নিজস্ব প্রতিবেদক

২৭ ফেব্রুয়ারি , ২০১৯ ০১:১৬

বীরাঙ্গনার বয়ানে ভয়াল ৭১

মহান একুশের আলোকে ১৪ দিনব্যাপী নাট্য প্রদর্শনী

হলের ভিতর পিন পোতন নীরবতা। সকল নীর মহান একুশের আলোকে নাট্যপ্রদর্শনীবতার অবসান ঘটিয়ে মঞ্চে স্পটলাইটের আলোয় আবিষ্কার হলেন একজন অর্ধ বয়স্ক নারী। এসেই উপস্থিত দর্শকদের সালাম দিয়ে জানালেন নিজের পরিচয়। বললে, আমার নাম হালিমা বেগম। সাকিন যশোর জেলা। আজ আপনারা আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দিয়ে যত ভাবে সম্মানিত করেছেন এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আজ এখানে এসে দেখলাম হাজার হাজার জাগরণী জনতা। আপনারা আমারে মায়ের আসনে বসাইয়া সম্মান দিছেন, এইটা আমি কখনো ভাবিনাই। এখন মনে হইতাছে আমি কথা কয়োনের একটা উপযুক্ত জায়গা পাইছি। তাই ছুইটা আইছি আপনাগো কাছে। এই বীরাঙ্গনা মাতার বয়ান হুনাইতে। তখন সালটা ২০১৩। হেই ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখ থাইকা আপনারা যুদ্ধ শুরু করছেন। আপনারা কেমন আছেন হেই কথা জিগাইবার দুঃসাহস আমার নাই। কারণ আমি জানি যুদ্ধের ময়দানে যোদ্ধারা কেমন থাকে।' এ ভাবে একে একে বীরাঙ্গনা এ নারী গণজাগরণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে যেন বলতে থাকেন স্বাধীনতা যুদ্ধের করুণ কাহিনী। রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকা এ নারীর জবানীতে ফুটে ওঠে ভয়াল ৭১।

মঙ্গলবার (২৬ ফেব্রুুয়ারি) সন্ধ্যায় সম্মিলিত নাট্য পরিষদের মহান একুশের আলোকে ১৪ দিনব্যাপী নাট্য প্রদর্শনীর ২য় দিন নবশিখা নাট্যদলের পরিবেশনায় নাটক বীরাঙ্গনার বয়ান যেন স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বাস্তব দলিল। মঞ্চে দাঁড়ানো এক জাতীর গৌরবের খেতাব বীরাঙ্গনা মাতার কথার সাথে মঞ্চে দৃশ্যায়ীত হয় মুক্তিযুদ্ধের করুণ কাহিনী। উপস্থিত দর্শকদের চোখের সামনে যেন তখন স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীদের প্রতি নির্যাতন আর ভয়াবহ যন্ত্রণার সে দৃশ্য। নয়নাভিরাম এ নাটকের শেষাংশে বীরাঙ্গনা মাতা প্রলাপের মতো বলতে থাকেন, 'মিলিটারি আর রাজাকারের নির্যাতনে কখন যে কবর খুড়া শুরু করলাম তা মনেই রাখতে পারি নাই। তাঁর পর থাইকা কবর খুড়তেই আছি। এই জে আমার মায়ের কবর, আমার ভাইয়ের কবর, আমার স্বজনের কবর, এই যে আমার মত নির্যাতিতা নারীর কবর।' এক পর্যায় প্রশ্ন করেন ' সবার কবরতো খুঁড়লাম, আমার কবর খুড়বো কেডা?'

হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য দিয়ে শেষ হওয়া নাটকের শেষ পর্যায় যতদিন পর্যন্ত দেশের সকল যোদ্ধাপরাধিদের বিচার না হয় ততদিন পর্যন্ত জাগরণী জনতাকে ঘরে না ফিরার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিয়া সমাপ্তি হয় নাটকের।

দর্শক মুগ্ধতায় শেষ হওয়া এ নাটকের শেষে দর্শক জাকির হোসেন নামের একজন বলেন, 'মঞ্চনাটক আমি নিয়মিত দেখি। ছাত্র হিসেবে টিকেট কিনে নাটক দেখা অনেকটা কষ্টসাধ্য বিষয় হলেও কোন নাটক দেখে যখন ভালো লাগে তখন মনে তৃপ্তি অনুভব করি। আজও তাই হয়েছে। একজন বীরাঙ্গনা মাতার বক্তব্যের মধ্যদিয়ে নাটকের দৃশ্যায়নের কৌশলটি ছিলো চমৎকার।'

নাট্যকার রওশন জান্নাত রুশনী'র রচনায়, খুরশেদুল আলম'র নির্দেশনায় ও রকিবুল হাসান রুমনের সহ নির্দেশনায় নবশিখা নাট্যদলের এ নাটকের এটি ছিলো প্রথম মঞ্চায়ন। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রকিবুল হাসান রুমন, তন্ময় বনিক, রাহেল আহমদ, প্রান্ত বনিক, ধ্রুবেশ দাশ অর্ন, অর্জুন সূত্রধর, সিথী চক্রবর্তি, প্রিয়াঙ্গকা চক্রবর্তী, আবু সুফিয়ান নাঈম, সন্দিপ চক্রবর্তী, বর্ণা চক্রবর্তী প্রমুখ। নাটকের আলোক পরীকল্পনা করেছেন হুমাইয়ুন কবির জুয়েল আর আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন ইয়াকুব আলী।

এদিকে নাটক শেষে সম্মিলিত নাট্য পরিষদের পক্ষ থেকে নবশিখা নাট্যদলের সদস্যদের হাতে অংশগ্রহণমূলক স্মারক তুলে দেয়া হয়। এসময় উপস্থিত হয়ে উৎসব স্মারক তুলে দেন সাবেক সংসদ সদস্য জৈবুন্নেছা হক। এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাবেক প্রধান পরিচালক ব্যারিষ্টার আরশ আলী, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু, সাধারণ সমাপদক রজত কান্তি গুপ্ত।

এসময় জৈবুন্নেছা হক নাটকের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, দর্শক সারিতে বসে আমার চোখের সামনেই যেন ৭১ সালের সেই ভয়াবহ দিগুলো ভেসে উঠছিলো। কান্নাজড়িত কন্টে নবশিখা নাট্যদলের সকল কর্মীদের সাবলিল অভিনয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আজ যারা তরুণ তাদেরকেই এই দেশকে কলঙ্কমুক্ত করার প্রত্যয় নিতে হবে। যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের মাধ্যমে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে সকল তরুণকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জেনে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

এছাড়াও আজ নাট্য প্রদর্শনী ৩য় দিন বুধবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হবে নাট্য নিকেতনের নাটক 'ভূমিকন্যা'। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন চম্পক সরকার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত