শ্রীনিবাস দে

২১ অক্টোবর, ২০২০ ২৩:৪২

করোনা যুদ্ধে আমি জিতেছি, আপনারাও জয়ী হবেন

আমি শ্রীনিবাস দে, সিলেট  মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের অধ্যক্ষ পদ হতে বিংশ শতাব্দীর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অবসরজনিত ছুটিতে যাই| প্রায় কুঁড়ি বছর পূর্বে অবসর যাওয়ায় আমি বর্তমানে একজন প্রবীণ স্তরের নাগরিক।

শিশুকালে আমার একবার ব্রোঙ্কো নিউমোনিয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে ছাত্র জীবন ও কর্মজীবন আমি অনেকটা সুস্থ কাটিয়েছি| কিন্তু সত্তরের দশক হতে আমার আবার ব্রনকাল সমস্যা দেখা দেয়| বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমাকে এন্টিবায়োটিক ওষুধ দেয়ায় আমি সুস্থ হয়ে যাই, তবে আমাকে সতর্ক করে দেয়া হয় আমি যেন সব সময় মৃদু গরম জল দিয়ে স্নান করি, কোনো কারণে আমার ঠান্ডা লাগলে আবার ব্রোঙ্কো সমস্যা দেখা দিবে ফলে পরিণতি খারাপ হতে পারে|

আমি যেমন শীত কাতর তেমনি গরম সহ্য করতে পারি না| শীতের সময় বিভিন্ন প্রকারের শীত বস্ত্র দিয়ে যেমন শীতের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি তেমনি গরমের সময় অত্যধিক ঘেমে গিয়ে সব কাপড় ঘামে ভিজে গিয়ে ঠান্ডা লেগে যায়! এভাবে ঘেমে ঠান্ডা লেগে কাশি হয়ে গত কয়েকটি বছর ধরে ডাক্তারের শরণাগত হতে হয়েছে। আবার সেই সতর্ক বাণী, সাবধানে থাকতে  হবে! ইদানিং, গত আগস্ট মাসের শেষ দিকে আমার আবার কাশি হয়, মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্টও অনুভব করি, সাথে শরীর একটু গরম অনুভূত হচ্ছিলো| ওষুধ খাওয়াতে জ্বর কমলেও কাশি থেকে যায়| আর খুব দুর্বল হয়ে পড়ি| বর্তমানে করোনা ভাইরাসের রাক্ষসী আক্রমণে বিশ্বব্যাপী মহামারী দেখা দিয়েছে| আমি এই কঠিন সময়ে সচেতনতা'র সাথে দু তিন দিন পর পর  আমার বাড়ির প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সরকারি দুগ্ধ খামার থেকে দুধ আনতে যাই| শরীর কিছুটা দুর্বল থাকায় আস্তে আস্তে যদিও হেঁটে যাই কিন্তু প্রায় সময় আমি ঘেমে ভিজে কিংবা বৃষ্টিতে একটু ভিজে যাই| আমি যেন মাঝে মাঝে জ্বর অনুভূত হয় আর কাশি যেন ছাড়ছে না| আর খাবারের কোনো উৎসাহ নেই| আমার ছোট মেয়ে ডাক্তার, ইউকেতে থাকায় আর আমার আরেক আত্মীয় ডঃ দেবাশীষ কর পিলু, আর আমার ভাগিনা লিটনের সহায়তায় আমি দুর্বার শরীর নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাই| ডাক্তার আমার রক্ত পরীক্ষা আর এবং ফুসফুসের সিটি-স্ক্যান করেন, আর এই রিপোর্টে আমার ফুসফুস সংক্রমণ ধরা পড়ে| বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমার রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট, সিটি স্ক্যান এর প্লেট আর আর আমার শারীরিক অতি  দুর্বলতা দেখে কোনো ওষুধ না দিয়ে, কভিড-১৯ সন্দেহে আইসোলেশন সেন্টারে যাবার নির্দেশ দেন| সিলেটে দুটো জায়গাতে আইসোলেশন সেন্টার আছে আমি তার মাঝে আখালিয়াতে অবস্থিত মাউন্ট এডোরাতে ভর্তি হই|

১৪ সেপ্টেম্বর সোমবার, দুপুর সাড়ে বারোটায়, আমার সমন্ধির ছেলে পার্থ, আর ভাগিনা লিটন আমাকে নিয়ে ওই নার্সিং হোম এ নিয়ে গিয়ে সকল ফর্মালিটিজ পালন করে প্রায় দুপুর আড়াইটায়, আমাকে আইসোলেশন  ইউনিট এ  নিয়ে যায়| আমাকে করোনা ভাইরাস রোগীদের মাঝে HDO (Highly Dependency Unit ) এ বেড নম্বর ৪ এ স্থান দেয়া হয়| আমার চারিদিকে করোনা আক্রান্ত বিভিন্ন পর্যায়ের রোগী, কারো কিডনি আক্রান্ত, কারো বা ফুসফুসে সংক্রমণ, কারো গলায় ব্যথা, কেউ বা চিৎকার দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করছেন! এসব দেখে মনে শঙ্কা হচ্ছে! আমি কি আমার নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে পারবো? আমার ফুসফুসে নিউমোনিয়া'র সংক্রমণ হয়েছে, মানব দেহে ফুসফুস, কোভিড-১৯-এর বড় প্রিয় বাসস্থান। আমার বয়স হয়েছে, আর এই বয়সে ফুসফুস দুর্বল থাকলে করোনা ভাইরাস সহজে ফুসফুসে প্রবেশ করে জীবন সংশয় ঘটায়, আমি বেডে শুয়ে ঈশ্বরকে স্মরণ করছি| বাড়িতে আমার স্ত্রী অসুস্থ অবস্থায় রয়েছেন-চলাফেরা করতে পারেন না| আমার স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন সবাই আমার জন্য খুব উদ্বিগ্ন| পার্থ, লিটন সবসময় প্রয়োজনীয় কাজ করে চলছে, পার্থ কিছুদিন ধরে সব বাজার করে দিচ্ছে আর আজকে শুরু হলো আমাকে নিয়ে আরেক দৌড়াদৌড়ি। লিটন আমাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে নিয়ে এসে বাইরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের অপেক্ষা করছে। সন্ধের পর ডাক্তার আসবেন -তখন কি ব্যবস্থা নিবেন, ওটা জেনে ও বাড়ি ফিরবে| অন্যান্য রোগীদেরও আত্মীয়স্বজনেরা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন| বিকেল বেলা ওয়ার্ডের সব রোগীদের বাক্সে প্যাক করে জাউ-ভাত দেয়া হয়। আর আইসোলেশন ওয়ার্ডের রোগী হিসেবে আমিও খাবার পাই| ইতিমধ্যে সিস্টার, নার্স ওরা এসে আমার রক্তচাপ, শরীরের তাপমাত্রা রেকর্ড করে নেয়| ওয়ার্ডের বিচিত্র পরিবেশে আজ আমি স্থান পেয়েছি, এতে আমার মন ভরাক্রান্ত| কখন যে কি হয়! এই পরিবেশেই, সন্ধ্যার প্রাক্কালে, ওদের দেয়া খাবার খেয়ে নেই, আমাকে বেঁচে থাকতে হলে দুর্বলতা কাটাতে হবে, খাওয়া দরকার! বেডে শুয়ে শুয়ে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করার চেষ্টা করছি আর চারিদিকে বিভিন্ন প্রকারের দুঃখের মৃদু আওয়াজ শুনছি! আমার কি অবস্থা হবে, আমি শংকিত! এ পরিবেশে মনোবল রাখা কতোটা সম্ভব -ভেবে দেখুন!

সন্ধ্যের পর ডাক্তার ওয়ার্ড ভিসিটে এসে, আমার অবস্থা অন্যান্য রোগীদের চাইতে ভালো বলে আমাকে আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে আইসোলেশন কেবিনে নেবার সিদ্ধান্ত নেন, নতুবা অন্য রোগীদের কারণে আমার ক্ষতি হতে পারে, তার কিছুক্ষণ পর আমাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়| রাত আটটায় আমার মেয়ের বন্ধু  বিশিষ্ট সমাজসেবী ফারমিস, আমাকে দেখাশোনা করার জন্য রফিক নামের একটি ছেলেকে নিয়ে যায়, ফারমিসের এভাবে আসাটা আমাকে সত্যি অবাক করে! আইসোলেশন ইউনিটে বিশেষ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিয়ে আসা ঠিক না, চারিদিকে করোনা আক্রান্ত রোগী| যাই হোক, এই মেয়েটাকেও আমি নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করি| রফিক দুটো রাত আমার সাথে ছিল|

কেবিনের বাইরে কান্নার আওয়াজ যেন নিত্য ঘটনা! আর আমি কেবিনের ভিতরে বসে সব শুনতে পাই| এক সন্ধ্যায়, আমার কেবিনের ঠিক পাশেই আইসোলেশন ওয়ার্ডে একজন নারী করোনা আক্রান্ত হয়ে পরপারে যাত্রা করেন, তার ছোট বড় মেয়েরা মৃত মাকে নিয়ে যাচ্ছে আর বিলাপ করে কাঁদছে| আমার অন্তরে মৃদু কম্পন হচ্ছে যেন! রফিকের পর, শাহাবুদ্দিন নামের আরেকজন, ওই হাসপাতালেরই কর্মী পাওয়া যায় আমার সাথে থাকার জন্য, যে কিনা ছুটিতে ছিল, আর খুব আন্তরিকতার সাথে ও আমাকে সেবা দিয়ে যায়| আমি ছোট বড় সবার কাছে অতি কৃতজ্ঞ। হাসপাতালে আমাকে ৪/৫ লিটার অক্সিজেন দেয়া হয়, হাতে ক্যানালির ব্যবস্থা করে ইনজেকশন দেয়া হয়| নাভির পাশেও ১৪ টি ইনজেকশন নিতে হয়| এ্যন্টি-ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া উভয় প্রকার জীবাণুর ইনফেকশনের চিকিৎসা শুরু হয়| ডাক্তার মামুন মিজানুর রহমান, ডাক্তার ইমদাদুল ইমদাদ, ডাক্তার আব্দুল্লা সানি, ডাক্তার আরিফুল হক আরিফ তারা সকলেই অতিসতর্ক ভাবে চিকিৎসা দিয়ে যান এবং ডাক্তার জাহিদ, ডাক্তার জিল্লুর বারী প্রত্যহ বিকালে এসে আমার অবস্থা দেখেন| ডাক্তার বারী প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়ার কথা বলেন আর তার উপদেশে ওষুধের নাম ও পরিমাণ মাত্রা আমার ফাইলে লিখে রাখা হয়, সে অনুযায়ী চিকিৎসা চলে| চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে প্রথম দু দিন আমার অবস্থা খুব খারাপ ছিল বিশেষত তৃতীয় দিন আমার অবস্থার অবনতি ঘটে| ওই দিন ডাক্তার আর নার্সরা আমাকে নিয়ে বেশ তৎপর হয়ে পর্যবেক্ষণ করেন| ওই দিন আমার গুরু ভাই সজল আর মিল্টন আমাকে দেখতে আইসোলেশন সেন্টারে আসেন। সজলের দ্বারা শিলং-এ আমার মামনি'র সাথে ভিডিও কলের মাধ্যমে দর্শন করি আর উনি আমাকে, কিছু হবে না, আমি ভালো হয়ে যাবো বলেন, আমার মনেও সাহস পাই|  বলা বাহুল্য, চতুর্থ দিনে, আমার অবস্থার এক অলৌকিক পরিবর্তন ঘটে।
 
হসপিটালে ডাক্তার, নার্স সহ সকলেই, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, খুব ভালোভাবে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন| সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ| যদিও সবার আপাদমস্তক ঢাকা আছে, তবুও এই করোনা এমন একটা ভাইরাস যাকে আটকানো যাচ্ছে না যেন!  ডাক্তার, নার্সসহ সকলকে আমার মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানাই|  ডাক্তার জিল্লুর বারী আর জাহিদ আমার কলেজের ছাত্র থাকায় ওরা অতিসতর্কতার সাথে স্যারের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যায়| এমন কি আমার শরীর খুব খারাপ থাকায় আমাকে যাতে অন্য রোগীদের সাথে না যেতে হয় তাই আমার কেবিনে এক্সরে মেশিন এনে আমাকে এক্সরে করা হয়| আমার ছোট মেয়ে ডাক্তার থাকায় ওকেও  প্রত্যেকদিন সব রিপোর্ট পাঠানো হয়, আর আমাকেও মনোবল রাখতে বলা হয় বার বার| অন্যান্য হাসপাতালের কথা আপাতত বলতে পারবো না, কিন্তু আমি আমি যেখানে ছিলাম তার খাবার খুবই ভালো ও মানসম্পন্ন ছিল আর চারিদিকে সব সময় জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার রাখা হতো| নার্সিং হোমে ছয় দিন থাকার পর, আমার শারীরিক অবস্থার উন্নতি আর আমার ইনজেকশন শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য ডাক্তার জিল্লুর বারী, আমাকে আমার বাসায় চলে আসতে বলেন। রাত হয়ে গেছে বিধায় আমি বললাম কাল সকালে যাই, কিন্তু ওখানে থাকলে আমার করোনা সংক্রমের সম্ভাবনা থেকে জীবন সংকট হয়ে যাবে আবার। তাই সকল ফর্মালিটিজ করে আমাকে রিলিজ দেয়া হয়| আসার সময় ওয়ার্ড বয়সহ যারা আমাকে ব্যাগ, ফাইল, মালামাল সব গাড়িতে তুলে দেয় তাদের সবাই কে বকশিস দিয়ে আসি। ওরা খুশি, কিন্তু আমি ভাবী, ওদের জীবন বাজি রেখে সেবা, এ যেন বকশিশের কাছে কিছুই নয়! বাড়ি তে এসে আমি ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী আলাদা রুমে ১৪ দিন থাকার পর আমার নিজ বেডরুমে যাই| আমি এখনো সব মেনে চলার চেষ্টা করছি| আমার ফলো আপ চেক আপের জন্য আমি দশ দিন পর আবার ডাক্তার জিল্লুর বারী'র কাছে যাই, তখন বলেন, "স্যার প্রথম দু দিন আপনার অবস্থা ভালো ছিল না, তৃতীয় দিন আরও খারাপ হয় যে আমরা আপনার জীবন নিয়ে শংকিত ছিলাম, কিন্তু চতুর্থ দিনে আপনার অবস্থার মিরাকুলাস পরিবর্তন হয় আল্লাহর অশেষ দয়ায়।"  

আমার ফুসফুসে এখনো কিছুটা সংক্রমণ আছে আবার এক মাস পর টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে যেতে হবে বললেন| আর ভিসিটের টাকাটাও নিতে না চাওয়াতে, আমি বললাম, সততা আর যথাযথ চিকিৎসা প্রদানে আমি সুস্থ হয়ে উঠেছি, এটা আমার আশীর্বাদ। কিন্তু  টাকাটা না নিয়ে বললেন, স্যার শুধু আশীর্বাদ চাই! ডাক্তার জিল্লুর বারীসহ আইসোলেশন ইউনিটের সকল ডাক্তার, নার্স ব্রাদারদের আমার শ্রদ্ধা আর শুভেচ্ছা জানাই।

আরও জানাচ্ছি আমার কৃতজ্ঞতা যারা আমার জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন, আমার দ্রুত রোগ মুক্তি'র জন্য প্রার্থণা করেছেন| আপনারা সবাই ভালো থাকবেন, সাবধানে থাকবেন। এই করোনা যুদ্ধ যে পৃথিবী তে এখনো চলছে, আমি যদি এই বয়সে এ যুদ্ধে জিততে পারি আপনারাও পারবেন।

শ্রীনিবাস দে : সাবেক অধ্যক্ষ, এমসি কলেজ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত