গাণ্ডীব জ্ঞানাঙ্কুর

১৩ এপ্রিল, ২০১৮ ২৩:১৪

কোটা এবং সমতা ও সমদর্শিতা

বাংলাদেশ কি এখন এমন কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, কোটা ব্যবস্থার আর কোন প্রয়োজন নেই? উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার সাথে সাথে কীভাবে এত দ্রুত আর্থ-সামাজিক অবস্থার পট পরিবর্তন হয়ে গেল তা সত্যিই বিস্ময়কর বটে! তা না হলে এমন দায়মুক্তি আসে কীভাবে?

কোটা আন্দোলনকারীদের জিম্মি দশায় সরকার সমতা আর সমদর্শিতা যে এক নয় তা ভুলে গেছে! সমতা মানে তো সবাই সমান। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন একই স্থান ও একই সাহায্য-সহযোগিতা। তা কি বাংলাদেশের সর্বত্র বিরাজিত? বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে যেতে হলে দেশের জনগণ কি সবাই একই প্রয়োজন বোধ করে বা একই সুযোগ-সুবিধা পেলে সবাই কি সমভাবে এগিয়ে যেতে পারবে? না। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবাই সবকিছু সমভাবে শুরু করতে পারে নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবার। তারা অবশ্যই তখন সাধারণদের তুলনায় অনেক বেশি সর্বক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছিল। ঠিক তেমনি আদিকাল থেকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে সম্ভাবনাময় নারী সমাজকে। সেইসাথে প্রতিবন্ধী ও উপজাতি তো আছেই। তাঁরা সবার অবস্থা কখনোই এমনকি এখনো অন্যান্যদের সমান নয়। সমান বলে বলে সমান সুযোগ নিতে গেলে তো যারা পিছিয়ে পড়া বা পিছিয়ে পড়েছিল, তাঁদের আর সামনে এগুনো দেওয়া গেল না।

প্রকৃতপক্ষে সমতা মানে সবাই সমান তা কিন্তু নয় বরং সবাইকে সমান চোখে দেখা। এখন সবাইকে যদি সমতার ৯০ ডিগ্রিতে দেখতে যাই, তবে যারা ছোট তাদেরকে দেখতে পাব না। কিন্তু যদি সমদর্শিতা প্রয়োগ করি, তাহলে ছোটদেরকে এমনভাবে দাঁড় করাব যাতে তারা অন্যদের সমান হতে পারে।

এখন এই যে কোটা বাতিল করা হল, তা কী সমদর্শিতার দ্বারা বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে কিনা? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা কি বলতে পারি যে রাজধানী শহরে বসবাস করা একজন নাগরিক আর গ্রামে বসবাসকারী একজন নাগরিক সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে? তবে আমাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান প্রভৃতির জন্য রাজধানীতে ছুটে যেতে হয় কেন? গ্রামে এখনো বাস, রেল, বিশ্ববিদ্যালয়, ভাল হাসপাতাল প্রভৃতি সুবিধা নেই কেন? তারা কি ট্যাক্স দেয় না? মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার কোন জাদুবলে অন্যান্যদের মত সমান উন্নতি করে ফেলেছে? এখনো উপজাতিদের মানবেতর দিন যাপন করতে হয়। এখনো নারীদের অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। গুটিকয়েক নারী আন্দোলনকারীর জন্য কি নারী কোটা তুলে দেয়ার যৌক্তিকতা আছে? যেসব নারী মনে করে তাদের কোটার প্রয়োজন নেই তারা তা নিলেই পারে। তাই বলে যোগ্যদের তা থেকে বঞ্চিত রাখার কোন অধিকার তাদের নেই।

কোটা ব্যবস্থাকে কমিয়ে যেমন ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার যৌক্তিকতা এখনো হয় নি ঠিক তেমনি তা বাতিল করা তো অবশ্যই নয়। শুধুমাত্র নারীদের জন্যই ১০ শতাংশ কোটার প্রয়োজনীয়তা এখন অনেক বেশি। সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও উপজাতি নিয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কোটার আবশ্যকতা এখনো রয়ে গেছে। এছাড়া আর যত প্রকার কোটা আছে অন্য সকল ক্ষেত্রে তা বিলোপ করাটাই উত্তম হবে।

কিন্তু সত্যিই দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই বিষটি আমাদের দেশের মেধাবীরা বুঝতে পারল না, নাকি তারা তা এড়িয়ে গেল বোধগম্য হল না। তারা তো বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলন করল। কিন্তু পুরোপুরি বাতিল যে বৈষম্যের নতুন সূত্রপাত করল তা যদি তারা না বুঝার ভান করে তাহলে জাতি এমন মেধাবী নিয়ে খুব বেশি দূর এগুতে পারবে না।

যাদের ভেতর সমদর্শন গড়ে ওঠেনি, তারা সমতার বুলি দ্বারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না। দেশপ্রেম তো নয়-ই। খুশি হতাম এই আন্দোলন স্থগিত না করে যদি এই নতুন বৈষম্য নিয়ে সরকারকে সজাগ করে দিত। কিন্তু না তারা তা করেনি। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আবারো বাধ্য করল তাঁদের অর্জিত রাষ্ট্রে এই বৈষম্য নিয়ে আন্দোলন করতে! সত্যিই তা খুবই দুঃখজনক।

সবশেষ এটাই বলব, যারা জিম্মি করতে পারে তারা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে যায়। আর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে পড়ে। তবে আশাকরি সরকার তার ভুল সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।

  • [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত