জাহিদুর রহমান

৩০ জুন, ২০১৭ ১৯:০৬

ক্লিনিক্যাল ফটোগ্রাফি: সম্ভাবনা এবং সতর্কতা

ছবি: সংগ্রহ

বর্তমানে উচ্চ গতির ইন্টারনেট এবং ভাল ক্যামেরা সমৃদ্ধ স্মার্টফোনের যুগে ক্লিনিক্যাল ফটোগ্রাফি বা মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল ক্যামেরায় রোগি কিংবা চিকিৎসা সম্পর্কিত ছবি ধারণ করা নিঃসন্দেহে একটি আশির্বাদ। রোগিকে সুচিকিৎসা দেয়া, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের বাস্তবসম্মত, তথ্যপ্রমাণ ভিত্তিক জ্ঞান দেয়া, অথবা চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণার কাজে আজকাল ডাক্তার, মেডিকেল শিক্ষার্থী, নার্স এবং অন্যান্য মেডিকেল স্টাফদের হাতের স্মার্টফোনটি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। কিন্তু প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার বা প্রয়োগ না হলে আশির্বাদ আবার অভিশাপ হতেও সময় লাগে না।

আমাদের মনে রাখা উচিত, প্রতিটি ক্লিনিক্যাল ইমেজই একেকটি হেলথ ইনফরমেশন বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য। একজন রোগির সব ধরনের হেলথ ইনফরমেশনের গোপনীয়তা রক্ষার করার দায়িত্ব তাকে চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তার এবং হাসপাতালের। কিন্তু বাস্তবে কি আমরা ক্লিনিক্যাল ফটোগ্রাফি করার সময় সেরকম কোন নীতিমালা অনুসরণ করছি?

ক্লিনিক্যাল ফটোগ্রাফির সুযোগ সুবিধা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং আইন ও নীতিগত বাধ্যবাধকতা নিয়ে সারা বিশ্বে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে। কারণ বিষয়টির সাথে ডাক্তার এবং রোগি, উভয়েরই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থানের বিষয় জড়িত। এর সাথে ডাক্তার ও রোগির মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার বিষয়টিও জড়িত। এরইমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইডেনসহ বেশ কয়েকটি দেশে ক্লিনিক্যাল ফটোগ্রাফি এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যবহারের জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। সেসব দেশে ডাক্তার, মেডিকেল স্টুডেন্ট, নার্স, হাসপাতাল স্টাফ, প্রত্যেকেই সেই নীতিমালা মানতে বাধ্য এবং না মানলে জরিমানা গুনতে হয়।

আমাদের কাছে অবশ্য এরকম কথাবার্তা অবিশ্বাস্যই মনে হবে। যে দেশে ডাক্তার ও রোগি, কোন পক্ষের স্বার্থ দেখার মতই কোন সক্রিয় প্রতিষ্ঠান নেই, ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলায় রোগি মারা যাওয়ার অভিযোগ উঠলে যে দেশে রোগির স্বজনরাই ডাক্তারের গায়ে হাত তোলে, সেখানে রোগির ছবি তোলার জন্য আবার কিসের নিয়মনীতি? কিসের শাস্তি?!

ফেসবুকে আমার বন্ধু তালিকায় অধিকাংশই ডাক্তার, কয়েকটি ডাক্তারি গ্রুপেও আছি। ইদানিং বিভিন্ন ডাক্তারের ব্যক্তিগত নিউজফিড কিংবা নিজস্ব গ্রুপগুলোতে যেভাবে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে দেদারসে রোগিদের চেহারা এবং প্রাইভেট পার্টসের ছবি কোন রকম রাখঢাক না করেও আপলোড করা হচ্ছে, তা রীতিমত আতঙ্কজনক।

মেডিকেল স্টুডেন্ট বা জুনিয়র ডাক্তারদের কথা বাদ দিলাম, প্রফেসর পর্যায়ের ডাক্তাররাই এসব বেশি করছেন। শিক্ষকরা এমন করলে, ছাত্রছাত্রীরা কি শিখবে?

আমাদের দেশে কোন রোগে, কোন রোগির ক্ষেত্রে, কোন ধরনের চিকিৎসা দেয়া হবে, সেরকম কোন প্রটোকলই বাস্তবে মানা হয় না, সেখানে রোগির ছবি তোলার জন্য গাইডলাইন দেয়া হবে, এত তাড়াতাড়ি এমনটা আশা করাও বোকামি। তারপরও বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কাছে আবেদন করব, আপাতত ছোটখাটো আকারের হলেও ক্লিনিক্যাল ফটোগ্রাফির জন্য একটি নীতিমালা নির্ধারণ করার।

মানুষজন যেহেতু দিন দিন সচেতন হচ্ছে, তাই যতদিন সেরকম কোন নীতিমালা না হচ্ছে ততদিন ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য হলেও ডাক্তাররা যেন ক্লিনিক্যাল ফটোগ্রাফি প্রাকটিস করার সময় কয়েকটি মৌলিক বিষয় মাথায় রাখেন।

  • নিজস্ব মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল ক্যামেরায় চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোন ধরনের ছবি তোলার আগে অবশ্যই রোগির কাছ থেকে 'ইনফর্মড কনসেন্ট' বা সম্মতিপত্র গ্রহণ করবেন। সম্মতি মানে শুধু মৌখিক সম্মতি না, স্বাক্ষরসহ লিখিত ইনফর্মড কনসেন্ট।
  • ইনফর্মড কনসেন্ট বা লিখিত সম্মতিপত্র নেয়া থাকলেও কোন ক্লিনিক্যাল ইমেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করার আগে এমনভাবে এডিট করে দিতে হবে, ছবি দেখে যেন রোগির পরিচয় প্রকাশিত না হয়ে পড়ে।
  • সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজে তোলা ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রেই বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কোন নিউজপেপার, জার্নাল, টেক্সটবুক থেকে ছবি নিলে সেটার সোর্সের নাম, সম্ভব হলে লিংকসহ দেয়া উচিত।

এক কথায় ডাক্তার হিসেবে একজন রোগির অন্যান্য হেলথ ইনফরমেশন বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দলিল যেভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, ছবিগুলোও যেন সেভাবেই সংরক্ষণ করি।

দুই-একজন বিকৃত মন মানসিকতার মানুষ ছাড়া যে কোন ডাক্তারই রোগির ছবি তুলে শেয়ার করেন কোন না কোন ভাল উদ্দেশ্য নিয়েই। কিন্তু সতর্ক না থাকলে আমরা রোগির ভাল করতে যেয়ে নিজেও যেমন বিপদে পড়তে পারি, তেমনি রোগিরও ক্ষতি করে ফেলতে পারি। তাছাড়া নরম্যাল ডেলিভারি বা সিজারিয়ান অপারেশনের ছবি শেয়ার করার সময় রোগির মুখমণ্ডল ডেকে দেয়ার (ব্লার করে দেয়া) কথা অন্যকে মনে করিয়ে দিতে হবে কেন? এতটুকু বিবেক বিবেচনা তো একজন ডাক্তার হিসেবে আমাদের সবারই কম বেশি থাকা উচিত।

এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি নেয়ার সময় আমরা সবাই কিন্তু "হিপোক্রেটিক ওথ" মুখস্থ করেই এসেছি। আসুন সেটা মেনে চলার চেষ্টা করি। অন্যের ভুল ধরিয়ে দেয়া এবং নিজের ভুল শুধরে নেয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিক হই।

  • জাহিদুর রহমান: চিকিৎসক; ইমেইল: [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত