত ভাবে যে কথা সুলতানা কামাল বলেন নাই, তা শোনার কথা প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এতে হয়তো তাদের সাময়িক লাভ হচ্ছে কিন্তু অপপ্রচারকারীদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জান গরীব কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সুনান আত তিরমীযি ২৪১৮]

  • লেখক : পরিবেশ কর্মী
  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত