২৮ জুলাই, ২০১৮ ১৪:২৭
জন্মগতভাবে আমরা বাঙালিরা সহানুভূতিশীল। আমি নিজেও তাই, এবং হয়ত আপনিও। ছোটবেলায় গ্রামে যখন কোন চোর ধরা পড়ত তখন মনে হত তারে মেরে তক্তা বানিয়ে দেব, কিন্তু যখন দেখতাম অন্যরা সেই চোরকে মারছে কেন জানিনা খুব কষ্ট হত। একটু আগে যে আমার কাছে ছিল ঘৃণার সেই হয়ে যেত ভাল মানুষ। এমনি এক সহানুভূতিতে একদিনের বিনিময়ে একটি পক্ষের প্রচারে খলনায়ক থেকে নায়ক হয়ে গেছেন মাহমুদুর রহমান। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তারে নায়ক বানিয়ে দিয়ে গেছে। এ যেনো শত্রুর হাতে 'দুধের গোসল'।
মাহমুদুর যাদের হাতে রক্তাক্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে তারা বর্তমান সরকারের সব চেয়ে বিতর্কিত এবং বারবার যাদের কাজে সরকারে শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করেছে তারা ছাত্রলীগ। বারবার পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে নেতিবাচকভাবে; তাদের নেতিবাচক কাজের ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। সেই ছাত্রলীগ কুষ্টিয়ার আদালত প্রাঙ্গণে হামলা করল মাহমুদুর রহমানের ওপর। মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তার রক্তাক্ত ছবি, আদায় করে নিলে সর্বোচ্চ সহানুভূতি। এই সুযোগে মাহমুদুরের আদর্শে বিশ্বাসীরা এবং সুযোগ সন্ধানীরা আরেক ধাপ সামনে এসে এনিয়েবিনিয়ে বানিয়ে দিতে চাইল মহানায়ক।
তাদের সাথে আমি কিছু জায়গায় একমত আর তা হচ্ছে হামলার বিচার চাই এবং ভিন্নমতের উপর এমন হামলা যেনো আর না ঘটে রাষ্ট্রের কাছে সেই নিশ্চয়তাও চাই। তবে খলনায়ককে নায়ক বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মোটা দাগে দ্বিমত পোষণ করি। একটি স্বাধীন দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যদি না থাকে সে স্বাধীনতা দিয়ে আমরা কিভাবে উপভোগ করব? মত প্রকাশের জন্য কারো ওপর হামলা করা মধ্যযুগীয় বর্বরতা। কলমের প্রতিবাদ হবে শুধু কলম দিয়ে সেখানে লাঠি কেন?
মাহমুদুরের উপর হামলা করে ছাত্রলীগ বড় একটি ক্ষতি করল সরকারের। অনেকটা শত্রুকে দুধ দিয়ে গোসল করিয়ে পবিত্র করার চেষ্টা। এর মাধ্যমে অসুস্থ মানসিকতার সাম্প্রদায়িক মানুষকে রক্তাক্ত করে নায়ক বানানোর আয়োজন করল ছাত্রলীগ। মাহমুদুরের আদর্শ লালনকারীরা এই সুযোগে নিজেদের প্রকাশ ঘটানোর ও সুযোগ পেলো।
বিভিন্ন ঘটনার ছাত্রলীগ বারবার বিতর্কিতভাবে শিরোনাম হচ্ছে মিডিয়ায়। ছাত্রলীগ নিয়ে খোদ সরকার প্রধান বিরক্ত। সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন ছাত্রলীগের বাড়াবাড়িতে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত। তাহলে ছাত্রলীগ আসলে কার নিয়ন্ত্রণে চলে, নাকি নিয়ন্ত্রণহীন? বিগত কয়েক বছরের কাজে বলা যায় ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণহীন। তার ধারাবাহিকতায় বিতর্কিত আরেকটি কাজ হচ্ছে মাহমুদুরের ওপর হামলা।
অনেকে আবার এই হামলার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছে, সুস্থ মাথায় একজন মানুষের ওপর হামলা করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। যদি ভিন্নমতের প্রতি এমন মনোভাব থাকে তাহলে আপনি আর জঙ্গিদের তফাৎ কই?
ছাত্রলীগের এই হামলার কারণে উপকার হয়েছে মাহমুদুর রহমানের, তার সব ঘৃণিত কৃতিত্ব লুকিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে মহানায়ক বানানোর। তার অনেকটা সফলতাও পেয়েছে যোগাযোগ মাধ্যমে। কলমসৈনিক, সত্যের পক্ষের যোদ্ধা, মজলুম আদর্শবান সাংবাদিকসহ আরও কত কি।
ক্ষোভ থাকলে দেশে আইন আছে, মামলা করা যেতে পারে। সেই মামলায় দেশের আইন তার বিচার করবে। এখানে ছাত্রলীগ বা যেকোনো মহাশক্তির অধিকার নেই আইন হাতে তুলে নেওয়া। সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ। বিতর্কিত কাজের কারণে সারা দেশে অনেক মামলা আছে মাহমুদুর রহমানের ওপর। এমনই একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে জামিন নিতে কুষ্টিয়া গিয়েছিলেন তিনি। যদিও ৭১ টেলিভিশনকে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বলেছেন, এ হামলা তারা করেননি। কিন্তু দেশের সব মানুষ জেনেছে এই হামলা ছাত্রলীগ করেছে। যেই করুক ভিন্নমতের ওপর এই হামলা ব্যথিত করেছে এ দেশের হৃদয়বান মানুষদের।
এ হামলার বিচার হোক, ভিন্নমতের ওপর নির্যাতন বন্ধ হোক এটাই একটি সুন্দর চাওয়া। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় এই যে ভিন্নমতের ওপর হামলা, ভিন্নমতকে সহ্য করতে না পারার এই আত্মঘাতী ক্ষেত্র তৈরিকরণে বাংলাদেশে প্রথম নির্লজ্জ উপায়ে পেশাদারিত্বের সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিলেন এই মাহমুদুর রহমান। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ ছিল উনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। সেই প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য এমন কোন কাজ নেই যা তিনি করেন নি। ব্লগের সীমিত পরিসীমার লেখাকে তিনি তার আমারদেশ পত্রিকায় প্রকাশ করেন, সাংবাদিকতার কোন নিয়মনীতি না মেনে অনেকের ব্যক্তিগত ছবি প্রকাশ করেছেন তার সম্পাদিত পত্রিকায়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আমারদেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হওয়ার আগে মাহমুদুর রহমান জীবনে কখনো একদিনের জন্যও সাংবাদিকতা করেন নি তাই তার বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আমারদেশকে ব্যবহার করেছেন একজন দলকানা কর্মীর চেয়েও অতিউৎসাহী হয়ে। সত্য মিথ্যার যাচাই না করে 'নাস্তিক' ট্যাগ দিয়ে অনেকের নাম প্রকাশ করেছেন যার ফলে জীবন দিতে হয়েছে অনেককে, দেশ ছেড়েছে অনেক যুবক। একাজে হেফাজতসহ অনেকের সমর্থন পেয়েছেন। জীবনে কোনদিন তার মাঝে ধর্মীয় কোন চিহ্ন প্রকাশ্যে দেখা না গেলেও শুধু ধর্মীয় আবেগ নিয়ে নিজের উদ্দেশ্য সফল করতে গিয়ে ধার্মিকের উপাধি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি তো নিজের স্বার্থের জন্য ধর্মের ব্যবহার করেছিলেন। ঠিক যেমন আবার স্বার্থের জন্য মাহমুদুর রহমান কাজ করছেন ধর্মের বিরুদ্ধে, ছোট করেছেন নিজ ধর্মকে। মুসলমানদের কাছে পবিত্র এমনকি অন্য ধর্মের মানুষকেও সম্মানের কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের ছবিকে রাজাকার মুক্তির দাবিতে সৌদির ইমামদের দাবি বলে চালিয়ে দিয়েছেন। এইতো কয়দিন আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ তার এক পালক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন যা একটা মানবিক কাজ যার জন্য প্রশংসা পেয়েছেন এরশাদ কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে আমারদেশ অনলাইনে সংবাদ প্রকাশ করল “এরশাদ আবারো বিয়ে করেছেন” একজন মানুষের মস্তিষ্ক কতটা নোংরা পর্যায়ে গেলে বাবা-মেয়েকে নিয়ে এমন মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করতে পারে?
সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা ও বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান একের পর এক অঘটনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেকে বড় ধরনের ভিলেন হিসেবে আবিস্কার করেছেন। ২০০৬-এ উত্তরায় সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে তার ষড়যন্ত্র সভা ফাঁস করে দেয় সংবাদ মাধ্যম যা তাকে ভিলেন হিসেবে পরিচিত করে। মাহমুদুর রহমানের চিন্তার এত এত বিকৃত হয়েছিল যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাদের অপমান করতে তার বিবেকে লাগেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও তিনি অশালীন মন্তব্য করেছেন।
এই যে এত মিথ্যাচার, বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ধর্মকে আঘাত, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি এত অপরাধ করেও একটি সভ্যদেশে মাহমুদুর রহমান কি করে জেলের বাইরে আছেন তা যেমন বিরাট বিস্ময় তেমনি এমন একজন মানুষকে হামলা করে সহানুভূতির ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়ার মত পরিবেশ ছাত্রলীগ তৈরি করে দিয়েছে তাও বিস্ময়!
আপনার মন্তব্য