শামীম আহমেদ

০৫ আগস্ট, ২০২১ ০৩:৫৪

শেখ কামাল: স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অনুগত এক অবিচল নেতৃত্ব

শেখ কামাল। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও সেকেন্ড লেফটেনেন্ট শেখ কামাল
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ কামাল বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল ১৯৪৯ সালের ৫ অগাস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। শেখ কামাল শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। শেখ কামাল সবসময়ই একজন সচেতন ও কর্মঠ রাজনীতিবিদ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তিনি ৬ দফা, ১১ দফা এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

শেখ কামাল বাংলাদেশের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সংগঠক। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট অফিসারদের একজন। ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর প্রথম ব্যাচের সামরিক অফিসারদের ‘পাসিং আউট’ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট শেখ কামাল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং স্বাধীনতার পর চাইলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত থেকে নির্ভার জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের পর সেনাবাহিনী ত্যাগ করে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবনে ফিরে যান।

স্বাধীন বাংলাদেশে সুস্থ বিনোদনের পথিকৃৎ শেখ কামাল
শেখ কামাল ছিলেন একজন দয়ার্দ্র ব্যক্তি, প্রজ্ঞাবান সাংস্কৃতিক। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে সারা বাংলার মানুষের পাশে অকুতোভয়ে দাঁড়িয়েছেন। যুদ্ধের পর পর তরুণ প্রজন্ম যাতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হয়, সেই উদ্দেশ্যে তিনি নানা ধরনের শুদ্ধ সংস্কৃতি ও বিনোদন চর্চার প্রসারে মনোযোগ দেন। তিনি নিজে ছায়ানট থেকে সেতার বাজনায় প্রশিক্ষিত। শেখ কামাল ছিলেন ‘ঢাকা থিয়েটার’ এবং ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়া সংগঠক ও সুঅভিনেতা হিসেবে তিনি সমাদৃত ছিলেন।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের শীর্ষ নাম ‘আবাহনী ক্রীড়া চক্র’ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ কামাল। আজ এতদিন পরেও বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গনে শেখ কামালের মতো নিবেদিতপ্রাণ, ও সৃজনশীল কোন নেতৃত্ব দেখা যায় না।

মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যায় গাজী গোলাম মোস্তফা, লিখেছেন মেজর ডালিম নিজের বইয়ে
মেজর ডালিম তার নিজের আত্মজীবনীমূলক বই ‘যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি’-এ, তাকে ও তার স্ত্রীকে অপহরণ করা বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি হস্তক্ষেপে বিষয়টির সুরাহা হয় এবং এতে শেখ কামাল বরঞ্চ ঘটনার মীমাংসায় তাদের সহযোগিতা করেন। মেজর ডালিমের জবানিতে-

“মাহবুব ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে। বিয়ে বাড়ি থেকে গাজী বিনা কারণে ডালিম-নিম্মীকে জবরদস্তি গান পয়েন্টে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। একথা শুনে মাহবুব স্তম্ভিত হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীকেই খবরটা সবচেয়ে আগে দেওয়া দরকার কোন অঘটন ঘটে যাবার আগে। গাজীর কোন বিশ্বাস নাই; ওর দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। মাহবুব টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ টেলিফোনটাই বেজে উঠে। রেড টেলিফোন। মাহবুব ত্রস্তে উঠিয়ে নেয় রিসিভার। প্রধানমন্ত্রী অপর প্রান্তে, -মাহবুব তুই জলদি চলে আয় আমার বাসায়। গাজী এক মেজর আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের ধইরা আনছে এক বিয়ার অনুষ্ঠান থ্যাইকা। ঐ মেজর গাজীর বউ-এর সাথে ইয়ার্কি মারার চেষ্টা করছিল। উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। বেশি বাড় বাড়ছে সেনাবাহিনীর অফিসারগুলির। সব শুনে মাহবুব জানতে চাইলো, -স্যার গাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করুন মেজর ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের কোথায় রেখেছেন তিনি? -ওদের সাথে কইরা লইয়া আইছে গাজী। গেইটের বাইরেই গাড়িতে রাখা হইছে বদমাইশগুলারে। জানালেন প্রধানমন্ত্রী। -স্যার গাজী সাহেব ডালিম আর নিম্মীকেই তুলে এনেছে লেডিস ক্লাব থেকে। ওখানে ডালিমের খালাতো বোনের বিয়ে হচ্ছিল আজ। জানাল মাহবুব। -কছ কি তুই! প্রধানমন্ত্রী অবাক হলেন। -আমি সত্যিই বলছি স্যার। আপনি ওদের খবর নেন আমি এক্ষুণি আসছি। এই কথোপকথনের পরই মাহবুব লিটুকে সঙ্গে করে চলে আসে ৩২নং ধানমন্ডিতে। মাহবুবের ভিতরে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেহানা, কামাল ছুটে বাইরে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে যায়। আলম ও চুল্লুর রক্তক্ষরণ দেখে শেখ সাহেব ও অন্যান্য সবাই শঙ্কিত হয়ে উঠেন। -হারামজাদা, এইডা কি করছস তুই? গাজীকে উদ্দেশ্য করে গর্জে উঠলেন শেখ মুজিব। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে নিম্মী এবং আমাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। খালাম্মা ঠিকমত হাটতে পারছিলেন না। কামাল,সুলতানা, রেহানা ওরা সবাই ধরাধরি করে উনাকে উপরে নিয়ে গেল। শেখ সাহেবের কামরায় তখন আমি, নিম্মী আর গাজী ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। নিম্মী দুঃখে-গ্লানিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। শেখ সাহেব ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছিলেন। অদূরে গাজী ভেজা বেড়ালের মত কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল।”

এই বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক রাতিন রহমানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আজ দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে পাকিস্তানীদের প্রেতাত্মারা প্রচার করে আসছে, শেখ কামালই নাকি নিম্নীকে তুলে নিয়ে গেছেন। অথচ ডালিম তার নিজের বইয়েই পুরো ঘটনার উল্লেখ করেছে যেখানে শেখ কামালের কোন প্রসঙ্গই নাই। তবুও এই মিথ্যা বানোয়াট অপপ্রচার চলে আসছে মুখরোচক গুজব হিসেবে। যে মানুষটা তার প্রিয়তমাকে ভালোবাসার কথা জানাতে ভয়ংকর অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছিলেন, মুখ ফুটে বলতে পারেননি, দু'বছর লেগেছিল যার প্রিয়তমাকে ভালোবাসি বলতে, সেই সহজ সরল নিপাট ভালো মানুষটার নামে এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার কি সহজেই না আমরা বিশ্বাস করে চলেছি, প্রচার করে চলেছি। একটাবারের জন্যও আমাদের লজ্জা হয়নি, বিবেকের দংশন হয়নি।”

সুলতানা খুকুর সাথে শেখ কামালের বিয়ে ছিল পারিবারিক, ছিল দীর্ঘদিনের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ
শেখ কামাল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেও প্রেমের ক্ষেত্রে ছিলেন লাজুক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সুলতানা কামালকে ভালোবাসতেন, কিন্তু কখনও বলতে পারেননি। তিনি নিজে সুলতানা খুকুকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারেননি, বরং তার মঞ্চের সহ-অভিনেতা ছোট বোন ডলি জহুরকে অনুরোধ করেন তার পক্ষ থেকে ভালোবাসার কথা সুলতানা খুকুকে জানাতে। তখনকার দেশসেরা এথলেট সুলতানা খুকুর ব্যক্তিত্ব এমনই প্রবল ছিল যে এমনকি ডলি জহুরও তার কাছে গিয়ে শেখ কামালের ভালোবাসার কথা জানাতে সাহস করেননি। অবশেষে শেখ কামাল নিজেই গিয়ে তার মনের কথা জানান সুলতানা খুকুকে। কিন্তু সুলতানা খুকু বলে দেন প্রেমট্রেম তিনি করতে পারবেন না। এতই যদি ভালো লাগে তবে যাতে শেখ কামাল বিয়ের প্রস্তাব তার বাসায় পাঠান। সেই ধারাবাহিকতায় পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। সুলতানা খুকু হন সুলতানা কামাল।

জাসদ, সিরাজ শিকদারদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ব্যাংক ডাকাতির গুজব
স্বাধীন বাংলাদেশে দেশদ্রোহিতা ও সহিংসতায় লিপ্ত ছিল জাসদ এবং সিরাজ শিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি। এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল না এবং পরিকল্পিতভাবে আমাদের বিজয় দিবসে বোমা হামলা ও সন্ত্রাসী হামলা চালাত। ১৯৭৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতেও তারা এমন কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল। বাংলার বাণী পত্রিকা এবং ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্সের অফিসের সামনে তারা সেদিন বোমা নিক্ষিপ্ত করে। ১৫ ডিসেম্বর রাতে বিজয় দিবসের উদযাপন ও প্রস্তুতির জন্য শেখ কামাল ও তার বন্ধুবান্ধবরা দুটি গাড়িতে করে ঘুরছিলেন। তারা যাচ্ছিলেন ছাত্রলীগের অফিসের দিকে। এই সময় একটি লাল গাড়ি দেখে তাদের সন্দেহ হয় এটি সিরাজ সিকদারের বাহিনী হতে পারে এবং তারা হয়ত কোন ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা করছে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে। কিন্তু মূলত গাড়িটি ছিল পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের। লাল গাড়িটিতে ছিলেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের সার্জেন্ট শামীম কিবরিয়া। তাদের অনুসরণ করায় তারা সন্দিহান হন এবং ফাঁড়িতে ঢোকার পর আতঙ্কিত হয়ে শেখ কামাল ও  তার বন্ধুদের গাড়িতে গোলাবর্ষণ শুরু করেন। ৪টি গুলি শেখ কামালের কলার বোনে প্রবেশ করে, তিনিসহ ৫ জন গুলিবিদ্ধ হন। একজনের হাতের ৪টি আঙুল উড়ে যায়। আদতে পুরো বিষয়টিই একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। শেখ কামাল ও তার বন্ধুগণ এবং পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ উভয় পক্ষই আসলে চেষ্টা করছিল সিরাজ শিকদার ও তার বাহিনীর সন্ত্রাস প্রতিহত করতে। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝিতে তারা একে অপরকেই আক্রমণ করে। কিন্তু সেই সময় বিরোধী দল ও সন্ত্রাসী দল জাসদ পরের দিন সকালে বিজয় দিবসের মহাসমাবেশে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে শেখ কামাল দলবল নিয়ে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এই মিথ্যা গুজব দাবানলের মত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারপর বহুবছর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পরিকল্পনামাফিক ডানা ছড়াতে থাকে। ‘হলিডে’ পত্রিকার মতো পত্রিকা এই গুজবে হাওয়া দিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে। অথচ এর কোন সত্যতা ছিল না।

ইতিহাসের সত্য প্রকাশ হবেই, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে না
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তাকে ঢেকে রাখা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের দেশ স্বাধীন ও দেশ গঠনে যে ভূমিকা তাকে ছোট করতে পারেনি। তার মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও দেশ বিনির্মাণে যে অসামান্য ভূমিকা তা সময়ের পরিক্রমায় প্রকাশিত হয়েছে, পরিস্ফুট হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে কয়জন মানুষের ভূমিকা সবচেয়ে উজ্জ্বল, শেখ কামাল তাদের অন্যতম। সম্ভবত স্বাধীনতা বিরোধীরা বুঝে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরবর্তী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন শেখ কামাল এবং তাই প্রথমে তার নামে অপপ্রচার করে এবং পরবর্তীতে তাঁকে হত্যার মাধ্যমে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে মৃত্যুর পেরেক ঠুকতে চেয়েছিল।

শেখ মুজিবের যেমন মৃত্যু নেই, তেমনি শেখ কামালেরও মৃত্যু নেই। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তাদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এই জাতি।

আজ ৫ অগাস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত