মাসকাওয়াথ আহসান

২২ নভেম্বর, ২০২০ ১৬:১৭

উন্মুক্ত আকাশে মঞ্চনাটক ‘নো ম্যানস স্কাই’

করোনা ভাইরাসের দীর্ঘস্থায়ী হানায় জীবন যখন বিপন্ন; জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে সামাজিক দূরত্বের অনুশাসনে মানুষ যখন বিচ্ছিন্ন-নিঃসঙ্গ; জীবন যখন সামনে এগোচ্ছে না; তখন যেন স্মৃতির মেঘে বৃষ্টি নামে। ‘নো ম্যানস স্কাই’ বুলবুল হাসানের লেখা একটি স্মৃতি নাট্য। শিল্প-চর্চার জন্য বিরূপ এক সময়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র লন্ডনের আয়োজনে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হলো। কভিড সাবধানতার কারণে মঞ্চ নাটকে ঠিক সামনে বসে দর্শক যেভাবে নাটক দেখে; সে সুযোগ না থাকলেও; ভিন্ন আঙ্গিকে ইন্টারনেটের দৃশ্য মাধ্যমে মঞ্চ নাটকটি দেখার সুযোগ হলো দর্শকের।

এই মঞ্চ নাটকের নির্দেশক সৈয়দা সায়মা আহমেদ আর এর কলা-কুশলীরা মঞ্চ নাটকের স্বাদ পূরণ করেছেন অনেকটাই। এই নাটক উপস্থাপনে করোনার দুঃসময়ের সীমাবদ্ধতা পুষিয়ে গেছে নির্দেশনা, অভিনয়, আলোকসম্পাত, শব্দ-প্রক্ষেপণ আর আবহ সংগীতের দ্যোতনায়।

করোনা ভাইরাসকে ঘিরে যাপিত জীবনে যে প্রতিকূলতা আর সদ্য বাবা হারানো এক সন্তানের তার বাবার স্মৃতি স্পর্শ করা; মায়ের শোকের সঙ্গী হবার যে আকুলতা; তা মিশে আছে এই নাটকের পরতে পরতে।

এই নাটকের মূল চরিত্র আবীর লন্ডন থেকে ঢাকায় এসে করোনা ভাইরাসে প্রয়োজনীয় কোয়ারেন্টিনের নিয়ম মেনে বাসায় বন্দি থেকেই শোকাহত মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়। কিন্তু এসময় সমাজের মোটাদাগের অভিজ্ঞতায় 'প্রবাসীরা করোনা ভাইরাস' ছড়াতে দেশে আসছে; এরকম একটি কু-সংস্কার দানা বাঁধতে থাকে। কেউ কেউ যে বিদেশ থেকে এসে নিয়ম মেনে কোয়ারেন্টিনে আছে; সে বিবেচনাবোধ লোপ পায় যেন রবাহূত সমাজে। বাড়িওয়ালা তাই সমানুভূতিহীন ধমক দেয়; পুলিশ ডেকে আনে; তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে শোকাহত একটি পরিবারকে।

এই সীমাহীন তিক্ততার মাঝেও প্রতি রাতেই অশরীরী বাবার ছায়া এসে আবীরকে নিয়ে যায় সুন্দরের জগতে। এ মঞ্চ নাটকে বাবার ছায়ার সঙ্গে আবীরের যে কথোপকথন; তা দর্শককে স্পর্শ করে। মহামারীর অশনি হানায় স্বজন হারানো অসংখ্য মানুষের সঙ্গে অনায়াসে যোগাযোগ স্থাপন করে এই স্মৃতি গল্প।

নাট্যকার বুলবুল হাসান এই নাটকের পর্দা উন্মোচনী আলোচনায় বলেছেন, 'মাত্র তিরিশ মিনিটে একটি পুরো নাটক দাঁড় করানো কঠিন।' তবু এই মঞ্চ নাটকে পুরো একটি গল্প প্রাণ পেয়েছে বাবা ও সন্তানের প্রাণদায়ী গল্প-বারান্দায়। স্মৃতি যে কেবল শোকের নয়; স্মৃতি যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে; যন্ত্র যুগে হারিয়ে ফেলা আবেগ আর মায়াকে ফিরিয়ে আনতে পারে; ‘নো ম্যানস স্কাই’ ঠিক যেন তেমনি এক দর্শন অভিজ্ঞতা।

অশরীরী বাবা পরিপার্শ্বের প্রতিকূলতা; হৃদয়হীনতার মন খারাপের সময়ে মন ভালো করতে সন্তানের কাছে আসেন তার প্রিয় গান, প্রিয় সাহিত্য, ষাটের দশকের সোনালী সময়ের গল্প নিয়ে। বছরের অর্ধেকটা সময় পানির ওপরে ভেসে থাকা এলাকা থেকে সব পিছুটান ছেড়ে, জীবনকে নিজের মতো করে দেখতে খুলনা বি এল কলেজ হয়ে সে সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে পড়তে যাওয়া; সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ, চলচ্চিত্র দেখা আর অবসরে রবীন্দ্রনাথ, তারাশংকর, বিভূতিভূষণের মৌতাতে মেতে থাকার গল্প বলেন তিনি।

আবীরও তার বাবার কাছে শৈশবের প্রেম-প্রকৃতি-পদ্মা নদীতে 'বিরুদ্ধ স্রোতে'র বিপরীতে সাঁতার কাটার গল্প বলে। ‘বিরুদ্ধ স্রোত’ শব্দবন্ধটি বাবাকে নিয়ে যায় তার একাত্তরের স্মৃতিতে। সে সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে রেডিও পাকিস্তানে যোগ দেয়া; বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে স্পষ্টতই স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান এসে যাবার পর বেপরোয়া শত্রুপক্ষের নজরদারিতে পড়ে যাওয়ার স্মৃতির পথ ধরে হাঁটেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ তার বুকের গভীরে উচ্ছ্বাস এনে দিয়েছিলো। এই অবরুদ্ধ সময়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তহবিল সংগ্রহের কাজ করেছিলেন তিনি; সে গল্প আবীর তার বাবার বন্ধুর কাছে শুনেছে। কিন্তু বাবা সেসব দুঃসাহসের সময়ের কথা ছেলেকে বলেননি; কেননা দেশের জন্য কাজ করতে হয় নীরবে।

বাবা ও ছেলের কথোপকথনে তাদের দুজনেরই জীবনের গভীরের জীবনকে দেখার এক অনুপম মিল চোখে পড়ে। বাবা যেমন তারাশংকরের 'কবি' আর যাযাবরের 'দৃষ্টিপাত'-এর মধ্যে অবোধ্য জীবনের মানে খুঁজেছেন; ছেলেও তেমনি শামসুর রাহমানের 'দুঃসময়ে মুখোমুখি' কবিতায় খুঁজেছে বোধ আর বোধগম্যতা। তার মনে দোলা দেয় 'অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো।'

বাবা আর ছেলের একদা নৌকা ভ্রমণের স্মৃতির বৈঠা বেয়ে ‘নো ম্যানস স্কাই’ নাটকের গল্পটি এর গন্তব্য খুঁজতে থাকে। বাবা তার ছেলেকে স্বচ্ছ পানির মধ্যে আকাশের প্রতিবিম্ব দেখিয়েছিলেন। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আস্বাদনের গভীর চোখটিকে বাবা সন্তানের মাঝেও সস্নেহে সহজাতভাবে লালন করেছিলেন যেন।

সেই নৌকা ভ্রমণে বাবা জলে ভাসা পদ্মপাতা ছুঁয়ে দেখেছিলেন। জীবনানন্দ থেকে আউড়েছিলেন, এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল, পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল।

নশ্বর জীবনের পদ্মপাতায় জলের এই সামান্য স্থায়িত্বটুকুই জীবনের সবচেয়ে প্রেমময় মুহূর্ত। বাবার এই চিন্তার প্রতিবিম্বে আবীর দেখতে পায়, ঐ নৌকা ভ্রমণে বাবার বুকে মাথা রেখে 'বাড়ি ফেরা'; তার জীবনের সবচেয়ে প্রেমময় আর অর্থপূর্ণ মুহূর্ত।

এই নাটকের সংলাপে নানা জায়গায় যে দৃশ্যকাব্য রচিত হয়; তা যেন প্রেম ও প্রকৃতির ক্যানভাসে এক গভীর বোধের উন্মেষ ঘটায়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগের যে দর্শন বাবার কাছ থেকে পেয়েছে আবীর; তা তাকে পিছুটান ফেলে জীবনকে দেখার চোখ দিয়েছে; আবার মায়ার কাছে ফিরে আসার আকুলতা দিয়েছে। এই দ্বৈতদ্বন্দ্বই বুঝি জীবন।

এই স্মৃতিঘন নাটকের নাট্যকার বুলবুল হাসান 'আবীর' চরিত্রে অভিনয় করেছেন; অশরীরী বাবার ছায়াকন্ঠে অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু। অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা গল্পটির অন্তঃসলিল প্রবাহের আবহ সৃষ্টি করেছেন আন্তরিকতার সঙ্গে।

উইলিয়াম ব্লেক-তার কাব্য চর্চায় 'সংস অফ ইনোসেন্স' থেকে 'সংস অফ এক্সপেরিয়েন্স'; জীবনের সংগীতকে এই দুই ভাগে ভাগ করলেও; ‘নো ম্যানস স্কাই’ দর্শককে সংস অফ এক্সপেরিয়েন্সের কঠোর বাস্তবতায় বসে ফিরিয়ে এনেছে যেন জীবনের নির্মল সংগীতে।

নির্দেশক সৈয়দা সায়মা আহমেদের কুশলতায় মঞ্চেই তৈরি হয়েছে স্মৃতির চিত্রকল্প তৈরির পরিবেশ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র লন্ডন, বাংলাদেশের একটি গল্পকে উপস্থাপন করেছে বিশ্বমঞ্চে সবার জন্য উন্মুক্ত আকাশে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত