মোহাম্মদ আল আমিন

০৬ মার্চ, ২০২২ ২৩:৩৪

কসমেটিকস রিলেশনশিপ

ইলেকট্রনিকস যোগাযোগ এর যুগে সব কিছুই কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে। বলা যায় মানুষের প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে যে সব কিছুর সৃষ্টি হয়েছে এগুলোই এখন আমাদের গলার কাটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সকলের ঘুম ভাঙে কোনো দিবসের মাধ্যমে। আবার ঘুমাতে যাই দিবসের আগাম বার্তা নিয়ে। সম্পর্কগুলো দিবসকেন্দ্রীয় হয়ে যাচ্ছে।

বাবা/মা দিবসে বাবা/মায়ের সাথে একটা-দুইটা ছবি ইমোশনাল মিউজিকের সাথে ভিডিও কিংবা কমেন্ট বক্সে কয়েকটি আবেগ ঝরানো লাইন। এগুলোই আমাদের শান্তির খোরাক দিচ্ছে। জন্মদিন কিংবা স্পেশাল ডে সেলিব্রেট করা এখন ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এ দিনগুলোতে স্পেশাল কিছু নাই মানেই সে আমাকে ভালোবাসে না। স্পেশাল ডে ছাড়া কতজন তার প্রিয় মানুষের হাত ধরে বলে যে ভালোবাসি। উত্তর- খুবই কম।

দাম্পত্য জীবন কলহ থাকার পরেও দিব্যি ফেসবুক কাঁপিয়ে যাচ্ছে অনেকে। হঠাৎ যখন ভাঙনের শব্দ আসে তখন হা-হুতাশ ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কিন্তু অনেকেই জানে না মেকআপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে ওই মানুষটির আসল সত্তা। রঙিন চকচকে আলোর হাসিমাখা মুখের ছবির পেছনের কুৎসিত বিষয়গুলো আমরা কখনো জানতে চেষ্টা করি না। ভেতরের অগ্নিশিখাগুলোই মানুষকে অমানুষিক কষ্ট দিতে শুরু করে। আমি-আমরা বোঝতেও চেষ্টা করি না ওই মানুষগুলো কেমন আছে। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছি সে দিব্যি ভালো আছে। আলোর খেলায় নিজেকে আরও একটু রাঙিয়ে কামাচ্ছি বহু লাইক, কমেন্ট। করোনার প্রভাব শুধু আমাদের অর্থনৈতিকে ধাক্কা দেয়নি, ধাক্কা দিয়েছে কোটি বছরের সংস্কৃতিকে।

যে মানুষগুলোর হাতে হাত রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে পারার কথা তাদের হাতে হাত রাখতে না পারাটা অবশ্যই কষ্টের। সম্পর্কগুলো দিন দিন বেদনার হয়ে উঠছে। একই ছাদের নিচে বসবাস করেও পাশের মানুষটিকে চিনতে পারি না। পরিবারের কাছে থেকেও দূরে। যার ফলাফল একাকীত্ব, বিষণ্ণতা, ডিপ্রেশন যাই বলেন না কেন, এই সমস্যা ধীরে ধীরে আমাদের নষ্ট করছে। ইদানীং সুইসাইড নোটগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বেশিরভাগ মানুষ তার কাছের মানুষ থেকে দূরে। চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর যখন আত্মহত্যা করেছেন তখন তার ভিডিওবার্তা বলে দেয় আমাদের সম্পর্কগুলো কসমেটিক রিলেশন হয়ে যাচ্ছে। প্রবাসে মৃত্যুবরণ করা মানুষটির লাশ যখন তার পরিবার নিতে চায় না তখন আমাদের আরও জোরে একটা ধাক্কা দেয়।

মোটিভেশনে সেলফ ডিপেন্ড শব্দগুলো আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রীয় করে তুলছে। ভোগবাদী ধারণা তীক্ষ্ণ করে তুলছে। ত্যাগেও যে সুখ মিলে তা ভুলতে শুরু করেছি। আমি শুধু আমার আমার করেই দৌড়াচ্ছি । কিন্তু আমাকে ভালো রাখার জন্য যে চারপাশের মানুষজনদের ভালো রাখতে হবে তা কখনো ভেবে দেখছি না। সেলফ ডিফেন্স আপনি/আমি আমরা সবাই দৌড়াচ্ছি। রঙিন আলোর শান্তির খোঁজে তারাও দৌড়াচ্ছে। কার থেকে কে বেশি সফলতার গল্প বলতে পারে সেই জায়গায় ব্যস্ত সময় পার করছি আমরা। সফলদের ভিড়ে অসফল মানুষগুলো কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা আছে তা হারিয়ে ফেলার ভয়ে অনেকে নিজের অবস্থান প্রায় ক্ষেত্রে লুকিয়ে রাখে।

বৃদ্ধাশ্রমের ভিতরে একটু একটু করে নিঃশেষ হওয়া মানুষজনেরা জানে পৃথিবী কত কঠিন। পরম যত্নের ছেলে মেয়েগুলো চরম অবহেলায় রাখছে। সেলফ ডিপেন্ড শিখিয়েছেন ঠিকই কিন্তু মানবিক চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেনি। এই না পারার ব্যর্থতা ভোগবাদী সমাজকে আরও এক ধাপ সামনে এগিয়ে দিচ্ছে। পরিবারগুলো ক্রমেই ছোট হচ্ছে। সম্পর্কগুলোতে ফাটল ধরছে। কসমেটিক রিলেশন কখনই কাম্য নয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত