ফরিদ আহমেদ

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০৩:০৪

আওয়ামীবিরোধী শিক্ষকনেতা কিনা বঙ্গবন্ধুর নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি!

সালটা তিরানব্বই বা চুরানব্বই হবে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার আমি তখন। খুব বেশিদিন হয়নি জয়েন করেছি সেখানে।

বিএনপির তখন রমরমা অবস্থা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও তার ব্যতিক্রম না। ছাত্র রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে। শিক্ষক রাজনীতিতেও বিএনপি এবং জামাতের সুস্পষ্ট প্রাধান্য।

সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের তিনটা দল ছিলো। একটা হচ্ছে বিএনপি সমর্থিত শিক্ষকদের দল। যার নাম ছিলো সোনালী দল। আরেকটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং বামপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন। সেটার নাম হচ্ছে গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম। আর তৃতীয়টা ছিলো জামাতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন আদর্শ শিক্ষক পরিষদ।

আমি যখন জয়েন করি, সোনালি দলের তুলনায় গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের জনবল একেবারেই কম ছিলো। সাধারণ সভাতেও পঞ্চাশ-ষাটজনের বেশি শিক্ষক উপস্থিত থাকতো না। এর বিপরীতে সোনালি দলে দুই থেকে আড়াইশো শিক্ষক জড়ো হতো। লেকচারারদের মধ্যে কেউই গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম করতো না। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলাম আমি। আমি সক্রিয়ভাবে গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম করেছি। দুই একজন আমাদের আদর্শের লোক ফাঁকফোকর দিয়ে যে লেকচারার হিসাবে যোগ দেয়নি তা নয়। কিন্তু, যোগ দেবার আগেই তারা সোনালীর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। নইলে তাদের পক্ষে বিএনপির সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা সম্ভব ছিলো না। আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হওয়াতে। আমার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিংবা আমার বিভাগকে গুরুত্বহীন ভেবে এই কষ্ট করার প্রচেষ্টাটা তারা নেয়নি।

আমাদের যেহেতু লোকবল খুবই কম ছিলো, নির্বাচনে দাঁড়ালেই অবধারিত পরাজয় লেখা ছিলো, সে কারণে সহজে কেউ নির্বাচন করতে চাইতো না। নির্বাচনে আবার সোনালি একা না, তার সাথে আদর্শ শিক্ষক পরিষদও যোগ দিতো। এরা কখনোই আলাদাভাবে নির্বাচন করেনি। নির্বাচনের সময় সোনালিকে সাপোর্ট দিয়ে দরকষাকষি করে কিছু সুবিধা আদায় করে নিতো তারা শুধু।

ওই বছর নির্বাচনে গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম আমাকে নমিনেশন দেয় যুগ্ম সম্পাদক পদে। আমার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। তিনি আমার বেশ সিনিয়র। কিছুদিন আগে পিএইচডি করে এসেছেন। তখন তিনি সহকারী প্রফেসর। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সহযোগী প্রফেসর হয়ে গিয়েছিলেন।

নির্বাচনে আমার হার নিশ্চিত ছিলো। শুধুমাত্র দলীয় শক্তিমত্তার অসামঞ্জস্যের কারণেই নয়। আরও কয়েকটা সুস্পষ্ট কারণ ছিলো। আগেই বলেছি, আমি উনার অনেক জুনিয়র ছিলাম। শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে ছিলাম। তার উপরে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সবচেয়ে বড় ফ্যাকাল্টির শিক্ষক ছিলেন।

তেইশ ভোটের ব্যবধানে আমি উনার কাছে হেরে যাই। রাতের বেলা দেখি উনি আমার বাসায় এসে হাজির হয়েছেন। আমাকে তিনি সান্ত্বনা দিলেন নানা কথা বলে। আন্নার দেশের বাড়ি ফরিদপুর বলে উনি আমাকে বোন জামাই বলতেন। নাসির ভাইয়ের ভদ্রতাবোধ এবং বিবেচনাবোধ দেখে সেদিন খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি।

সেই সময় থেকে, আমি দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত নাসির ভাই সোনালী দলে সক্রিয় থেকেছেন, আর আমি সক্রিয় থেকেছি গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামে। উনার স্ত্রীও আমাদের ফ্যাকাল্টির শিক্ষক ছিলেন। তিনিও নাসির ভাইয়ের মতো সোনালী দল করতেন।

দেশ ছেড়ে আসার বেশ কয়েক বছর পর হঠাৎ করে পত্রিকায় দেখি নাসির ভাই গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হয়েছেন। এই সংবাদ প্রবল বিস্ময় হয়ে আসে আমার জন্য। না, উনি ভিসি হয়েছেন, সে কারণে বিস্ময় নয়। ভিসি উনি হতেই পারেন। বিস্ময়ের কারণ হচ্ছে, উনি ভিসি হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে। যিনি সারাজীবন আওয়ামী বিরোধী রাজনীতি করলেন, তিনিই কিনা বঙ্গবন্ধুর নামে হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হলেন! এর থেকে বিস্ময়কর আর কী হতে পারে আমার জন্য! সরকারের লোকজন কি ভিসি করার আগে সামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড চেকটাও করে না? লোকমুখে শুনেছি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে তিনি রঙ পরিবর্তন করেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা বই লেখেন। সেটাকে বিক্রি করেই ভিসি হন। এগুলোর সত্য-মিথ্যা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, সরকারের যে অংশ ভিসি নিয়োগে কাজ করে, সেই অংশ সঠিকভাবে তাদের কাজ করেনি।

ভিসি হবার পর থেকে আলোচনার শীর্ষে আছেন তিনি। কয়েকদিন পরপরই খবরের শিরোনাম হন। কয়েকদিন আগে একটা মেয়েকে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস লেখার কারণে বহিষ্কার করেছেন তিনি। এই মেয়েটার সাথে তাঁর কথোপকথনের অডিও আমি শুনেছি। একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রীকে এইভাবে ধমকাতে পারেন, গালিগালাজ করতে পারেন, বা অপমান করতে পারেন, সেটা না শুনলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত