উত্তম কুমার দাশ

১৬ আগস্ট, ২০১৭ ০০:২০

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যেনো নিহত না হয়

তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু । তিনিই বাংলাদেশ। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। যেই মানুষটির নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে রচিত হয়ে যায় ইতিহাসের শত শত পাতা।

যেই নাম শুনলেই ভেসে ওঠে সেই ছবিটি, যেখানে একটি লোক জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে তর্জনী তুলে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিচ্ছেন। যে ভাষণে স্বাধীনতার ডাক পেয়ে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সর্বস্তরের বাঙালি। সে দিনের সে ভাষণে জাগ্রত হয়েছিল তরুণ সমাজ।
যার সম্পর্কে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন “আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।''

তিনি রাজনীতি করতেন গণমানুষের জন্য। তিনি বজ্রকন্ঠে বলেছিলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। এদেশের মানুষের অধিকার চাই।''

যার মন কাঁদত কৃষক শ্রমিক নিপীড়িত মানুষের জন্য, যিনি কথা বলতেন ন্যায়ের পক্ষে। জনমানুষের কল্যানে যার জীবনের বড় অংশই কেটেছে কারাভোগে। এই মানুষটাকে নিয়ে কত কবি কাব্য রচনা করেছেন। যিনি রচনা করেছেন দেশের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস। বাঙালি জাতির পিতাকে এই জন্যই “নিউজ উইক” ভূষিত করেছিল “পকেট অফ পলিটিক্স” নামে।

আমাদের দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই। আমাদের আছে প্রচন্ড শোকের কালো একটি দিন। ১৫ আগষ্ট। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় অশ্রুভেজা একটি দিন। ঐ দিনের কথা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জনপদের প্রতিটি ধূলিকণা কখনো ভুলতে পারবে না। যিনি পুরো জীবন দেশের জন্য উৎসর্গ করে গেলেন, যিনি আজীবন এই দেশ মাটি আর মানুষের কথা বলে গেলেন, একটা পর্যায়ে এই দেশের কিছু মানুষই হলো তার প্রাণঘাতক! ওরা কি মানুষ ছিলো?

যেই পিতা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে ওদের মুক্তির জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করেন নি  ওরা সেই পিতাকেই স্বপরিবারে হত্যা করেছিলো ! যিনি বলতেন “আগে আমার দেশ, তারপরে পরিবার''। যিনি দেশের মানুষকে সব সময় পরিবার ভেবেছেন, নিজের পরিবারকে ঠিকমতো সময় দেয়া হয়ে ওঠেনি তার। শিশু রাসেল পিতা মুজিবকে কাছে না পেয়ে মাকেই মাঝে মধ্যে বাবা বলে ডাকতো । ঘাতকরা তাকেও ছাড় দেয় নি। একটুও বিবেকে বাঁধে নি তাদের?

একচল্লিশ বছর পরে এসেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কি কেউ কেউ সস্তায় বিক্রি করে দিচ্ছেন? তাঁরা আদৌ কি জানেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কি ?

সত্যিকারে আদর্শের একটি ঘটনা বলি। মাওলানা ভাসানী তখন দলের সভাপতি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তখনকার সাধারন সম্পাদক। ভাসানী একটি কাজে শেখ মুজিবকে নারায়ণগঞ্জে পাঠান। সাথে দিয়েছিলেন আট আনা পয়সা । মুজিব কাজ শেষ করে বিকেলে এসে মাওলানা ভাসানীর হাতে আট আনা পয়সাই ফেরত দেন। ভাসানী খুবই অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা কি মুজিব, তুমি নারায়ণগঞ্জ কিভাবে গেলে ? বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন - “সাইকেলে করে গিয়েছি , টাকাটা বেঁচে গেছে।''

মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা সারাদিন প্রচার করেন এমন ব্যাক্তিও এদেশে আছেন, যারা সাধারণ জনগনকে কাঁদিয়ে নিজে আখের গোছাতে চান, যারা মিনিটে বিক্রি করেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ !

খুবই সাধারন জীবনযাপন করতেন বঙ্গবন্ধু । ৭৪ সালে সারা দেশে দূর্ভিক্ষ। পিতা মুজিবের মন খারাপ কিন্তু মনোবল দৃঢ়। এসময় তাঁরা সাথে দেখা করতে গেলেন নুরুল ইসলাম। ধানমন্ডির বত্রিশে। ভেতরে প্রবেশের পর দেখলেন শেখ মুজিব লুঙ্গি ও গেঞ্জি পড়ে মোড়ার উপর বসে আছেন। নুরুলকে দেখে বললেন, “আসো আসো , আমি তো প্রতিদিন মুড়ি খাই , তুমি খাবা?'' এমন জীবনযাপনই করতেন পিতা মুজিব।

এক নেতাকে একবার সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন , “আচ্ছা আপনি মুজিব কোট কেন পড়েন”? সেই নেতা জবাব দিয়েছিলেন, “এটা বঙ্গবন্ধু পড়তেন বলে পড়ি , এটা আদর্শ” । আসলে বঙ্গবন্ধু পড়তেন বলে এটি আদর্শ নয় , আদর্শ ছিলো এই কোট পড়ার পেছনের চিন্তাধারায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক ছাত্র একবার তাজউদ্দিনের সাথে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে গেলেন। ছেলেটা অনেকক্ষন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নেতাকে দেখলো । হুট করে ছেলেটা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করলো, “ আপনার কোটের বোতাম ছয়টা কেনো ? এ ধরনের কোটে বোতাম আরো বেশি থাকার কথা। প্রশ্ন শুনে নেতা ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন । বললেন, “এমন প্রশ্ন আমাকে আগে কেউ করে নাই, তুই প্রথম । এই ছয়টি বোতাম হলো আমার ঘোষিত ছয় দফার প্রতীক। এই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনা , যিনি একটি কোটের মধ্যেও ধারণ করতেন বিশ্বাস, দাবি, ন্যায্যতা।

বঙ্গবন্ধু সেই মহান ব্যাক্তিত্ব যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় কথা বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পক্ষে। ১৯৪৯ সালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ডাকা ধর্মঘটে নেতৃত্বদানের অভিযোগে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো । মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফেরত পাওয়ার অফার পেয়েও তিনি তার নীতি থেকে এক চুলও সরে আসেন নি । এটাই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ।

অনেকের ধারনা টাকা বিনোয়োগ করে একবার ক্ষমতার স্বাদ পেলেই সাত পুরুষের চলার মতো স্বচ্ছলতা হবে। অথচ, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাধারন পরিবারের প্রতিনিধি। তিনি পড়াশুনা ও রাজনীতির আংশিক খরচ এমনকি সিগারেটের পয়সাটাও স্ত্রীর কাছ থেকে নিতেন। তার সহজ সরল জীবনযাপনের কথা সবাই জানে ।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “ আব্বা-আম্মা ছাড়াও সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত । রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলেই আমাকে দিত। কোনদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না।''

টাকার চেয়ে বড় ব্যাপার বঙ্গমাতা তাকে কখনও কোন কিছুতেই বাঁধা দেন নি। একজন বঙ্গবন্ধুর জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে লোভ নয়, টাকা নয় , প্রতিহিংসা নয় কাজ করেছে সরল মন, মানুষের জন্য ভালো করার চেতনা আর আপনজনদের বিশ্বাস।

আরেকটি অসাধারণ গল্প । সময় তা ১৯৭৩ সাল। বঙ্গবন্ধু ভীষন রকম অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন। ডাক্তার বললেন অপারশন ছাড়া গতি নাই। পেটে পাথর হয়েছে। সবাই বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিচ্ছেন বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করতে। বঙ্গবন্ধু বাঁধা দিলেন। তিনি বললেন, “দেশের অর্থ খরচ করে আমি বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাবো না । চিকিৎসা করতে হলে দেশেই করতে হবে। এজন্য যদি আমাকে মরতেও হয় তবুও আমি মরতে রাজি আছি। তবুও রাষ্ট্রের অর্থ খরচ করে আমি বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করতে চাই না।''

এটিই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। অথচ আজকাল!
বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ। তবে কখনো ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেননি তিনি । এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “যার মনের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা, সে হলো বন্য জীবের সমতুল্য। যারা বাংলার গ্রামে-গ্রামে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে, তোমরা তাদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন শুরু করো । ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা সমুন্নত রাখো।''

১৯৫০ সালে তিনি কারাবন্দী ছিলেন ফরিদপুরে । সমাজকর্মী চন্দ্র ঘোষের সাথে এক আলাপচারিতায় তিনি সেসময় বলেছিলেন , “আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।'' এটিই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি যিনি আঁকতেন ।

নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে প্রথম তিনিই ভেবেছিলেন। এক আদেশনামায় তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন “পাবলিক সেক্টরে যে সমস্ত নিয়োগ হবে তাতে ১০ শতাংশ মেয়েদের নিয়োগ থাকবে।'' সেই সময় ১০ শতাংশ মেয়েদের পাবলিক সেক্টরে নিয়োগ এর সিদ্ধান্ত কি পরিমাণ সাহসী কাজ সেটা তখনকার মানুষই ভালো জানেন।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ ! এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে ভেতরে প্রবেশে বাঁধা দিচ্ছিলো। বঙ্গবন্ধু দেখতে পেলেন তাকে। নিজে এসে ডেকে নিয়ে গণভবনের অভ্যন্তরে অনেকক্ষন আলাপ করলেন। বের হওয়ার পর নিরাপত্তা রক্ষীদের বললেন , “আপনারা যারা এই ভদ্রলোককে গণভবনের ভেতরে ঢুকতে বাঁধা দিয়েছেন তারা তাঁর অতীত সম্পর্কে কিছুই জানেন না । পাকিস্তানি পুলিশ যখন আমাকে গ্রেপ্তারের জন্য হন্যে হয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন তিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে আমাকে তাঁর বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। আমি তাঁর কাছে অনেক ঋণী।''

এটিই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ , যিনি উপকারীর উপকারের কথা উদারতার সাথে স্বীকার করতেন। তথাকথিত নেতাদের মতো নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরেরদিন হাওয়া হয়ে যেতেন না তিনি। থাকতেন জনগনকে কাছে নিয়ে , জনগনের কাছাকাছি ।

বঙ্গবন্ধুকে কিছু নরপশুদের জন্য আমরা হারিয়েছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যেনো নিহত না হয় আদর্শ বিক্রেতাদের দ্বারা..।

লেখক : শিক্ষার্থী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত