জুয়েল রাজ

০৭ জুলাই, ২০২০ ১২:৪২

একজন এন্ড্রু কিশোরের সাথে আমাদের বেড়ে ওঠা

ডিজাইন: অরুপ বাউল

এক অজপাড়াগাঁ আমার জন্মমাটি। ঠিক মনে নাই। একদিন আমাদের কাকাবাবু মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে ফিরলেন। তার বাড়ি ফেরার স্মৃতি আবছা আবছা মনে আছে। বাড়ি জুড়ে উৎসব। আমাদের জন্য বিদেশী জামাকাপড়, সাবান, শ্যাম্পু, পারফিউম, কত কিছু। পুকুর ভেসে যায় সুগন্ধিতে।

কাকাবাবু, সাথে নিয়ে আসলেন, বড় একটা টেপ রেকর্ডার, ইয়াসাকি ফটো ক্যামেরা আর সাথে ত্রি ব্যান্ডের প্যানাসনিক রেডিও। খয়েরি চামড়ার মোড়কে মোড়ানো তিন ব্যাটারির দুইটা রেডিও। আয়োজন করে সেই টেপ রেকর্ডে লতা, মোহাম্মদ রফিসহ ব্যাগ ভর্তি ক্যাসেটের গান শোনা হত। গ্রামে বিদ্যুৎ নাই তো সেই ব্যাটারি চার্জ করে গান শোনা খুব বেশী দীর্ঘায়িত হয়নি।

বিজ্ঞাপন

এরপর সাথী হয় রেডিও। বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা, আকাশবাণীর সংবাদ শুনতেন কাকু। গভীর রাতে ঘুমিয়ে পড়তাম পাশের ঘরে রেডিওর নাটক শুনে শুনে অথবা সৈনিক ভাইদের অনুষ্ঠান দুর্বার শুনে শুনে।

ওই বয়সেই নামগুলো শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে যায়। এন্ড্রু কিশোর-রুনা লায়লা, এন্ড্রু কিশোর-সাবিনা ইয়াসমিন, এন্ড্রু কিশোর-সামিনা চৌধুরী, সৈয়দ আব্দুল হাদী, এম এ খালেক, খুরশীদ আলম, রফিকুল ইসলাম, আজাদুর রহমান, ফারুক চৌধুরীসহ অসংখ্য নাম।

আমাদের প্রিয় বেবি লজেন্স সঙ্গীতমালা। কিংবা কাঠফাটা দুপুরে, হ্যা ভাই আসিতেছে রুপালী পর্দায়...

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ভরাট কন্ঠ আর সিনেমার গান। এই তো আমাদের বিনোদন। আমি আর দাদামনি, আমার কাকাতো ভাই এসবের একনিষ্ঠ শ্রোতা।

বছরে এক দুইদিন গরু রাখালের ছুটি থাকত। আমরা দুই ভাই সেই দিন মাঠে গরু চড়াতে যেতাম। সঙ্গী থাকতো আমাদের রেডিও।

তখন তো আর হিট-সুপারহিট এই সব আর বুঝি না আমরা। যে সুর কানে বাজে, মনে টানে সেই গান বাজলেই ভালো লাগত। অনুরোধের আসর গানের ঢালি শোনার অপেক্ষায় থাকতাম আমরা।

''আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে, চোখের জলে আমি ভেসে চলেছি, আমার বুকের মধ্যখানে মন যেখানে, এক চোর চলে যায়, মন চুরি করে, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, ওগো বিদেশিনী, তোমার চেরী ফুল দাও, তুমি আজ কথা দিয়েছো বলেছো, পৃথিবীর যত সুখ তোমার ছোঁয়াতে, এরপরই আসে বেদের মেয়ে জোসনার যুগ..., বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে, অহ রঙিলা মনে যে লাগে এতো রঙ কিংবা আজ রাত সারা রাত জেগে থাকব, চাঁদের সাথে আমি দেব না তুলনা, রুমাল দিলে ঝগড়া হয়, তুমি আজ কথা দিয়েছো, বলেছ, কিংবা, বেলী ফুলের মালা পরে, এক প্রেমিক, প্রেমিকাকে ঘরে তুলছে, ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া, করতে হবে এবার বিয়া..., তারও পরে পড়েনা চোখের পলক কি তোমার রুপের ঝলক।

এ যেন আমাদের সাথে গানগুলোও বেড়ে উঠে, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। আমাদের অনুভূতির সাথে, আমাদের বয়সের সাথে প্রতিযোগিতা করে না চাইলেও আমাদের কানে এসে পৌঁছে যায়। পুরোনো শিল্পী বা সেকেলে বলে ফেলে আসা যায় না।

ব্যান্ড, আধুনিক এসে আমাদেরকে অন্যভাবে রাঙিয়ে রাখে। রেডিও আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। জীবনমুখী গান আমাদের ভাবতে শেখায় নতুন করে। আমরা নাগরিক জীবনের বাতাসে ভাসি, উড়ি।

একজন এন্ড্রু কিশোরের সাথে আমাদের বেড়ে ওঠা। নাকি আমাদের সাথে সাথে এন্ড্রু কিশোর পথ চলেছেন!! এন্ড্রু কিশোর যেন আমাদের পিছু ধাওয়া করেন, সালমান-শাবনুর জুটির জনপ্রিয় সব গান, আমাদের কৈশোরকাল রাঙিয়ে তোলে।

তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই, তুমি মোর জীবনের ভাবনা, সাথী তুমি আমার জীবনে মরণে, তুমি আমার মনের মানুষ...., আমি যে তোমার কে কাছে এসে নাও বুঝে নাও।

খুব সম্ভবত ভুল সবই ভুল এলবাম দিয়ে অডিও জগতে ব্যাক করেন এন্ড্রু কিশোর, সুপার ডুপার হিট সেই ক্যাসেট। এখানে এসেও রাজত্ব করলেন তিনি।

অডিও শিল্পে যখন গেয়ে উঠেন মনে লয় গাঁয়ে ফিরে যাই। এ যেন আমার মনের কথা। বিরহে যখন সুর তুলেন লোকের কথায় যায় কি ভোলা ভালবাসি যারে, ভুলতে চাইলে আরো বেশী মনে পড়ে তারে রে বন্ধু মনে পড়ে তারে....

পনের হাজার গান! কয়টা লিখবো?

শুধু বাংলা সিনেমা নয়, হিন্দি সিনেমাতেও কন্ঠ দিয়েছেন তিনি, স্নেহ হয়ে ছিলেন আরেক সুরের যুবরাজ রাহুল দেব বর্মণের। চাইলে হয়তো সেখানেই স্থায়ী হতে পারতেন তিনি। কিন্তু ফিরে এসেছিলেন নিজের মাটির কাছে।
সেই মাটিতে আজ চির নিদ্রায় শায়িত এন্ড্রু কিশোর।

সব ইতিহাস পিছনে ফেলে বিদায় নিলেন সুরের যাদুকর....

আমাদের সুরের আকাশ ভরে দিয়ে গেছেন সেই তার সুরের যাদুতে। বাংলা গানে আরেক জন এন্ড্রু কিশোরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে হয়তো আরো শত বছর। শিল্পীর মৃত্যু নেই... তারা অমর।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত