মিহিরকান্তি চৌধুরী

০২ আগস্ট, ২০২০ ২৩:২৫

স্মরণ : সালেহ উদ দৌলা

সিলেটের বিশিষ্ট শিল্পপতি, শিক্ষানুরাগী, রুচিশীল ব্যক্তিত্ব ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী সমাজে এম এস দৌলা ও ঘনিষ্ঠ মহলে দানি মিয়া খ্যাত জনাব মো. সালেহ উদ দৌলা গতকাল (শনিবার) মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শুনেছি তিনি কোভিড-১৯ জটিলতায় ভুগছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে সমাজ একজন এক সৎ শিল্প উদ্যোক্তা, শিক্ষানুরাগী, রুচিশীল ব্যক্তিত্ব ছাড়াও একজন প্রকৃত ভদ্রলোককে হারালো। তাঁর শূণ্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি  আর প্রার্থনা করি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি  সমবেদনা জানাই।  

জনাব সালেহ-উদ দৌলা একজন চা-কর ছিলেন। স্থিতিশীল কর্মজীবনের প্রথম দিকে ন্যাশনাল টি কোম্পানির লাক্কাতুরা চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন। অন্য চা বাগানেও এ ধরণের পদে অধিষ্টিত ছিলেন। এক সময়ে তিনি তা ছেড়ে দেন। শুরু করেন ব্যবসা। সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর প্রচুর নামডাক ছিল। নীতির লোক ছিলেন। সা আই দৌলা এন্টারপ্রাইজ নামে সুনামগঞ্জে ফিস প্রসেসিং প্লান্ট ছিল তাঁদের। আঞ্চলিক অফিস সিলেটে ও হেড অফিস ঢাকায়। সিলেট শহরের হাওয়াপাড়ায় তাঁদের বাসার সাথেই অফিস ছিল। ইউরোপে হিমায়িত মাছ রপ্তানীর ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিষ্ঠান অগ্রগণ্য ছিল। সেখানে মানরু শপিং সেন্টারসহ বহু প্রতিষ্ঠানের মালিক, এশিয়ার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তিত্ব জনাব ইকবাল আহমেদের প্রতিষ্ঠান অন্যতম ক্রেতা ছিল। এক পর্যায়ে ছেলে এহতেমাদ-উদ দৌলা তুষান দায়িত্বপালনে সহযোগী হলে তাঁর ওপর চাপ কমে এবং তিনি আগের চেয়ে আরও বিচক্ষণতার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করেন।

জনাব দৌলা একজন ভালো সংগঠক ও উদ্যোক্তা ছিলেন। বিগত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সিলেট লায়ন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তখন সিলেটে লায়ন্স ক্লাব ছিল মাত্র দুটা- পুরুষদের সিলেট লায়ন্স ক্লাব ও মহিলাদের সিলেট লায়নেস ক্লাব। কিছুদিন পর সুরমা লায়নেস ক্লাব আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীকালে অন্যান্য ক্লাবের প্রতিষ্ঠা ।বাছা বাছা লোক, ডাকসাইটে যাকে বলে ছিলেন ক্লাবের সদস্য। সিলেট লায়ন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন, গ্রহণ করেন বেশ কিছু প্রকল্প। শিক্ষানুরাগী ছিলেন। নীরবে নিভৃতে অনেক ছাত্রছাত্রী সাহায্য পেয়েছে। দানি মিয়া নাম ছিল তাঁর। এ যেন বাস্তবের এক ’দানী মিয়া’। কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথেও জড়িত ছিলেন।   

এলাকায় তাঁর একটা বিশেষ ভাবমূর্তি ছিল। সর্বজনশ্রদ্ধেয় ছিলেন। সামাজিক সংগঠন-প্রতিষ্ঠানেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন হাওয়াপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি। তাঁর দিকনির্দেশনা যে কোনও প্রতিষ্ঠানকে বেগবান করত।

জনাব সালেহ উদ দৌলা আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বহুমাত্রিক সম্পর্ক ছিল তাঁর সাথে- বন্ধু, বড় ভাই, ছাত্র অভিভাবক এবং সর্বোপরি একজন শুভাকাঙ্খী। গতকাল রাতে আমার প্রিয়ভাজন ছাত্র ও জনাব দৌলার ছেলে তুষানের বন্ধু-সহপাঠী ডাঃ তৌফিক এলাহী চৌধুরীর কাছ থেকে পাওয়া ফেসবুক মেসেঞ্জারে এই দুঃসংবাদ পেয়ে এই প্রিয়জনের বিদায়ে অনেকটা বাকহারা হয়ে যাই। গভীর রাতেই তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দুচারটি কথা লিখতে বসি। কলম ধীর গতিতে চলে। বারবারই মনে পড়ে যায় অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, নিরহংকারী এই নিকটজনকে। তাঁর মেয়ে ফারাহ সুরাইয়া ও ছেলে এহতেমাদ-উদ দৌলা তুষান আমার ছাত্র ছিল। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রী ছিল তাঁরা। ১৯৮৬ সাল থেকে ফারাহ ও পরের বছর ১৯৮৭ সাল থেকে তুষান আমার ছাত্র। মানুষ প্রতিষ্ঠিত হলে নামডাক ছড়ায়। ছাত্রাবস্থায়ও যে নামডাক ছড়াতে পারে ফারাহ সুরাইয়া তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় অসাধারণ ভালো ফলাফল করে ফারাহ ডাক্তার হয়েছে। বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে। তুষানও ভালো ফলাফল করে বাবার শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায় যোগ দিয়েছে। তুষান ছোট বয়স থেকেই ক্রিকেট বুঝত ও ভালোবাসতো মনপ্রাণ দিয়ে। এখনও মনে আছে ১৯৮৭ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময়ের কথা। কত আলোচনা, কত বিশ্লেষণ প্রত্যেকটা ম্যাচ নিয়ে । ৮ নভেম্বর ১৯৮৭ ইডেনে ফাইনাল খেলা দেখতে আমি ও  তুষান টিকিট ও হোটেলের ব্যবস্থা করেছিলাম। টিকিটের ব্যবস্থা আমি করেছিলাম। আর হোটেল বুকিং এর যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন তুষানের বাবা জনাব দৌলা। এমনই ছিল তাঁর প্রেরণা ও উৎসাহ দেওয়ার অসামান্য গুণ। আশা ছিল ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল খেলা দেখার । প্রথম সেমিফাইনালে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া পাকিস্তানকে এবং দ্বিতীয় সেমিফাইনালে বোম্বের (মুম্বাই) ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ড ভারতকে হারিয়ে দিলে কলকাতার হোটেল ব্যবসা থেকে শুরু করে টিকিটের কালোবাজার সবকিছুই মার খায়। ঢাকা থেকে খেলা দেখতে কয়েকজন ক্রীড়ামোদীর দমদম বিমানবন্দর পর্যন্ত প্লেন চার্টার করা ছিল। সেটিও বাতিল হয়। আমরাও যাইনি। ৮ নভেম্বর ফাইনাল খেলা টিভিতে দেখেছিলাম।  জনাব দৌলাকে ‘দৌলা ভাই’ ডাকতাম। দৌলা ভাইয়ের সাথে আরও কত যোগাযোগ ছিল তার শেষ নেই। আশির দশকে সিলেট লায়ন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ক্লাবে যোগ দিতে আগ্রহী কি না। আমি বিনয়ের সাথে তাতে সাড়া দিইনি। আমি বলেছিলাম, আমি শিক্ষকতা করি। আমার জায়গা থেকেই আমি সমাজসেবা করতে চাই। তাছাড়া, লায়ন্স ক্লাবে যোগ দিতে প্রয়োজনীয় আমার বার্থ সার্টিফিকেট যে কালো ও ছেড়া তাও তাঁকে দেখাই। তারপর তিনি আর কিছু বলেননি। শুধু বললেন, ‘অনেক কিছুই বলে গেলেন খুব কম কথা যে বলে’। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, পছন্দ করতেন, সায় দিতেন। একজন ভালো পাঠক ছিলেন। অনেক নামকরা লেখক ও বইয়ের রেফারেন্স তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। আশির দশকে বাংলাদেশের নামকরা কর্পোরেট হাউসগুলোর প্রকাশিত দর্শনীয়, অত্যন্ত মানসম্পন্ন ক্যালেন্ডার আমাকে উপহার দিতেন। সাথে থাকতো দামী, রুচিশীল ডায়েরি। আশির দশকের ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি ক্রেজ ২০২০ সালে অনুমান করা যাবে না। তাছাড়া, তিনি আমাকে তিন খণ্ডের “The Reader’s Digest Great Encyclopaedic Dictionary” এবং “Britain” ও “America” শীর্ষক দুটি pictorial documentary উপহার দিয়েছিলেন। অসাধারণ কালেকশন। ১৯৮৬ সাল থেকে এখনও সেগুলো সযত্নে আছে। তাঁর স্মৃতি হিসেবে আমৃত্যু থাকবে।

জনাব সালেহ উদ দৌলার সহধর্মিনী মিসেস সুরাইয়া দৌলা সিলেট শহরের ব্লু বার্ড স্কুলের জনপ্রিয় মেধাবী শিক্ষক ছিলেন। তাঁর সাথেও ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল আমার। ‘সুরাইয়া’ নামটি আমার কাছে ‘বোন’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এক দিকে ছিলেন মিসেস সুরাইয়া রাজা চৌধুরী আর অন্যদিকে ছিলেন মিসেস সুরাইয়া দৌলা । আমার ও আমাদের সিলেটে আসা, এখানকার সমাজের সাথে যুক্ত হওয়া, আমার শিক্ষকতায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া, স্বীকৃতি পাওয়া ইত্যাদির পেছনে প্রথম পর্যায়ে বেশ কয়েকজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বের অবদান আছে। ১৯৮৪ সালে প্রথম পর্যায়ে ছিলেন মিসেস সুরাইয়া রাজা চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী, Blue Bird School এর (পরবর্তীতে স্কুল ও কলেজ) অধ্যক্ষা মিসেস রাবেয়া খান আহমেদ, মুরারিচাঁদ কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মাহবুব আহমেদ ও আমার ভাগ্নির জামাই কানুমামা বা হিমাংশু পুরকায়স্থ। ১৯৮৬ সালে পরিচয়ের পর থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিলেন জনাব সালেহ উদ দৌলা, মিসেস সুরাইয়া দৌলা, জনাব নওয়াব আলী, মিসেস রিহানা আলী, জনাব আবুল হাসনাত চৌধুরী ও মিসেস রুহেনা হাসনাত চৌধুরী। আলী দম্পতি ও হাসনাত দম্পতির ছেলেমেয়েরাও অসাধারণভাবে মেধাবী ছিল। উল্লেখ্য, তার আগে ১৯৮০ সালে   আমার বাবার মৃত্যুর পর আমাকে শাহবাজপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ দিয়েছিলেন আমার শিক্ষাগুরু জনাব আছদ্দর আলী ও বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট তবারক হোসেইন। আমি তাঁদের সকলের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আছি, থাকব।

১৯৮৭ সালে আমার প্রতিষ্ঠান একাডেমি অব টু আরস থেকে পুষ্পপ্রদর্শনীর আয়োজন করি। জনাব সালেহ উদ দৌলা, মিসেস সুরাইয়া দৌলা ও তাঁদের ছেলে তুষান অসাধারণ মানদণ্ডে সহযোগিতা করেছেন। মিসেস সুরাইয়া রাজা চৌধুরী ও তাঁর ছেলেমেয়েরা এই সহযোগিতায় যুক্ত ছিলেন। জনাব সালেহ উদ দৌলার এক সময় লাল রংয়ের একটি সুবারু কার ছিল। সেই গাড়ী কতবার চড়েছি তার শেষ নেই। শহরে শত শত গাড়ীর মধ্যে চার পাঁচটা গাড়ীর রং, হর্ন এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কানে বাজে। এর মধ্যে একটা ছিল জনাব দৌলার লাল রংয়ের সুবারু কার। বাকীগুলোর মধ্যে ছিল মিসেস সুরাইয়া রাজা চৌধুরীর টয়োটা স্প্রিন্টার, ইউনাইটেড সেন্টারের জনাব আব্দুল মতিন খানের কমলা রংয়ের টয়োটা করোলা, অধ্যাপক মাহবুব আহমেদ স্যার ও অধ্যাপক বিজিতকুমার দে স্যারের টয়োটা টু ডোর পাবলিকা। এগুলোকে অন্তত আধ মাইল দূর থেকে চিনতাম। কখনও স্নেহের খাতিরে কখনওবা বন্ধুত্বের খাতিরে এগুলোতে ছিল প্রবেশাধিকার, ছিল ব্যবহারাধিকার।

জনাব সালেহ উদ দৌলার সাথে কত সময় কাটিয়েছি গল্প করে বিশেষ করে আশির দশকের এরশাদীয় যুগের হরতালের দিনগুলোতে। আমি শিক্ষকতা নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম কিন্তু তাঁর সাথে গল্প করার সময় ঠিকই বের করে নিতাম। ভালো ভালো অনেক খাবার খেয়েছি। এক একটা সেশনকে মনে হতো এক একটা ক্লাস। অনেক সুন্দর বাচনভঙ্গি ছিল তাঁর । প্রতিবারই নতুন কিছু শেখার সুযোগ ছিল। এতো হাসিখুশি লোক জীবনে কম দেখেছি। মাথায় টাক ছিল কিন্তু অসাধারণ এক হাসিমুখ সব শূণ্যতাকে ভরাট করে দিত। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মতো ব্যক্তিত্বদের ঘিরেই সম্ভবত প্রবাদ এসেছে, ‘face is the index of the mind’। চেহারের সাথে মিল ছিল অসাধারণ সুন্দর এক মনের। আমাকে অনেক যশস্বী লোকের সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন, কখনও ব্যক্তিগতভাবে, কখনও বা ফোনে। তাঁর মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, জনাব ইকবাল আহমেদ প্রমূখ। মানরু শপিং সিটির উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন। মালিক বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব ইকবাল আহমেদও এসেছিলেন। ওই উদ্বোধন উপলক্ষে সিলেট বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চার বিষয়ে চার বিভাগে রচনা প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয়। জমা পড়ে হাজার দুয়েক রচনা।  জনাব ইকবাল আহমেদের পক্ষে জনাব সালেহ উদ দৌলা আমাকে এই প্রকল্পের সমন্বয়ক করে অনুরোধ করলেন আরও দুইজন পরীক্ষক নিয়ে তিনজন মিলে  যেন এই কাজটি করে দিই। আমি  দুইজন সম্মানিত ব্যক্তিকে নিয়ে কাজটি সুসম্পন্ন করি । উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ছিল আমাদের বিশেষ আমন্ত্রণ। গেলাম। বেশ কিছু উপহার সামগ্রী মিলল । উপহার সামগ্রীগুলোর বস্তুগত মূল্যের চেয়ে সাম্মানিক মূল্য ছিল বেশি । অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন ও জনাব ইকবাল আহমেদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন যা ছিল এক ‘inflationary introduction’। যা নই তাও বললেন। স্নেহ থেকে, শুভেচ্ছা থেকে আপনজনকে মানুষ এভাবেই করে। নবজাত শিশু কুৎসিৎ হলেও তার প্রশংসা করার রেওয়াজ আমাদের সমাজ বা ইউরোপীয় সমাজে দীর্ঘদিনের। বিয়ের কন্যাও কালো হয় না। আমি নবজাত কুৎসিৎ শিশু বা বিয়ের  কালো কন্যার মতো হয়েও আমার ভাগ্যে অনেক প্রশংসা জুটলো। যশস্বী ব্যক্তিত্বদের সাথে পরিচিত হতে পেরে যারপর নাই আনন্দিত হলাম। জনাব ইকবাল আহমেদকে বিদায় জানাতে পরদিন বিমানবন্দরেও গিয়েছিলাম। দৌলা ভাইয়ের সাথে যেকোনও পরিবেশে যেকোনও সেশন সবসময়ই উপভোগ্য ছিল। সর্বশেষ দেখা হয় কয়েক মাস আগে সিলেট স্টেশন ক্লাবে ডাঃ শেখর চৌধুরী দাদা ও পাঞ্চালী চৌধুরী পান্নাদির মেয়ে অনন্যা চৌধুরী পূর্বা ও জামাতা সুমিতের বিবাহোত্তর সংবর্ধনায়। দৌলা ভাই, সুরাইয়া আপা দুজনের সাথেই দেখা। উভয়ের সেই ব্রান্ড হাসি, কুশল জিজ্ঞাসা, ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর নেওয়া- সবকিছু। ভদ্রতার ষোলকলা পূর্ণ করে তাঁদের প্রতিটি চলা আমাদের প্রাণিত করে।

২০০৩ সালে আমার প্রতিষ্ঠান একাডেমি অব টু আরস থেকে সিলেটের দশ জন গুণি ব্যক্তিত্বকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। বিশিষ্ট দানবীর ও সমাজসেবক জনাব মহিউস সুন্নত চৌধুরী অন্যতম সংবর্ধিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। জনাব মহিউস সুন্নত চৌধুরীকে সংবর্ধনার প্রস্তাব ও আমন্ত্রণে জনাব সালেহ উদ দৌলা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি আমাকে জনাব মহিউস সুন্নত চৌধুরীর যোগ্য উত্তরসুরি তাঁর ছেলে জনাব সাফওয়ান চৌধুরীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমাদের সৌভাগ্য জনাব সাফওয়ান চৌধুরী আমাদের প্রস্তাব ও অনুরোধে খ্যাতিমান বাবার পক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সংবর্ধনা গ্রহণ করেন।

জনাব সালেহ উদ দৌলা ও তাঁর সহধর্মিনী মিসেস সুরাইয়া দৌলা অসামান্যভাবে মানানসই এক দম্পতির নাম। মেয়ে ফারাহকে দিয়েছেন তার মায়ের নাম, ‘সুরাইয়া’ (ফারাহ সুরাইয়া) আর ছেলেকে দিয়েছেন নিজের নাম দৌলা (এহতেমাদ-উদ দৌলা)। আবেগের এমন সুন্দর ভাগবাটোয়ারা কমই দেখা যায়। তাঁদের সাথে আন্তরিকভাবে মিলেমিশে দেখেছি, দুজনের চিন্তাভাবনা, রুচিবোধ থেকে শুরু করে সবকিছুই এক মানদণ্ডের। প্রবাদ আছে, ‘রাজা জন্মিতে রানী’। এটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাড়াবে, ‘made for each other’। জনাব দৌলার  সফলতার পেছনে তাঁর সহধর্মিনী মিসেস সুরাইয়া দৌলার মতো একজন গুণি মহিলার অবদান অনেক। এক সময় জনাব দৌলা কঠিন কিছু সময়ও কাটিয়েছেন। তখন মিসেস সুরাইয়া দৌলার যে সাপোর্ট পেয়েছেন তা তাঁকে সম্ভাব্য কম সময়ে সেই দুঃসময়কে অতিক্রম করতে সাহায্য করেছিল। মিসেস দৌলা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে হাল ধরেছিলেন। আমার জানা মতে  মিসেস সুরাইয়া দৌলা পশ্চিমবঙ্গের অত্যন্ত শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান এক পরিবারের সন্তান। এদিকে জনাব সালেহ উদ দৌলার প্রোফাইলও সেইরকম  ছিল।
 
জনাব সালেহ উদ দৌলা অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে থাকলে নিজেকে নানা বিবেচনায় সুরক্ষিত মনে হতো। আমার প্রোফাইল ছোট। শুধু শিক্ষক হিসেবে মোটামোটী একটা পরিচিতি আছে । আমার কর্মপ্রচেষ্টায় সমাজের প্রেরণা, উৎসাহ ও সায় ছিল। জনাব সালেহ উদ দৌলা তাঁদের অন্যতম। শিক্ষককে বলা হয় ছাত্র গড়ার কারিগর। জনাব সালেহ উদ দৌলার মতো ব্যক্তি শিক্ষক গড়ার কারিগর।

জনাব সালেহ উদ দৌলার শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়। বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আবারও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

মিহিরকান্তি চৌধুরী: লেখক, গবেষক, অনুবাদক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত