এম.এ ওয়াদুদ

০৬ জুলাই, ২০১৭ ১৭:৪৯

মানবসৃষ্ট বন্যায় ভাসছে সিলেট

কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ১২টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে সহস্রাধিক গ্রাম। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যাকবলিত হওয়ায় এ দু’জেলার সাড়ে ৩ শতাধিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট আজ বন্যায় ভাসছে। বৃহত্তর সিলেটের প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎপত্তিমূল এক, আবার উভয় নদী অন্য স্থানে ভাটিতে মার্কুলীতে একত্রিত হয়েছে। সিলেটের সুরমা নদীকে নিয়ে অনেক লেখক অনেক মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম আব্দুল হাই উল্লেখ করেছেন “আমার নাম সুরমা তাই বলে আমি চোখে দেওয়ার সুরমা নই।”

সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে সুরমা কুশিয়ারার নাম জড়িত। ভারতের ভাঙ্গার বাজার নামক স্থানে সুরমা কুশিয়ারা পৃথক হয়ে সুরমা সিলেট নগরীর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ছাতক সুনামগঞ্জ অতিক্রম করে কুশিয়ারার সহিত মিলিত হয়ে কালনী নাম ধারণ করে।

আবার কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, নবীগঞ্জ অতিক্রম করে ভাটিতে জগন্নাথপুর অতিক্রম করে তার ভাটিতে মার্কুলীতে সুরমা নদীর সহিত মিলত হয়।

কাজেই সুরমা নদীর অঞ্চলে বন্যা কবলিত হলে কুশিয়ারা অঞ্চলে এর প্রভাব পড়ে, আবার কুশিয়ারা নদীতে বন্যা হলে কুশিয়ারার পানি দামড়িয়ার হাওর দিয়ে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বিভিন্ন ছোট বড় খাল নদীর মাধ্যমে সুরমার ভাটি এলাকায় প্রভাব ফেলে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর মতে সুরমা কুশিয়ারা দুটি নদী হলেও কুশিয়ারা অনেকটা গভীর ও বড় হওয়ায় উজানের প্রায় ৮০% পানি কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়। আর সুরমা ভরাট হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ২০% পানি প্রবাহিত হয়।

কুশিয়ারা নদীর পাশ ঘেঁষা বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি বৃহত্তর সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার এবং মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, জুড়ি এবং বড়লেখা উপজেলার বিরাট অংশ নিয়ে অবস্থিত। বর্ষা মৌসুমে হাকালুকির জলাবদ্ধতার প্রভাব উল্লেখিত ৬টি উপজেলার ৮০% ভূমি গ্রাস করে। আর বন্যা হলে প্রায় ৯০% ভূমির ফসলকে গ্রাস করে ফেলে। সিলেটের উজানে ভারতে আসাম ও মেঘালয় এলাকায় প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেট অঞ্চলে ঢলের পানিতে এবং স্থানীয় বৃষ্টির প্রভাবে নদীর দু’কূল উপচে পড়ে। এ বছর বর্ষণ আগে থেকে একটু বেশি মাত্রায় শুরু হয়। আর সাথে সাথে ফেঞ্চুগঞ্জের কাছে জুড়ি নদীর পানি ভাটির দিকে কুশিয়ারা নদীতে না গিয়ে উল্টো কুশিয়ারা নদীর পানি জুড়ির নদীর মাধ্যমে উজান দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। তখন স্থানীয় এলাকাবাসী বলে “নদী উজান ছুটছে।”

অপরদিকে হাকালুকির চতুষ্পার্শ্বস্থ ছোট ছোট অনেক নদী ও ছোট বড় ছড়া খাল ইত্যাদির মাধ্যমে হাকালুকিতে পানি জমা হতে থাকে। মাত্র তিন চারদিন পূর্বে যে কৃষক ফলানো ধানের দিকে চেয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনে থাকে সেই কৃষক মাথায় হাত দিয়ে অসহায়ের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। অন্যান্য বৎসর পানি বৃদ্ধির মাত্রা একটু কম থাকায় হাকালুকি হাওরের অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চল কুলাউড়া উপজেলাধীন এলাকার ক্ষতির পরিমাণ কম ছিল। কিন্তু এ বছর হঠাৎ ঢলের পানি প্রায় ৯০% বোরো ধান নিমিষে তলিয়ে দেয়। বোরো মৌসুমের পর আউশ মৌসুমের প্রাক্কালে পানি অব্যাহত বৃদ্ধি পাওয়ায় আউশ ফসল প্রায় ১০০% নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় আগামী অগ্রহায়ণ মাসেও নবান্ন খাওয়ার মত ব্যবস্থা থাকবে না। এরূপ অবস্থায় হাকালুকি তীরের কৃষি নির্ভর মানুষ বাঁচবে কি করে? ব্রিটিশ আমল থেকে অবহেলিত, পাকিস্তান পিরিয়ড চলে যায়। কিন্তু হাকালুকির উন্নয়ন হয়নি। তারপর বহু কষ্টের বিনিময়ে অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি।

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগর এলাকা থেকে জুড়ী নদী উৎপন্ন হয়ে জুড়ী উপজেলার কয়েকটি গ্রাম পার হয়ে হাকালুকির প্রায় মধ্যখানে ফানাই, কন্টিনালা, বরুদল সহ আর ছোট ছোট অনেক নদী খাল ইত্যাদির সাথে একত্রিত হয়ে ঘিলাছড়া বাজারের পাশ দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা নদীতে মধ্যখানে পিটাইটিকর গ্রাম রেখে দুটি প্রশাখার বিভক্ত হয়ে কুশিয়ারা নদীতে পতিত হয়। জুড়ী নদীর একটি শাখা ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে পূর্বপাশের বুড়ি কিয়ারী নদী বিল হয়ে এবং অপর শাখা পিটাইটিকর গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বুড়ি কিয়ারী নদী বিল হয়ে এবং অপর শাখা পিটাইটিকর গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে কুশিয়ারা নদীতে প্রবাহিত হয়।

২০০৪-০৫ অর্থ বৎসরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে জুড়ী নদীর মোহনায় বুড়ি কিয়ারী বিল প্রায় ৫০০ ফুট দীর্ঘ একটি উঁচু ক্রস বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এতে জুড়ী নদীর একটি শাখা দিয়ে পানির প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় এবং এরপরের বছর বাঁধকে আরও উঁচু করা হয়। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই হাকালুকির উজানের পানি এবং কুশিয়ারায় উজান প্রবাহ ২/৩ দিনে হাকালুকির ধান পানিতে তলিয়ে দেয়। হাকালুকির পানি পূর্ব থেকে ভরা থাকায় বর্ষা মৌসুমে উজানের দিকে বিভিন্ন খালের মাধ্যমে কুশিয়ারা পানিতে স্ফীত হয়ে সুরমার পানিকেও স্ফীত হতে সহায়ক হয়। পরিণামে বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া বড়লেখা জুড়ী উপজেলা সহ সিলেটে ও সুনামগঞ্জে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করেছে। পাকা রাস্তা সহ বাড়িঘর সবই তলিয়ে গেছে। অপরিণামদর্শী জুড়ী নদী বাঁধ মরণ ফাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছে।

এমতাবস্থায় বাঁধ অপসারণ করে এবং স্লুইস গেইট নির্মাণ করে লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যের যোগানের মাধ্যমে হাকালুকি তীরের কৃষক বাঁচানো এবং সুরমা, কুশিয়ারা, কালনী নদী খনন সময়ের দাবী। তাছাড়া বন্যাদুর্গত এলাকাকে দুর্গত ঘোষণার মাধ্যমে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা সময়ের দাবী।

এ ব্যাপারে হাকালুকি বাঁচাও আন্দোলন কমিটি ও কৃষক বাঁচাও সমিতি সহ সাধারণ মানুষ হাকালুকির উন্নয়নের প্রতীক্ষায় আছে।

  • এম.এ ওয়াদুদ: আইনজীবী, কলাম লেখক; সভাপতি, হাকালুকি বাঁচাও আন্দোলন কমিটি।
  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত