আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

২২ মার্চ, ২০২১ ০২:০৪

শাল্লায় সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আমলে সাম্প্রদায়িক অশান্তি? কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তথাপি রামুসহ বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু, বৌদ্ধ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ঘটছে। এজন্যে সরকারি প্রশাসনের গাফলতিকে দোষ দেওয়া যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না। ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি।

শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্মম অত্যাচার চলেছে, তাতে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্ররোচনা ছিল। অভিযোগ দেখে মনে হয়, এর সঙ্গে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল এবং তার যুব সংস্থারও হয়তো যোগসাজস ছিল। এই সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণে যুবলীগের এক কর্মী অথবা নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফলে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলামের পক্ষে এ কথা বলা সহজ হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বাড়ে।’

শাল্লার ঘটনাটি হেফাজতি নেতাদের উসকানিতে হয়েছে, এ কথা সত্য হওয়া সত্ত্বেও কথাটা লেখার সময় একটু ভাবতে হয়। বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙার সময় হেফাজতিদের দায়ী করে লিখতে বসেছিলাম, তারপর দেখা গেল এই ভাস্কর্য ভেঙেছে যুবলীগের স্থানীয় নেতারা। শাল্লার হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামে হেফাজতিদের উসকানিতে হাঙ্গামা শুরু হতে পারে, কিন্তু তা প্রতিরোধের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল ও স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে যে মারাত্মক অভিযোগ উঠেছে তা দুঃখজনক।

শাল্লার ঘটনায় ক্ষুব্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের বক্তব্য আমাদের এই ব্যাপারে সচেতন করা উচিত। সনজিত বলেছেন, ‘সুনামগঞ্জের হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে স্থানীয় বামছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। এটা আমাদের ভাবায়’ আরেকটি অভিযোগে বলা হয়েছে শাল্লার গ্রামে হামলা হতে পারে, স্থানীয় প্রশাসনকে তা জানানো সত্ত্বেও তারা নীরব ও নিষ্ক্রিয় ছিল।

অভিযোগকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, আমরা কি ধরে নেব প্রশাসনে ও আওয়ামী লীগে সাম্প্রদায়িক লোকজন ঢুকে গেছে? আওয়ামী লীগে কি একজনও নেতা নেই, যিনি এই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে পারতেন? এসব গুরুতর অভিযোগের জবাব অবশ্যই আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারকে দিতে হবে। নইলে বিএনপি ও জামায়াতকে সাম্প্রদায়িক দল বলে গালি দেওয়ার সুযোগ আওয়ামী লীগের থাকবে না।

আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে হেফাজতি নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে যে হিন্দু যুবক প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তাকে গ্রেপ্তার করায়। যিনি বা যারা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, তারা অপরাধী নন, অপরাধী হলেন প্রতিবাদকারী। তাহলে দেশে কি স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করা যাবে না? হিন্দু যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ধর্মীয় উসকানিপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। হেফাজতের বক্তব্যের প্রতিবাদ করা কি ধর্মীয় উসকানি দান?

এককালে জামায়াত এ দাবিটা করত। জামায়াতের কোনো রাজনৈতিক মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ জানানো হলে জামায়াত দাবি করত, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে আওয়ামী লীগ ধর্মের অবমাননা করছে। এখন এই দাবি কি হেফাজত করছে? বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সঠিকভাবেই দাবি করেছে, যারা এই হাঙ্গামা সৃষ্টির মূল উসকানিদাতা তাদের গ্রেপ্তার করা হোক।

অন্যান্য স্থানে সংখ্যালঘু পীড়নের ক্ষেত্রে যা ঘটে, শাল্লাতেও তাই ঘটেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর লুট হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ এখন অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়েছে। সুনামগঞ্জের হামলার মূল আসামি ইউপি সদস্য শহীদুল ইসলাম স্বাধীনকে গ্রেফতার করেছে। এখন এই হামলার সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্তদের ধরার জন্য পুলিশ ও র্যাব উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের তত্পরতা প্রশংসনীয়। কিন্তু রোগমুক্তির চাইতে তা প্রতিরোধ অনেক ভালো।

শাল্লায় বা যেখানেই হোক ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হওয়ার আগে সেই অত্যাচার নিবারণই পুলিশের আসল কর্তব্য। অত্যাচারিত হওয়ার পর তাদের আহত ঘায়ে মলম দেওয়া খুব একটা প্রশংসনীয় কাজ নয়। দুর্বৃত্তরা শাল্লায় মাইকযোগে হামলা চালানোর ঘোষণা দেওয়ার পর হামলা চালিয়েছে। এই সময় পুলিশ প্রশাসন নীরব ও নিষ্ক্রিয় ছিল কেন? এখানে একটি ব্যাপার লক্ষ্যযোগ্য। শাল্লায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার সময় শুধু ছাত্রলীগ নয়, জাতীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও নীরব ও নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগটি যদি সত্য হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতা দেখে ও স্থানীয় প্রশাসনও ভেবেছে, তাদের প্রথমে হামলা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয় থাকা উচিত?

আরো কয়েকটি দেশের নেতাদেরসহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে আসছেন। তাকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানানোর প্রতিবাদ করেছে কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দল। তাদের অভিযোগের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপির নেতা হিসেবে নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।’ এই জবাবের পরেও সাম্প্রদায়িক চক্র ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রাক্কালে বাংলাদেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়ে হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাইবে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে—এটাই আশঙ্কা করা যায়। এজন্যে পুলিশ ও র্যাবের উচিত সর্বত্রই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জোরদার রাখা। শাল্লার হাঙ্গামার পেছনেও সাম্প্রদায়িক চক্রগুলোর ভারতবিরোধী চক্রান্ত রয়েছে কি না, কে বলবে?

আওয়ামী লীগ একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের যুদ্ধ করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সেই আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার নৃশংস হামলা দুঃখজনক। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস হামলা চলে। তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। নাসিনগর উপজেলা সদরের অন্তত ১০টি মন্দির ও শতাধিক হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর হয়। আজ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তরা বিচার পায়নি এবং দুর্বৃত্তেরা শাস্তি পায়নি। ২২৮ আসামির সবাই এখন জামিনে মুক্ত।

নয় বছর আগে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হয়েছে আরো ভয়াবহ হামলা। এই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধরা এখনো সুবিচার পায়নি। এই হামলার আসামিরাও এখন কারাগারে নেই। নাসিরনগর ও রামুর ঘটনার পর শাল্লার ঘটনায় নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ দল ও সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষা পাবে না। অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার দেশে-বিদেশে একটি উজ্জ্বল ভাবমূর্তি আছে। এসব ঘটনায় তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পাহাড়ি—সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগকে মনে করে তাদের আশ্রয়দাতা রক্ষাকর্তা। সেই আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের নাগরিক হিসেবে ‘ইকুয়াল রাইটস’ পাওয়া দূরের কথা, ক্রমাগত নির্যাতিত হতে থাকলে আওয়ামী লীগের ওপর তাদের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হবে। তা যদি হয় তাহলে দেশের ঐক্য ও সংহতি এক গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

আমার মনে হয়, দেশে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি শক্তিশালী আন্দোলন আবার গড়ে তোলা দরকার। এই ব্যাপারে নেতৃত্ব গ্রহণ করা উচিত আওয়ামী লীগের। দেশের সব বাম ও গণতান্ত্রিক দলের সমন্বয়ে একটি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা হলে বিপন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আবার নিরাপত্তাবোধ ফিরে আসবে। শেখ হাসিনার অসাম্প্রদায়িক নীতিতে তারা আস্থাবান। এখন প্রধানমন্ত্রীর উচিত সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করা এবং তাদের নিরাপত্তা বিধানে তার প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া।

আমেরিকায় একজন মাত্র কালো লোককে পুলিশ হত্যা করায় সারা আমেরিকায় ‘ব্লাক লাইভ ম্যাটার্স’ শীর্ষক বিশাল আন্দোলন গড়েও উঠেছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা উপমহাদেশেই ‘মাইনরিটি লাইক ম্যাটার্স’ আন্দোলন গড়ে ওঠা উচিত। এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগসহ সকল গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক দলের সচেতন হওয়ার সময় এসেছে।
 লন্ডন, ২০ মার্চ, শনিবার, ২০২১

আপনার মন্তব্য

আলোচিত