শরীফ আহমেদ

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ১৫:৩৮

হাকালুকির হাহাকার

হাকালুকি। এই একটি মাত্র শব্দের সঙ্গে যে মিশে আছে কতশত সাতকাহন আর মানুষের জীবন-সংগ্রামের গল্প তার কোনও হিসাব নেই। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই হাওরকে ঘিরে নির্বাহ করেন তাদের জীবন-জীবিকা। এই হাওরের সঙ্গে তাই তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে।

হাকালুকির জলাভূমি এশিয়ার অন্যতম জলজ নিদর্শন। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ৫টি উপজেলায় বিস্তৃত এই হাকালুকি ছোট-বড় প্রায় ২৩৮টিরও বেশি বিল ও ছোট-বড় ১০টি নদী নিয়ে গঠিত, বর্ষাকালে যার আয়তন প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত হয়। এই হাওরে বাংলাদেশের মোট জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকেরও বেশি এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটাপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, হাকালুকি হাওর পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নের জন্য একটি অমিত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।

এ হাওর বছরের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। শীত মৌসুমে হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বিলের কান্দিগুলো সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। বিলের জলের মাঝে ও চারিধারে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিত উঁচুভূমি বিলের জলে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্য। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওরের জলরাশির মাঝে সূর্যের প্রতিচ্ছবি সত্যই দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর। শীতকালে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে সমৃদ্ধ করে বিভিন্ন ধরনের অতিথি পাখি।

হাওরের অনিন্দ্যসুন্দর এই প্রাকৃতিক রূপের বাইরে আছে একটি মনুষ্যসৃষ্ট বীভৎস ও কুৎসিত দৃশ্যপট। গেল বেশ কয়েক দশক থেকে এ হাওরকে ঘিরে চলছে প্রভাবশালী অসৎ চক্রের তৎপরতা। ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে হাকালুকি হাওরের ৮টি মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরি নিয়ে। শীত মৌসুমে অভয়াশ্রম তৈরির কথা থাকলেও এখনও কাজ শুরুর কোনও প্রক্রিয়া নেই।

জানা গেছে, ২৩৮টি বিলসম্পন্ন হাকালুকি হাওরে ১৮টি মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরির অনুমোদন দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৮টি অভয়াশ্রম তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়। ৮টি অভয়াশ্রমের মধ্যে গৌরাঙ্গ বিল, মালাম বিল ও কাংলি গোবরকুড়ি বিলের অভয়াশ্রম তৈরির দায়িত্ব বর্তায় উপজেলা পরিষদের অন্তর্ভুক্ত মৎস্য বিভাগের ওপর। প্রতিটি অভয়াশ্রম তৈরির জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত হয় ৬৭ লাখ টাকারও বেশি।

খবর নিয়ে জানা গেছে, অভয়াশ্রম তৈরির জন্য বিল খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ঢিমেতালে মাটি খননের ফলে খনন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়েছে বারবার। যতটুকু বিল খননের কথা ছিল ততটুকু সম্ভব হয়নি। বড়লেখা উপজেলার অধীন মালাম বিলে ৬০ শতাংশ এবং জুড়ী উপজেলার অধীন গৌরাঙ্গ বিলে ৩৫ শতাংশ কাজ হয়েছে বলে একটি সূত্র দাবি করছে। কুলাউড়া উপজেলার অধীন কাংলি গোবরকুড়ি বিলে অভয়াশ্রম নির্মাণের কথা থাকলেও এখানে কোনও কাজ হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

তাছাড়া হাকালুকির বিভিন্ন বিলে আসা অতিথি পাখিদের বিষটোপ দিয়ে নির্বিচারে চলে পাখি শিকার। এসব দেখার যেন কেউ নেই! যাদের দেখার কথা সেই প্রশাসন নির্বিকার। একশ্রেণীর অসাধু পাখি শিকারি ও প্রভাবশালী ব্যক্তির ছিটানো বিষটোপ আর পাতানো ফাঁদে ধরা পড়ছে হাজার হাজার অতিথি পাখি। ফলে প্রতিবছরই অতিথি পাখির সমাগম কমছে। বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির দেশী-বিদেশী পাখিও।

হাকালুকি হাওরকে সরকার ১৯৯৯ সালে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ২০০৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের অধীনে উপকূলীয় ও জলাভূমি জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের (সিডব্লিউবিএমপি) আওতায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে সমাজভিত্তিক জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় আরও ৬ কোটি টাকার প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়। ২০০৪ সাল থেকে এ প্রকল্পের অধীনে হাওরের উন্নয়ন কাজ শুরু হয়। বিগত ৬ বছরে এ প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও হাওর নিয়ে স্থানীয় জনমনে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে তাদের প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কুলাউড়া অফিসের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

হাকালুকির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। অরক্ষিত হয়ে পড়েছে মিঠা পানির বৃহৎ এই মৎস্য ভাণ্ডারটি। হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, প্রকল্প অব্যাহত থাকলে তা আরও উপকৃত হবে। তবে হাওরের প্রকল্পের নামে কিছু এনজিও শুধুই লোক দেখানো কাজ করছে। তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিল সেচ করে প্রতিবছর মাছ ধরার প্রক্রিয়ায় গত ২০ বছরে হাকালুকি হাওর থেকে ২৬ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ অবস্থায় এ হাওরে অন্তত ২৫টি মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরির দাবি উঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে।হাওরপাড়ের স্থানীয় বাসিন্দাদের জোর দাবি, হাকালুকি হাওর যাতে সরকারের বরাদ্দের অভাবে বিলীন হয়ে না পড়ে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

  • লেখক: সাংবাদিক। ইমেইল: [email protected]
  • এইবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত