দিব্যেন্দু দ্বীপ

২৮ জুন, ২০১৭ ২০:১৪

ধীরে ধীরে ভারত কি একটি সাম্প্রদায়িক জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে?

ভারতবর্ষ থেকে বেরিয়ে আসা দেশগুলো প্রকাশ্যে কতটা অসাম্প্রদায়িক আচরণ করবে তা অনেকখানি নির্ভর করে ভারত কেমন আচরণ করছে তার ওপর। ভারতের আচরণ পরিমাপ করতে হবে দুইভাবে- জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। অর্থাৎ সে তার নিজ দেশের অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগণের সাথে কেমন আচরণ করছে এবং দেশ হিসেবে ছোট দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে কেমন ব্যবহার করছে।

দেশের জনগণের সাথে ‘আচার-বিচার’ করে রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠরা। স্বভাবতই এখানে প্রশ্ন আসে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু মুসলিমদের সাথে কেমন আচরণ করছে? সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও সামাজিকভাবে ভারতকে একটি ধর্মরাষ্ট্রই মনে হয়। সম্প্রতি বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে খবরগুলো পাওয়া যাচ্ছে তাতে এ প্রশ্ন করা যায়- ধীরে ধীরে ভারত কি একটি সাম্প্রদায়িক জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে? প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা পরিমাপ করতে হবে তথ্যের আলোকে। বেশি পেছনে যাব না, মে-জুন, এই দুই মাসের আলোচিত কিছু তথ্য বোঝার চেষ্টা করি-

১। গরু চুরি সন্দেহে দুই মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা;
খবরটি মে মাসের ১ তারিখের। ঘটনাটি আসামের। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
২। Muslim man tied to tree, beaten to death;
এটি মে মাসের ৩০ তারিখের ঘটনা। খরব: টাইমস অব ইন্ডিয়ার।
৩। ভারতে গোরক্ষা: ঈদে বাড়ি ফেরা হলো না জুনাইদের।
ঘটনাটি জুন মাসের ২৪ তারিখের। শিরোনাম: বিডিনিউজ।

অনেকে হয়ত বলবেন যে এরকম ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটছে। এই যেমন মাত্র কয়েকদিন আগে দিনাজপুরের কাহারোলে ধন্যিরাম নামক এক কিশোরকে যৌনাঙ্গ থেতলে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাহলে দেশের এই খবরটির চেয়ে ভারতে মুসলিম কিশোরকে হত্যার খবরটি আমাদের কাছে বড় হয়ে গেল কীভাবে?

প্রথমত, আমি তুলনামূলক আলোচনা করছি না, দ্বিতীয়ত, আমার কাছে ভারতে কোনো মুসলিম সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর এই কারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু আমি প্রত্যাশা করছি বড় দেশ হিসেবে ভারতকে অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে ভারতে যেটি হচ্ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, বাংলাদেশে অন্তত এরকম কিছু এখনো হচ্ছে না। এদিক থেকে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভালো বলতে হবে।

ভারতে সর্বশেষ যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটির ভিন্ন তাৎপর্য আছে, এটি রীতিমত ফ্যাসিবাদের পর্যায়ে পড়ে, যদিও সত্য হচ্ছে, এরকম ঘটনা ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ঘটছে। খবরে প্রকাশ- সহোদর শাকির ও হাশেমের সঙ্গে ঈদের কেনাকাটা শেষে দিল্লি থেকে ট্রেনে বাড়ি ফিরছিল ১৬ বছরের কিশোর জুনাইদ খান। ট্রেনের সিটে বসা নিয়ে তাদের সাথে অন্যযাত্রীদের ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে ‘গরুর মাংস বহন করছে’ অভিযোগ তুলে ট্রেনে একদল লোক তাদের উপর হামলা চালায়। ছুরিকাঘাতে নিহত হয় জুনাইদ।

অর্থাৎ এটি কোনো নির্জন বা ব্যক্তিগত, এমনকি গোষ্ঠীবদ্ধ হত্যাকাণ্ড নয়, এটি ঘটেছে লোকারণ্য ট্রেনের কামরায়। বোঝার চেষ্টা করছি, কোনো ট্রেনের কামরায় সাম্প্রদায়িক জিকির তুলে কাউকে ছুরি মারা যায় ঠিক কেমন পরিস্থিতি হলে? ঐ কামরায় যতজন যাত্রী ছিল, সবাই কি জুনাইদের শত্রু ছিল? কীভাবে, কেন অচেনা মানুষগুলো তাদের শত্রু হল?

বাংলাদেশে ধন্যরাম হোক আর ভারতে জুনাইদ হোক, এই খবরগুলো আমি বিশ্বাস করতে চাই না। পৃথিবীর কোথাও এসব ঘটছে ভাবতে চাই না। কিন্তু সত্য হল- বর্বর এসব ঘটনা ঘটছে এবং ঘটছে সবচে’ প্রাচীন মানবিক ঐতিহ্যের জনপদ ভারতবর্ষে।

বর্তমান ভারত, যারা নিজেদেরকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, যাদের সংবিধান ধর্ম নিরপেক্ষ, অহিংস মতবাদের রাজনীতির জনক গান্ধী যাদের জাতির পিতা, মাদার তেরেসা যে দেশের নাগিরক; সে দেশের মানুষ এরকম ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক হবে?

সংবিধানে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (Secular State) হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে এভাবে-
কোনো বিশেষ ধর্মকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ধর্ম (State Religion) হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী জাতি, ধর্ম ও ভাষার পার্থক্যের জন্য রাষ্ট্র কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। প্রত্যেক নাগরিকই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম আচরণ করতে পারবে।

অর্থাৎ মানবিক বোধের কথা বাদ দিলেও ভারতে যা ঘটছে তা সুস্পষ্টভাবে সংবিধান লঙ্ঘন। প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম কতটি ঘটনার এখন পর্যন্ত বিচার হয়েছে? সাজা হয়েছে? একথা সত্য যে ঘটনার প্রেক্ষিতে বেশকিছু গণমাধ্যমে অনেকের বিক্ষুব্ধ মতামত পড়েছি, কিন্তু ভারতের সাধারণ জনগণ তাতে কতটুকু বদলাচ্ছে আসলে, নাকি প্রতিদিন তারা আরেকটু বেশি করে সাম্প্রদায়িক হচ্ছে?

বাংলাদেশে কোনো উগ্রবাদী ধর্মীয় দল ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রের যে রূপ হতে পারে বলে আমরা ধারণা করি, ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় থাকাতে কি তাই হয়েছে? সেক্ষেত্রে ভারতে প্রগতিশীল শক্তির সক্রিয়তা নিশ্চয়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ ধরনের নৃশংসতা যদি রাজনৈতিক প্রশ্রয় পায় তাহলে দিনকে দিন তা বাড়তেই থাকবে, বাড়ছেও। কিন্তু ভারতের আলোকিত সামাজিক শক্তি এমন কোনো বার্তা তৈরি করতে পারছে না যাতে মানুষের নৈতিক এবং মানবিক বোধ জাগ্রত হয়।

ভূপেন হাজারিকার আসাম, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কোলকাতা, গান্ধীর গুজরাট ভারতের সবখানে আজ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, অসহিঞ্চুতা। আমরা বিস্মিত, বিরক্ত, বিক্ষুব্ধ।

 

  • লেখক : সাংবাদিক
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত