অনূঢ়া বৈভব মালঞ্চ

০২ ফেব্রুয়ারি , ২০১৯ ২১:০১

আজ পার্থক্য কোথায়, সুহৃদ?

আমি তখন ক্লাস সিক্স/সেভেনে পড়ি, ইভটিজিং শব্দটা তখনো এত বহুল ব্যবহৃত নয়, খবরের কাগজে শ্যামলা ছিপছিপে গড়নের সিমির ছবি ছাপা হয়। চারুকলার ছাত্রী সিমি আত্মহত্যা করেছিল, বখাটেরা উত্যক্ত করায়। ছোটবেলায় ওই ঘটনা আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। পরবর্তীতে আরও অনেক আত্মহত্যার ঘটনা দেখেছি, শুনেছি। জানিনা কোন কারণে, হয়তো আমি নিজেও একজন মেয়ে বলেও, ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করা মেয়েগুলো আমার মনে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে।

আমি এখনো অন্য আত্মহত্যাগুলোর সাথে ইভটিজিংয়ের ঘটনাগুলো মেলাতে পারি না। এরপর দেশ এগিয়ে গেছে অনেকটা পথ। আমরা দেখেছি, ইভটিজারকে রাস্তায় পেটাতে ইভটিজিংয়ের শিকার মেয়েটি নিজে। আরও দেখেছি, রাস্তায় নির্ভেজাল জনগণকে... নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে মজা দেখতে।

গত দুদিনে একটা আত্মহত্যার ঘটনা বাংলাদেশ কাঁপিয়েছে। সেটা হচ্ছে ডা. আকাশ এর আত্মহত্যা। অনেকে আত্মহত্যাকে রোগ বলছেন, বিকারগ্রস্ততা ভাবছেন, কিন্তু এটাও একটা সত্য আত্মহত্যাও একটা প্রতিবাদ। যখন আর কোনভাবেই প্রতিবাদ করতে পারে না মানুষ, তখন নিজের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করে যায়। একটা জীবন দীপ নিভে যাওয়া... এর চেয়ে হৃদয়বিদারক, দু:খজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। ঠিক সেরকম মুহূর্তে, যে আত্মহত্যা করেছে, সে ঠিক করেছে না ভুল করেছে এটা নিয়ে একপেশে মতামত প্রদান করাকে আমি হৃদয়হীনতা মনে করি।

যদিও আমার মনে করা বা না করায় কি বা এসে যায়! আমি নগণ্য একজন মানুষ। আমার মতামতের খুব একটা গুরুত্ব হয়ত নাই। কিন্তু গত দুইদিনে অজস্র মতামত দেখছি ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। কারো মতামতের উপর আমার আপত্তি নাই। এমনকি এই সমাজে পরকীয়া করে প্রমাণসহ একটা মেয়ে ধরা পড়লে কী ধরণের মন্তব্যের সম্মুখীন হতে পারে তা আমার কল্পনাতে ছিলই, এবং তার বাস্তব রূপও দুদিন থেকে দেখছি। অবাক হইনি, এ যুগে ঘটিত অপরাধে যখন মধ্যযুগীয় কায়দায় বিচারের বাসনা মানুষের মনে জেগে উঠেছে। সত্যি একটুও অবাক হইনি, যখন দেখেছি নারী একটা ভুল করলে তার উপর হামলে পড়ার জন্য ওঁত পেতে থাকা আধুনিকতার লেবাস পরা মধ্যযুগীয় সমাজের নীতি পুলিশদের শ্বদন্ত বেরিয়ে পড়েছে। ধাক্কা খেয়েছি তখন, যখন দেখেছি... আমি এতদিন যাদের সামান্য হলেও সংবেদনশীল ভেবেছি, মানবিক ভেবে ভুল করেছি, তাদেরকেও ওই নীতি পুলিশদের মাঝখানে দেখে।

'অধিকাংশ' নারীবাদ নাকি পুরুষদের গালাগাল করার জন্য, 'অধিকাংশ' নারীবাদ নাকি মেয়েদের উস্কে দেবার জন্য, অধিকাংশ নারীবাদ নাকি কিটিবাদ... ইত্যাদি ইত্যাদি কথা প্রতিদিন চারদিক থেকে শুনি, কারা বলে... দেখি। কিন্তু ভেক ধরা মানবতাবাদী আপনাদেরও যে এই 'অধিকাংশ' নারীবাদীদের সাথে সমস্যা ছিল সেটা জানতাম না! এখন তো ডাক্তার-মিতু আপনাদেরকে সুযোগ করে দিল সেই 'অধিকাংশ' নারীবাদীদের একহাত দেখে নেয়ার। সে সুবাদে একটা ধন্যবাদ মিতু পেতেই পারে, তাই না?

অনেক আগে এক উঠতি বয়সের আধুনিক কবি বলেছিলেন, বাংলাদেশের নারীবাদীরা নাকি 'বালছালবাদী'! আসলে আপনারা কেমন নারীবাদ চান, তা আপনারা ম্যানুফ্যাকচার না করলে আমরা বুঝতে পারব না। সেই পর্যন্ত... আপনাদের মতো উচ্চমার্গের মানবতাবাদীর কাছ থেকে আমি মাফও চাই, দোয়াও চাই।

আমি এখনো মনে করি, বাংলাদেশে 'অধিকাংশ' নারী এখনো শিক্ষায়, স্বনির্ভরতায়, অধিকারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে। নির্যাতিত, বৈষম্যের শিকার। তাই এসব কথা কানে তুলি না। এবং বলি, হ্যাঁ, আমিও একজন নারীবাদী। জন্মের পর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত ছেলে বা মেয়ে বিচার না করে একটা শিশুকে তার সর্বৈব বিকাশের সুযোগ করে দেওয়ার দাবি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে জানিয়ে যাব, মানুষ হিসাবে সম অধিকার না দেওয়ার জন্য এই সমাজ ও সিস্টেমকে গালি দিতেই থাকব। কিন্তু যখন দেখি, লেবাসে আধুনিক মানবিক সাজা, মুখে সহাবস্থানের বুলি আওড়ানো এসব পুরুষ এবং নারীরাও... নারীরা ভুল করলে নারীবাদকে দোষ দেন, নারীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নারীবাদকে ধুয়ে দেন, তখন একটু চিন্তিত হই বইকি।

সিরিয়ায় শিশু হত্যার প্রতিবাদ করলে অনেকের চুলকায়, কেন অমুক জায়গার ঘটনার প্রতিবাদ করা হলো না! ইউরোপ আমেরিকায় ঘটে যাওয়া সহিংসতার প্রতিবাদ করলে যাদের চুলকায় কেন রোহিঙ্গা বা ইয়েমেনের শিশুদের জন্য কাঁদলাম না? সেসব সুবিধাবাদীদের সাথে আজ আপনার পার্থক্য কোথায় সুহৃদ? যখন আপনি বলছেন আজ একটা মেয়ে আত্মহত্যা করলে অনেকে এই করতেন, সেই করতেন... কিন্তু ডা. আকাশের বেলায় করছেন না! পার্থক্য একটাই, কেউ মুখোশ ছাড়া বীভৎস, আর কেউ মুখোশ পরে...

'আপনি ইভটিজিংয়ের কারণে আত্মহত্যা করলে যেভাবে প্রতিবাদ করতেন, এখন কেন সেভাবে প্রতিবাদ করলেন না' জাতীয় বুলশিট যারা গত দুদিনে নির্গমন করেছেন তারা সত্যিই দুর্গন্ধময়। আমি এ জাতীয় লোককে পরিহার করি, সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলেও করে যাব।

আর একটা জিনিস দেখলাম গত দুইদিনে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা মানবদরদীরা ডা. আকাশের আত্মহত্যার জন্য চুকচুক করছেন প্রমাণসহ একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে.. যেখানে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে মেয়েটা। এসব দেখে তোমাদের 'দরদ' 'মানবতা' নিয়ে আমার আর সন্দেহই রইলো না।

এখন যারা বলবেন, কোলে বসিয়ে স্বীকারোক্তি নেবে কিনা, তাদের প্রতি আর উত্তর দেওয়ার আগ্রহ নেই। কারণ তাদের কাছে স্বীকারোক্তির ওই পদ্ধতিটা খুব পছন্দ হয়েছে। না হয়ে যাবেই বা কোথায়! অনেক পুরোনো ঐতিহ্য তো!

ও হ্যাঁ, সাংবাদিকদের প্রতিভায় তো আমি আরও মুগ্ধ (সব নয়)। এদের সংবাদ পরিবেশনের স্টাইল দেখে আমার বড়শি দিয়ে মাছ ধরার কথা মনে পড়ে যায়। ব্র্যাভো! আপনাদের কাছে এসে প্রশিক্ষণ নেয়া উচিত দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের। আর সংবাদ পরিবেশনের শিল্পায়নের জন্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নোস্কার (অস্কার+নোবেল)--এর জন্য মনোনীত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

শেষে একটা কথাই বলবো, নৈতিকতা একটা বিশেষ গুণ... যেটার বিকাশ ঘটাতে পরিবার সমাজ রাষ্ট্র সবকিছুর দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা এবং সময় ও পদক্ষেপ প্রয়োজন। সেটা কি আমরা পাচ্ছি?

আপনার মন্তব্য

আলোচিত