কানিজ ফাতেমা

১৭ নভেম্বর, ২০১৯ ১৩:৫৭

শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও শিক্ষকদের সংকট

আজকের দিনে শিক্ষা কতটুকু জ্ঞান অর্জনের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে, এ নিয়ে আমাদের ভাবনার এবং ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ করার সময় এসেছে। আমাদের সন্তানেরা আরাম-আয়েশ, বিনোদন, খেলাধুলাকে অনেকটা বিসর্জন দিয়ে শুধু পড়ছে তো পড়ছেই। এ পড়ালেখা কতটা পরিবেশ বান্ধব, নিজের বা জাতির কল্যাণে আসছে তা গভীরভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। ছোট সোনামণিদের ওপর চলে আসছে শিশু মনোবিজ্ঞান বহির্ভূত বিদেশী ভাষায় কঠিন শব্দ শেখানোর কঠিন চাপ। বেশিরভাগ অভিভাবক মহাখুশি এটি ভেবে যে, তাদের সন্তানেরা শিগগিরই মহাপণ্ডিত বনে যাবে।

হাতের জড়তা না কাটতেই আঁকাজোকা শেখানোর পরিবর্তে কয়েক ভাষার বর্ণমালা লেখা শেখানোর জন্য আমরা জোর জবরদস্তি শুরু করি। ভাবখানা এমন, ছোট শিশুকে জোর করে না শেখালে বড় হয়ে তাদের শেখার অভ্যাস গড়ে উঠবে না। কিন্তু প্রতিটি কাজের সময় সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। শিশুকালে অভ্যাস না করলে যথাযথ বয়সে কাজগুলো করা কষ্ট হবে। এ যুক্তি অবাস্তব, বরং সঠিক সময়ে যথাযথ কাজটি সহজে ও স্বল্পসময়ে করা যায়। পাঁচ বছর আগেই শিশু তার পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার কথা।

এ বয়সে ছড়া, কবিতা, সহজ শব্দের মাধ্যমে অক্ষরজ্ঞান আর আঁকাজোকার মাধ্যমে পড়ালেখা শুরু করবে। বেশি শব্দ শেখার মাধ্যমে শব্দের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। শিশু মাতৃভাষায় সমৃদ্ধ হলে, সে বিদেশী ভাষায় দ্রুত জ্ঞান অর্জন করবে। শিশুর বয়স রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা দিলে তা হবে ফলপ্রসূ শিক্ষা। আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মাতৃভাষার মাধ্যমে পড়াশোনা অনেকটা অকার্যকর করে ফেলেছে। অভিভাবকদের বদ্ধমূল ধারণা, বেশি বই,  হোমওয়ার্ক শিশুদের মহাবিদ্বানে পরিণত করবে। অনেক অভিভাবককে বলতে শোনা যায়, যে স্কুল শিশুকে কঠোর শাসন করে কিংবা বাড়িতে লেখাপড়ার চাপ দেয়, সে স্কুল ভালো।

শিশুদের ছড়া, কবিতা, গল্পের বই, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, গান, খেলাধুলা এবং জাতীয় দিবসগুলোতে কি ঘটেছে, কেন ঘটেছে সে সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ ধারণা ক্রমান্বয়ে দিতে হবে। শিশু স্বদেশকে জানবে ও দেশকে ভালবাসতে শিখবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি সম আচরণ গড়ে তুলতে হবে। ইসলাম সহ সব ধর্মই শান্তির। উগ্রবাদ কোন ধর্মই সমর্থন করে না। শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে জানাতে হবে। সরকারি শিক্ষকেরা শিশু শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলেও শিক্ষক স্বল্পতা, সরকারি নানা কাজে ব্যস্ততা এবং কারো কারো আন্তরিকতার অভাবে শিক্ষার্থীরা যথাযথ জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়।

ঢাকা শহরের সরকারি ও কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষকেরা অনেকে তাদের সন্তানদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ান না। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যেও এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিষয়টি অনেকটা শিশুদের কাছে বাড়িতে তৈরি খাবারের চেয়ে ফাস্টফুড বা ফুটপাথে ধুলোবালিতে মিশ্রিত খাবারের বেশি সমাদরের মতো। মানসিকতা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সাধারণ মানুষের সন্তানদের সাথে পড়াকে মর্যাদাহানিকর বলে তাদের ধারণা। এ ঠুনকো ভাবনা থেকে শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করেও আমরা সমাজে ভেদাভেদ সৃষ্টি করি। ভুলে যাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ধনী, দরিদ্র, কৃষক ও শ্রমিক বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সবাই এ দেশের মানুষ। মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি মানুষ। অথচ আমরা সন্তানদের কিন্ডার গার্টেনের খরচ বহন করে গর্ব করে থাকি নামী-দামী স্কুলের অভিভাবক হিসেবে। শিক্ষা নৈতিক অবক্ষয় দুর করাসহ বৈষম্য কমাবে এ ভাবনা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকুক। তাছাড়া বিভিন্নভাবে পাঠ্যপুস্তক সমৃদ্ধ করে প্রাথমিক শিক্ষার্থীর ২৯টি প্রান্তি যোগ্যতা অর্জন করে ফলপ্রসূ শিক্ষা অর্জন করানো সম্ভব।

২০১৫-১৬ সালের বাংলা প্রশ্নপত্রের রচনাগুলো পাঠ্য বইয়ের গদ্যের বাইরে থেকে এসেছে। আগে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা থেকে সমাপনী ২০১৪ পর্যন্ত চারটি রচনা পাঠ্যবইয়ের গদ্যাংশ থেকে আসত এবং মাত্র একটি রচনা পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে আসত। বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, বিজ্ঞান, ধর্মে ৫০টি বহু নির্বাচনী প্রশ্ন আসে। যেহেতু পাঠ্যবইকে অনেকটা অকার্যকর করে পাঠ্যবই- বহির্ভূত প্রশ্ন করে এবং ৫০টি বহু নির্বাচনী প্রশ্ন দিয়ে সূক্ষ্ম কৌশলে শিক্ষার্থীর জ্ঞান বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন প্রাথমিকে একটি আদর্শ মূল্যায়ন পদ্ধতি। আদর্শ মূল্যায়ন পদ্ধতির রূপরেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার্থীকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার আচার-আচরণ, সাংস্কৃতিক চর্চ্চাসহ পুরো কর্মকাণ্ড পরীক্ষার আওতায় আনা প্রয়োজন। জাতীয় শিক্ষানীতি ২৯১৬-এর আলোকে সারাদেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা চালু করার কথা থাকলেও তা এখনো পূর্ণতা লাভ করেনি। সমাপনী পাসের পর ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর ওপর নেমে আসে বইয়ের বোঝা। পঞ্চম শ্রেণিতে নির্ধারিত বই ছয়টি। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিশু শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

প্রশিক্ষণ বিহীন অবস্থায় কিন্ডার গার্টেনগুলো অনেকটা প্রধান শিক্ষক বা পরিচালকদের নির্দেশনা মোতাবেক পাঠদান করে আসছে। শিশু শিক্ষার স্বার্থে স্বল্পমেয়াদী হলেও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরী। কিন্ডার গার্টেনগুলো সহজ প্রক্রিয়ায় রেজিট্রেশন আওতায় এনে সরকারি তত্ত্বাবধানে আনা উচিত। জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা ব্যাহত হবে বলে অন্যান্য দেশের মতো শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা ও সম্মানজনক বেতন স্কেল আজ সময়ের দাবি হিসেবে গণ্য না করে অধিকার হিসেবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সব পেশায় নিজস্ব ক্যাডার আছে। শুধু নেই বিশাল প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে। অচিরেই হয়তো এ বিষয়ের সমাধান হবে। জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা প্রদান করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন অভিজ্ঞ মেধাবী শিক্ষক। প্রাথমিক শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার আদায় না হলে জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা অর্জন সম্ভব হবে না। তা হলো-সহকারি শিক্ষকদের এন্ট্রি পদ ধরে প্রাথমিক শিক্ষায় আলাদা ক্যাডার সৃষ্টি করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শতভাগ পদোন্নতি দিতে হবে। এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পেশাজীবী দ্বারা পরিচালিত হলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য অধিকতর বাস্তবায়ন হবে।

  • কানিজ ফাতেমা, সহকারি শিক্ষক, শমশেরনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য

আলোচিত