জান্নাতি নাঈম

১৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০১:০৯

মেয়েদের অবমূল্যায়নের আইন- সান্ধ্যআইন

সান্ধ্যআইন নামে একটি কালো আইন রয়েছে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এই আইনটি কেবল ছাত্রীদের জন্য। সন্ধ্যার পর ছাত্রীদের বদ্ধ করে রাখার আইন।

খুব আক্ষেপ হয় যখন দেখি, আমাদের মধ্যকার প্রগতিশীল মানুষগুলো (নর ও নারী) সান্ধ্যকালীন আইনের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেন-

১। নারীরা, নারী-পুরুষের সমান অধিকার বলতে বুঝায় রাতে বাইরে থাকা!
২। মেয়েদের উপর নিরাপত্তার জন্য এ আইন!
৩। এ আইন না থাকলে মেয়েরা বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হতে পারে!
৪। সান্ধ্যকালীন আইন না থাকলে, মেয়েরা হলে যাবে না।ক্যম্পাসে কুকর্ম করে বেড়াবে! ইত্যাদি।

তাদের জন্য কিছু কথা- প্রথমত, নারীর সান্ধ্যকালীন আইনের বিরোধীতা মানেই শুধু সারারাত বাইরে পরে থাকার জন্য না। মেয়েদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা, বুদ্ধিমত্তা আছে। নারীও পুরুষের মতো জানে, কখন কোথায় কিভাবে যেতে হবে,কীভাবে যেতে হয়। তারা নিজের সম্পর্কে সচেতন, নিজের পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কেও সচেতন। তবে দুর্ঘটনা যেমন নারীর সাথে ঘটতে পারে, একই ভাবে পুরুষের সাথেও ঘটতে পারে।

সান্ধ্যকালীন আইনের মাধ্যমে নারীর বিবেচনা বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করা হয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীকে, হলে ঢোকার সময় সম্পর্কে প্রশাসনের সজাগ করে দিতে হয় না। নিজের বিবেচনা-বুদ্ধি একটু কাজে লাগিয়ে নিজেই ঠিক করে নিতে পারে।

তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীরা কোন কোটা নিয়ে আসেনি, নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে মেধার লড়াইয়ে জিতে এসেছে। এখানে হলে প্রবেশ করার সময়টা নিজ বিবেচনায় ঠিক করার মতো বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান প্রতিটি নারী ধারণ করে। আর যদি কারোর এতটুকু সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার মতো সাহস, জ্ঞান না থাকে, তবে সত্যিকার অর্থে তারা তাদের নিজের মেরুদন্ড সম্পর্কে নিজেই অজ্ঞাত।

সান্ধ্যকালীন আইন মেয়েদের বিভিন্ন দুর্ঘটনা এড়ানোর কোন পদক্ষেপ হতে পারে না।কারণ, অপরাধী অপরাধ করার সময় দেখে সে কতটুকু নিরাপদ, আশে-পাশের পরিবেশ নিরব নাকি জনাকীর্ণ, অপরাধ সমাধান করে গা ঢাকা দিতে তার অসুবিধা হবে কিনা। নীরব জায়গায় দিনের বেলায়ও অসংখ্য ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন এমনকি ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটেছে।

উদাহরণ হিসেবে তনু হত্যার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন।
মেয়েরা যখন ৯ টার মধ্যে হলে ঢুকতে বাধ্য থাকবে এবং প্রয়োজন সাপেক্ষে কোন মেয়ে ৯ টার পর হল থেকে বের হবে।
তখন নির্জন ক্যাম্পাসে ঐ মেয়েটির শারীরিক ,মানসিক নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নিবে? জনহীন ক্যাম্পাসে মেয়েটির নিরাপত্তা কে নিশ্চিত করবে?
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে টং এ চা খাওয়ার স্বাধীনতার কথা, রাতে এক কিলোতে হাঁটা, আড্ডার স্বাধীনতার কথা বাদ দিলাম, নিজের সব প্রয়োজনীয় কাজের জন্য একটা মেয়েকে সব সময় ছেলে বন্ধুর উপর নির্ভর করতে হবে? নিজের কাজের দরকারে কতবার একটা মেয়ে অন্যদের উপর নির্ভর করবে? আর কেনই সে তা করবে?

আর যদি বলেন, নারী তার সব প্রয়োজনীয় কাজ ৯ টার মধ্যে শেষ করতে হবে। তাহলে একটা মেয়ে বারবার ঘড়ি দেখার চিন্তা মাথায় নিয়ে কেন সংগঠনের জন্য খেটে যাবে, ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রামে পারফর্ম করতে যাবে, টিউশনিটা করে যাবে নিজের প্রয়োজনে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই। মেয়েদের রাতের বেলা জ্বর, মাথা-ব্যথা, পেট ব্যথা না হওয়ার নিয়ম করে দিক প্রশাসন। রাতের বেলা ওষুধ আনার জন্যেও মেয়েরা হলের বাইরে বের হবে না। প্রশাসনিক আইন থাকতে পারে, একটি মেয়ে শিক্ষার্থীর রক্তের গ্রুপ কোন দুর্লভ গ্রুপ, যেমন, এ-, বি-, ও- হতে পারবে না! আর যদিও হয়, বিশেষ প্রয়োজনে (কোন রোগী মৃত্যুশয্যায় থাকলেও) দুর্লভ রক্তের গ্রুপধারি কোন নারী রাত ৯ টার পর রক্তদান করতে পারবেনা! তৃতীয়ত, যারা বলছেন মেয়েরা ক্যম্পাসে কুকর্ম (অবাধ প্রেম, অন্য কিছু)করে বেড়াবে, তারা নিশ্চয়ই বলবেন না যেসব মেয়ে কুকর্ম করে, তাদের সাথে কোন ছেলে থাকে না। সেখানে অবশ্যই ছেলে-মেয়ে সমান দোষী। শুধু মেয়েদের উপর কেন আপনাদের নষ্ট চোখ থাকে।

আপনারা কি বলবেন, ছেলেদের হলে সান্ধ্যকালীন আইন নেই বলে সকল ছেলে কুকর্মের সঙ্গে জড়িত? তাহলে, মেয়েদের হলে সান্ধ্যকালীন আইন না থাকলে, সকল মেয়ে যাচ্ছে তাই করে বেড়াবে এটা কিসের ভিত্তিতে বলেন?

এটা বলার মাধ্যমে আপনি কি মেয়েদের ব্যক্তিত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন না?

আর যেসব মেয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান, তারা পারিপার্শ্বিকতার আদলে গড়ে উঠা নারী মূর্তি রয়ে গেছেন। এখনও মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি।

কিছু ছেলেরা বলছেন, মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য "সান্ধ্যআইন"।
তাদের কাছে প্রশ্ন, এই "নিরাপত্তা" কিসের নিরাপত্তা? ছিনতাই? ঈভটিজিং? গুম? খুন? ধর্ষণ? কোনটি?
 
অথচ ধর্ষণ ব্যতীত বাকি সবগুলো ক্রাইম ছেলেদের সাথেও ঘটে। আর ধর্ষণ সন্ধ্যাবেলা এমনকি দিনের বেলায়ও ঘটে। এছাড়া যারা স্বেচ্ছায় অনৈতিক কাজকর্মে লিপ্ত থাকে, সান্ধ্যকালীন আইনের মাধ্যমে তাদের প্রতিহত করা কখনও সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না।

ছিনতাই, হত্যা এসব ঘটনা বন্ধ করার জন্য সান্ধ্যকালীন আইন কোন পদক্ষেপ না।
আর এসব ছিনতাই,সন্ত্রাসবাদী ঘটনা বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ নেওয়া আপনারা অসম্ভব মনে করেন?যদি করেন, আমি মনে করি অবশ্যই এসব বন্ধ করা সম্ভব।

একটি ছেলে কেন অন্য একটি ছেলের নিকট বৈষম্যের শিকার?

আমার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকতে চাওয়া খুব কি বেশি কিছু?

একটা ভাস্কর্য কেন অর্ধনির্মিত অবস্থায় পড়ে থাকে বছরের পর বছর, নিজের বিবেককে প্রশ্ন করেছেন কখনও?

একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কোন অপরাধীর নয়, এখানে পুলিশ ব্যারাক নির্মাণ অবান্তর। মনে এ প্রশ্নটা এসেছে কখনো?

সান্ধ্যকালীন আইন ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না।

অবান্তর যুক্তিতে আমাকে বা নারীকে প্রতিপক্ষ না ভেবে, একজন স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে, আপনি নিজে কতটুকু অধিকার, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ভোগ করতে পারছেন,রঙিন চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে দেখার অনুরোধ রইল।

সবশেষে একটা প্রবাদ বাক্য বলার প্রয়োজন মনে করছি, "ভ্রমরটাকে রুখতে গিয়ে দ্বার বন্ধ রাখি, সত্য বলে আমি এখন কোথা দিয়ে ঢুকি"।

একেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একেকটা মিনি বাংলাদেশ। এটা জ্ঞান সৃষ্টির জায়গা। এখানে পারিপার্শ্বিকতার কথা বলে, সমাজের উপর দায়ভার না দিয়ে কিভাবে সমাজ, পারিপার্শ্বিকতার পুন:নির্মাণ করা যায়, সেটার দিকে নজর রাখা উচিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, শাবিপ্রবি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত