ইয়াসির সরকার

০৬ মার্চ, ২০১৮ ১৪:২৯

জাফর ইকবাল এবং সাম্প্রতিক সাস্টিয়ানের ইতিহাস



শিরোনামে জাফর ইকবাল সাহেবের নামটা জুড়ে দিলেও আমি লেখাটা আরম্ভ করছি আমার পরিচয় দিয়ে। আমি তথাকথিত সাস্টিয়ান, ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর এই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট-এ ভর্তি হওয়ার সুবাদে নিজের অসংখ্য পরিচয়ের সাথে সাস্টিয়ান পরিচয়টাও সংযুক্ত হয়েছে।

১ জানুয়ারি, ২০১৩, নবীনবরণ, মুক্তমঞ্চঃ

অন্য-মনষ্ক ছিলাম। নরম কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের কথা কেউ বলছিলেন মুক্তমঞ্চে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শোনার মাঝে আশেপাশের আমার মত সদ্য সাস্টিয়ান একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। প্রফেসর সালেহ উদ্দিনের বক্তব্যের পর অথবা আগেই হয়ত, জাফর ইকবাল সাহেব উঠেছিলেন। স্বভাবতই ‘দস্যি ক’জন’, ‘শান্তা পরিবার’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ আর ‘সুহানের স্বপ্ন’ এর লেখক বক্তৃতা দিচ্ছেন, তিনি পেলেন আমার সমস্ত মনোযোগ। অনেক কথা বললেন, এ বিশ্ববিদ্যালয় কৃষক-শ্রমিকের ঘামে ভেজা টাকায় চলে, তোমাদের এদেশের প্রতি দায় আছে, ভুলে যেও না ইত্যাদি। তখন তো সাস্টিয়ান হওয়ার একদিনও পূর্ণহয়নি, তাই খুব চমক লেগেছিল। মনে হয়েছিল দেশটার প্রতি একটা দায়িত্ব আছে, দেশের জন্য কিছু করতে হবে। কৃষক-শ্রমিকের ঘাম আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মিশেলে সে বক্তৃতা মনে দাগ কেটেছিল। মুক্তিযুদ্ধ যে ১৯৭১ সালের একটা ঘটনা নয়, সেটাকে যে বয়ে বেড়াতে হয়, ধারণ করতে হয়, এ ধরনের কিছু উল্টাপাল্টা অবাস্তব ভাবনাও কাজ করছিল। এগুলো ভেবে যখন আলোড়িত হচ্ছি, ঠিক তখনই লোকটা চোখ বড়বড় করে গোলচত্বরের দিকে আঙুল তুলে সবাইকে বললেন, “ঐ যে গোলচত্বর দেখছ, এই স্বাধীনতা দিবসে ঐখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যটা স্থাপন করা হবে।”

সিলেটের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা এটা মেনে নিতে পারল না। সিলেটের পবিত্র মাটিতে মূর্তি স্থাপন করা যাবে না। তুমুল আন্দোলন। নবীন সাস্টিয়ান, প্রতিবাদে কিলো রোডে নেমে গেলাম। সে সময় স্লোগান দিতে গিয়ে জানতে পারলাম, “পারে পারে সবই পারে, সাস্টিয়ান সবই পারে।” আমি যে সাস্টিয়ান, আমি যে সবই পারি, সে অনুভূতি যে কি মাদকতাময়! গলা ফুলিয়ে সাস্ট ক্যাম্পাসে স্লোগান দিতে লেগে গেলাম।

এর মাঝেই গণজাগরণ মঞ্চে রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন। যে কোন সময় হামলা হবে এই ভয়ের মাঝে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন, সাস্টিয়ান হওয়ার এত উত্তেজনা আমাকে আচ্ছন্ন করল। “সাস্টিয়ান সবই পারে,” এই স্লোগান দিতে দিতে কখন উপাচার্য পরিবর্তন হয়ে নতুন উপাচার্য আসলো আর গোলচত্বরের বেদি শূন্য পড়ে রইল, সেটা টেরই পেলাম না। ভাস্কর্য নিয়ে নানা কথা শুনলাম। ভাস্কর্য আসলে মূর্তি, মূর্তি নিষিদ্ধ, তার উপর ভাস্কর্যটা (নাকি মূর্তিটা!) আসলে জাহানারা ইমামের, সে নাকি নাস্তিক, রুমি যতই মুক্তিযোদ্ধা হোক, নাস্তিকের মূর্তি এ পাক-পবিত্র মাটিতে হতে পারে না। এরই ফাঁকে কারা এসে বলার চেষ্টা করল জাহানারা ইমাম নাকি ১৯৯২সালে প্রথমবারের মতন রাজাকারের শাস্তি দাবি করেছেন, গণআন্দোলন করেছেন, গণআদালত করে রাজাকারদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করে প্রতীকী শাস্তি দিয়েছেন। তিনি নাকি নাস্তিকও নন, ইত্যাদি। আমি কোন গুঁজবে কান দিলাম না, আমি সাস্টিয়ান, আমি গুঁজবে কান দেই না।

তারপর আমরা টাকা পয়সা জোগাড় করে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা পথ-চিত্র এঁকে ফেললাম। আবারো সমস্ত ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে স্লোগান দিলাম “পারে পারে সবই পারে, সাস্টিয়ান সবই পারে”।

এর মধ্যেই কয়জন শিক্ষক আর শিক্ষার্থী নিয়ে জাফর ইকবাল বলে বসলেন আমরা চাইলেই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা একদিনেই সেরে ফেলতে পারি। সাস্টিয়ান হিসেবে আমরা আবার স্লোগান দিলাম। এর মধ্যেই সিলেট-বাসী আবার রাজপথ ধরল, সিলেট বিরোধী এ প্রক্রিয়া চলতে দেয়া যায় না। বৈষম্য দূর করতে তারা লেগে গেলেন। নতুন উপাচার্যের কার্যালয়ে চকচকে গাড়িতে কারা আসলো, এসে সভা করল। উপাচার্য পদের লোকটা হাসিমুখে ঘোষণা দিলেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিল।
জাফর ইকবাল ও তার বৌ ইয়াসমিন হক নাটকীয়ভাবে পদত্যাগ করলেন। সাস্টিয়ান হিসেবে আমি আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় নামলাম। “জাফর স্যারের পদত্যাগ মানি না, মানবো না”। “সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা পুনরায় বহাল করো।”

জাফর ইকবাল আর ইয়াসমিন হক পদত্যাগপত্র ফেরত নিলেন, উপাচার্য পদের নতুন লোকটাহাসিমুখে বললেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হবে। তখন আমি ও আমরা, সকল সাস্টিয়ান আবার স্লোগান দিলাম- “পারে পারে সবই পারে, সাস্টিয়ান সবই পারে।“

তখন যদি জানতাম এই হাসিমুখের লোকটার সময়েই ভর্তিপরীক্ষা দূরে থাক, ভর্তি ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে আবার “সাস্টিয়ান এক হও” স্লোগানে রাস্তায় নামতে হবে।

এর মধ্যে সাস্টিয়ান হিসেবে আমি বেশ কিছু বিষয় বুঝে ফেলেছি। গোলচত্বরের এইশূন্য বেদি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জার জন্যে দারুণ কাজে দেয়, বাহির থেকে জাফর ইকবালকে যত ভালই দেখাক সে যত অপকর্ম করেছেন, তার হিসেব করে শেষ করা যাবে না। প্রথম প্রথম আমাদের কৌতূহল হতো, আমরা জানতে চাইতাম সে অপকর্ম কী, কার কাছে জানা যাবে। দ্রুতই জেনে গেলাম সবই শিক্ষক রাজনীতি, এগুলো এত নোংরাযে আসলে কেউই ঠিক মত কিছু জানে না। আমরা সাস্টিয়ানরা সতর্ক হলাম। জাফর ইকবাল আর ইয়াসমিন হকের সাথে সকল উৎসবে সেলফি তুললাম আর সুশিক্ষিতের মত জানলাম, ভাল মন্দ মিলিয়েই মানুষ।

আমরা যখন এইসব শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছি ঠিক তখনই শিক্ষকরা নাটক ফেঁদে বসল। উপাচার্যের মতন সম্মানিত পদে আসীন হাসিমুখী লোকটার সামনে প্যান্ডেল টানিয়ে তার পদত্যাগ দাবি করতে বসে পড়লেন। আমরা ভাবলাম পিকনিক। কেউ কেউ ভাবলাম শিক্ষকদের ক্ষমতার লড়াই।

এরা আন্দোলন করে, আবার আন্দোলনের মাঝে উঠে এসে ক্লাস পরীক্ষাও নেয়। আমরা বিরক্ত হই, আন্দোলনের মাঝে আবার ক্লাস পরীক্ষা কেন? এমন আন্দোলন কে কোথায় দেখেছে? ক্লাস পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে আমরা শিক্ষকদের প্যান্ডেল টানিয়ে পিকনিক করতে দেখি।

আমার পরিচয় পর্ব বোধ করি বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, সংক্ষেপ করি। একদিন আন্দোলনরত শিক্ষকরা রটালো তাদের উপর হামলা হয়েছে। ছাত্রলীগের ছেলেরাই নাকি আক্রমণ করেছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেল উপাচার্য পদে আসীন লোকটা ইউনুস নামের একজন শিক্ষকের কলার ধরে টানছে।

আমরা আবার পথে নামলাম। যেহেতু ব্যাপারটাতে শিক্ষকরা জড়িত, সম্মানের পাত্র, আমরা সেব্যাপারে নাক গলাবো না বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা ছাত্রলীগের যারা আক্রমণ করেছে শিক্ষকদের উপর, তাদের বিচার চাইতে পথে বসলাম। যদিও এ ব্যাপারে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, আন্দোলনের স্লোগানে ছাত্রলীগ শব্দটা উচ্চারণ করা যাবে না, আমরা দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি চাইব। এর মধ্যে জাফর ইকবাল সাহেব আমাদের মেহনতের দিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ এই ছাত্রলীগের ছেলেদের শাস্তি দেয়াটা একধরনের অন্যায়, যে তাদের পাঠিয়েছে তাদের শাস্তিদিন।”

আমরা আসমান থেকে পড়লাম, বলেন কী এই ভদ্রলোক। আমরা স্বভাবতই আবার বুঝতে পারলাম এই লোক ধুরন্ধর, গা বাঁচিয়ে চলে। আমরাও গা বাঁচিয়ে উঠে আসলাম।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, উপাচার্য পদে আসীন এই লোকটার শাসনামলে প্রশাসনের কাছে আমাদের অনেক দাবিদাওয়া নিয়ে শাবি ক্যাম্পাস আমরা স্লোগান মুখর করে রেখেছিলাম। এমনকি উপাচার্য মহোদয়কে একরাত তার অফিসে আটকেও রেখেছিলাম। বললামই “সাস্টিয়ান সবই পারে”। যদিও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অসন্তোষ সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের লালবাতি জ্বালিয়ে তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আরো একমাস পর তিনি ভিসি ভবন ত্যাগ করেন।



অতএব আমি সাস্টিয়ান। ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর যে আন্দোলনগুলো দেখেছি, অংশ নিয়েছি তার মধ্যে যেগুলো সফল হয়েছে তার তালিকা:

১/ জাফর ইকবাল, ইয়াসমিন হক—অন্যান্য শিক্ষকদের পদত্যাগ প্রত্যাহার
২/ ভর্তি পরীক্ষার ফর্মের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার

এবার ব্যর্থ আন্দোলনের তালিকা:

১/ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য—গোলচত্বরের শূন্য বেদি
২/ সমন্বিত ভর্তি—ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য
৩/ পোষ্যকোটা বিরোধী আন্দোলন—শিক্ষক-কর্মচারীদের সন্তানরা কোটা পাবে না তো আমি পাব?
৪/ যৌন নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন—শিক্ষক ছুটিতে
৫/ কিলোরোডে গাড়ি চাপা দিয়ে পথচারী হত্যা—ঘটনার ফলাফল সকলের জানা
৬/ ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি—তদন্ত চলছে হয়ত এখনো, জানেন নাকি কিছু?



গত পাঁচ বছরে শাবিপ্রবির ইতিহাসটা মোটেও সুখকর, সম্মানজনক ও গৌরবের কিছু নয়। যেহেতু এ বিশ্ববিদ্যালয়টা আমাদের, আমাদের জন্য, সেহেতু এর ইতিহাসটা আমরাই তৈরি করছি। আমার এ দীর্ঘ লেখা পড়ে এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনেকেই ভ্রু কুঁচকে রাগান্বিত হয়ে ভাবছেন- “আমরাই কি মুসলেহ উদ্দিনের মত উপাচার্যকে বিতাড়িত করি নি?”
হ্যাঁ, শাবিপ্রবির তের-চৌদ্দবছর পুরাতন ইতিহাসটা সুন্দর, কেননা সে সময়কার ছাত্ররা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ে নি। কিন্তু সুদূর অতীত আঁকড়ে কতদিন?



৩ মার্চ, ২০১৮
মুক্তমঞ্চ, শাবিপ্রবি

যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে জাফর ইকবাল ২০১৩ তে বলেছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যটা হবে, ঠিক সেই মঞ্চেই এক স্থানীয় যুবক তাঁর ঘাড়ে, মাথায় ছুরি মেরে দিল। তাকে হাসপাতালে নেয়া হলো। সাস্টিয়ানদের একদল ছুটল হাসপাতালে, আরেকদল আততায়ীকে উত্তমমধ্যম দিয়ে সত্যেন বোস শিক্ষা ভবন ঘিরে রাখল (যারা জানে না সত্যেন বোস কোন ভবনের নাম, তাদের জন্য করুণা)। সত্যেন বোস ভবন ঘিরে রাখা সাস্টিয়ানরা প্রচণ্ড আবেগী। তারা পারলে আততায়ীকে হত্যা করে। তাদের প্রাণপ্রিয় জাফর ইকবালকে যে আঘাত করতে পারে, তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। রীতিমত রাজকীয় পাহারায় আততায়ীকে সত্যেন বোস ভবন থেকে উদ্ধারকরতে বাধ্য হয় পুলিশ।

রাত ১০টা নাগাদ সমস্ত বাংলাদেশ জানে জাফর ইকবাল বেঁচে গেছেন এই যাত্রায়।



৪ মার্চ, ২০১৮
শাবিপ্রবি, সিলেট

এ ন্যক্কারজনক আক্রমণের দাবিতে সাস্টিয়ানরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে সারাদিন মিছিল করল। সকলেই ন্যায় বিচার চায়।

মধ্য দুপুর। মিছিলে সে কি শিক্ষার্থীদের জোয়ার! মূল ফটকে গিয়ে মিছিল সমাপ্ত হতেই ক’জন শিক্ষার্থীর মনে হলো, শাবিপ্রবির ৩২০ একর তো আমাদের আশ্রয়স্থল, আবাসতুল্য। এখানে প্রতিবাদ মিছিল করলেই প্রতিবাদ সম্পূর্ণ হয়ে গেল? ঘরে বসে প্রতিবাদ হয়? তাদের কী বোধ হলো, তারা ভাবতে লাগল। তারা ভাবল, যেহেতু মৌলবাদীরা বারবার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ থেকেই আঘাত হানছে, অতএব প্রতিবাদটা তাদের পর্যন্ত পৌঁছানোটা দরকার। এই জনপদের সকলকে জানানো দরকার শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা মৌলবাদের বিরুদ্ধে চুপ করে থাকবে না। যে শহরে জাফর ইকবাল স্বাধীনভাবে হাঁটতে পারেন না, সে শহরে মিছিল করে বলা দরকার জাফর ইকবালরা মরে না, শাবিপ্রবিতে প্রতিনিয়ত জাফর ইকবালরা জন্ম নিচ্ছে।

এরা যখন ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করে কিছু সাস্টিয়ানদের বলার চেষ্টা করল যে চলো শহরের রাজপথে প্রতিবাদ করি, তারা বলল- “হ্যাঁ, আমরা সম্পূর্ণ একমত, শহরেও প্রতিবাদ করা দরকার, কিন্তু নিরাপত্তা দিবে কে? নেতৃত্ব দিবে কে?”

বোঝানোর চেষ্টা করা হলো সকলেই ছাত্র, সাধারণ শিক্ষার্থী, এখানে নেতৃত্বের প্রয়োজন নেই। প্রতিবাদ নিরাপত্তার বলয়ে হয় না।
তারা আবার বলল—“হ্যাঁ, বুঝলাম, আমরা একমত, কিন্তু আক্রমণ হলে কে দায়ভার নিবে?”

যখন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নেতৃত্বের ভার নিলো, পুলিশি পাহাড়ার ব্যবস্থাহলো তখন তারা আবার বলল—“সবই ঠিক আছে, কিন্তু মৌলবাদ, জঙ্গি, এসব স্লোগান দেয়া যাবে না। তদন্তের আগে আমরা কী করে বলি আততায়ীর আসল পরিচয় কী?”

শেষ পর্যন্ত মিছিল প্রতিবাদ হলো। গোলচত্বর থেকে যে জন বিশ-ত্রিশ যাত্রাকরল, সে মিছিল চৌহাট্টা পৌঁছল কয়েক‘শ শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীর মৌলবাদ বিরোধী স্লোগানে সিলেটের রাজপথ মুখরিত করতে করতে।

আমি জানি, এটা অনেকের কাছেই ছোট্ট একটা ঘটনা। কিন্তু আমি ও আমরা, যারা আজ সিলেটের রাজপথে, যে রাজপথে জাফর ইকবাল হাঁটতে পারেন না, সে রাজপথে মৌলবাদকে সরাসরি মৌলবাদ বলার সাহস করেছি, বলতে পেরেছি ‘মৌলবাদের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না,’ যারা বুকের সমস্ত জোর দিয়ে স্লোগান দিয়েছি-”পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, জাফর স্যারের ঠিকানা,” তারা অনুভব করতে পারছি— ‘মৌলবাদের এক জবাব, প্রতিরোধ-প্রতিবাদ।” আমরা মনের ভেতর ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, কথায় নয় কাজে পরিচয়। আমরা, শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা, বুকের ভেতর সাহস পাচ্ছি সমস্যার মূল উৎসে আঙুল তুলবার। আমাদের সে পুরাতন স্মৃতি জেগে উঠছে, আমরা বুঝতে পারছি সকলে এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে মৌলবাদীরা আমাদের আশ্রয়স্থলেও আমাদের নিরাপদ থাকতে দিবে না। আমরা বুঝতে পারছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরের শূন্য বেদি, শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নামে শোভিত ছাত্রীহলের শূন্য নাম ফলক, শিক্ষাভবনগুলোর প্রবেশ পথে A-B-C-D-E ইংরেজি বর্ণমালার সাথে মৌলবাদের একটা সরাসরি যোগসাজশ আছে, কোথায় যেন এদের সবার বিরুদ্ধে একলা একটা মানুষ জাফর ইকবালের নিরলস সংগ্রাম চলছে।

আমরা বুঝতে পারছি, শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের জন্য এটা একটা সূচনা। নিরাপত্তার বলয় ছেড়ে, সকল কিন্তু উপেক্ষা করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মুক্তির পক্ষে, সকল প্রতিকূলতায় আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে রাজপথে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এ জনপদের প্রতিটি কোণে। আমরা বুঝতে পারছি—“পারে পারে সবই পারে, সাস্টিয়ান সবই পারে” নয়, আমাদের নতুন মূলমন্ত্র—

“শাবিপ্রবির ছাত্রসমাজ, এক হও, এক হও!”


আপনার মন্তব্য

আলোচিত