রাশিদা আক্তার

১০ এপ্রিল, ২০১৮ ০১:৩১

নারীর শরীর, ‘অপবিত্রতা’ এবং একজন বিউটির মৃত্যু

হবিগঞ্জের বিউটির মৃত্যুর খবর প্রচার হওয়ার পর দেশ শুদ্ধ মানুষের সমস্ত রাগ গিয়ে পরল একজন যুবক/প্রেমিক/ ধর্ষকের উপর। যা স্বাভাবিকভাবে ঘটে থাকে। ধীরে ধীরে কেচু খুঁড়তে গিয়ে বেড়িয়ে এল বিষাক্ত সাপেরা। যে সাপের বাসা এই সমাজ। কিন্তু কি সেই অদৃশ্য বিষ যার জন্য বিউটিকে জীবন দিতে হল? এই লেখায় বিউটি আমার কাছে একটি মেয়ে নয়, একটি প্রতীক। বিউটি একটি অপবিত্রতার প্রতীক নানা ভাবে।

ছোটবেলা থেকে শোনে আসছি একজন মেয়ে/নারী কবরস্থানে যেতে পারবে না; যদিও যায় তাকে মাসিক হয়নি সেটা নিশ্চিত হয়ে যেতে হবে। যৌন কর্মের পর একজন নারী গোসল না করে ঘরের কোন জিনিষ স্পর্শ করবে না; এ যেন অলিখিত সংবিধান। এসব বিষয়গুলো শুধু পরিচ্ছন্নতার সাথে যুক্ত থাকলে লেখার প্রয়োজন হত না। কিন্তু এই সব ধারনার পেছনে যে অদৃশ্য বিষাক্ত ভাবনা জড়িত তা হচ্ছে অপবিত্রতা। নারীর শরীর অপবিত্র। এই বোধ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে আমাদের সমাজে যখন বিবাহিত সম্পর্কের বাইরে কেউ যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে যায় অথবা জোরপূর্বক ধর্ষিত হয়। তখন এই শরীরটি এতটাই অপবিত্র হয় যে এটাকে সমাজও ধারণ করতে পারে না। যার ফলে, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়া হয়, আত্মহত্যার পথ বেছে নেন অনেকে, অথবা মরতে হয় প্রিয়জনদের হাতে বিউটির মত। এই অপবিত্রতা বোধ মিশে রয়েছে আমাদের চিন্তার গভীরে। একে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না; নীরব ঘাতকের মতো কাজ করে। এই বোধের কাছে পরাজিত মায়া, মমতা, দায়িত্ব এবং বেঁচে থাকার সাধ।

বিউটিকে জীবন দিতে হয়েছে এই অপবিত্রতা বোধের কাছে। বিউটি ভালবাসত তার প্রেমিককে। এই ভালোবাসা বিয়ের চুক্তিতে পরিণত হওয়ার আগেই যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে যায় বিউটি। বিউটি অপবিত্র তাই পরিবার সেটা মেনে নিতে পারেনি। নিজের বাবা, চাচার হাতে খুন হতে হয় তাকে। বাংলাদেশের নারী নির্যাতন আইনের যে ফাঁকফোকর রয়েছে তাও সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে বিউটির পরিবার। আমি কিছুদিন বাল্যবিবাহ নিয়ে একটি গবেষণা কাজে যুক্ত ছিলাম। তখন অনেক আইনজীবীর সাথে আলোচনার সুযোগ হয়েছিল যারা নারী নির্যাতনের সাথে সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে কাজ করেন। অনেকেই বলেছিলেন নারী নির্যাতনের ঘটনা, এমনকি ধর্ষণের মত ঘটনা মিথ্যা সাজিয়ে নিয়ে অনেকে নারী নির্যাতন আইনকে নিজের স্বার্থোদ্ধারের কাজে ব্যাবহার করে থাকেন।

বিউটির ঘটনাটি যদি মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবি, তবে প্রশ্ন আসে এটাকে ধর্ষণের ঘটনা বলা যায় কিনা? বিউটি এবং তার প্রেমিক; পরিণত বয়সি দুজন নর-নারী কিছুদিন এক সাথে ছিলেন এবং স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। এটাতে বড়জোর দুজনের শাস্তি হতে পারত কারণ আমাদের সমাজে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু বিউটিকে মরতে হল কেন? কারণ আমাদের মস্তিষ্কে ছেয়ে আছে বিউটির অপবিত্রতা; যা বয়ে এনেছে পরিবারের জন্য লজ্জা, অসম্মান। বিউটির মৃত্যুর জন্য দায়ী বিউটির শরীরের অপবিত্রতা আর এ সমাজের অপবিত্র চিন্তা। অপবিত্র চিন্তা মুক্তির চাইতে চুক্তিকে বড় করে ভাবে; জীবনের চাইতে সমাজকে।
লেখক: গবেষক, আইসিডিডিআর, বি

আপনার মন্তব্য

আলোচিত