আরিফা আক্তার

২০ জানুয়ারি, ২০২৪ ১৫:৪০

সমবিবাহ বনাম অসম বিবাহের সাতকাহন

লোকে সুগারবেইবি নিয়ে সমালোচনা করছে। এই ফাঁকে আমার সংসারের গল্পটা করে ফেলি আপনাদের সাথে। আমার বর্তমান মায়ের বয়স ৫০। বাবার বয়স ৭২। আমার গর্ভধারিণী মাতা মারা গেছেন ২০১৬ সালে। আমার নিজ মাতা আর বাবা কাছাকাছি বয়সী ছিলেন। দুজনই সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। শূন্য থেকে সংসার শুরু করতে গিয়ে উনাদের দাম্পত্য কলহ হয়েছে। সংসার, সন্তান, চাকরি, সামাজিকতা, সম্পদ গড়া সব মিলিয়ে জীবনের নানাবিধ ঝামেলা এবং মতানৈক্য শেষাবধি উনাদের সুখী হতে দেয়নি। আমার মাতা রোগ, শোক, অতিরিক্ত সাংসারিক দায়িত্ব সব মিলেয়ে বয়স ৬০ হওয়ার আগেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।

এ পর্ব অবধি বাবার জীবনে আমার অবস্থান ছিল কেবল একজন সন্তান হিসেবে। বোনটা ছোট ছিল, তাই তার দায়দায়িত্ব অনেকাংশে কমই ছিল। ফলে মায়ের মৃত্যুর পর আমার আবির্ভাব হলো একজন মুরুব্বি হিসেবে। তো, বাবার বয়স তখন ৬৫। লোকে বললো আমাকেই দেখাশোনা করতে হবে বাবাকে। কিন্তু আমার নিজের দুজন সন্তান, জব আর সেই যে শূন্য থেকে সংসার শুরু করার চিরন্তন যুদ্ধ, সেখানে আমি প্রায় অর্ধমৃত। বাবার হাই প্রেসার, হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস, সব মিলিয়ে উনার লাগবে এক্সট্রা কেয়ার। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। বাবা বিয়ে করতে চাইলেন, আমাকেই ডেকে বললেন সে কথা। তিনি যুক্তি দেখালেন বেশ পরিমাণ জমাজমির ফসলাদি রক্ষণাবেক্ষণ, তাঁর নিজের যত্ন, ছোটবোনটার বিয়ে সব মিলিয়ে বাড়িতে একজন নারী দরকার। আমি বুঝে নিলাম, এসবের সাথে সাথে তাঁর নিজের একজন শরীর মনের সঙ্গী দরকার এবং সেটাই মুখ্য। শুরু হলো খানিকটা যুদ্ধ। এত বয়সে বিয়ে করা উচিত অনুচিত নিয়ে। আমি খানিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে বাবার পক্ষ নিলাম। ফলে বোন আর মায়ের দিকের আত্মীয়দের বিরাগভাজনও হলাম। আগেই বলেছি, জন্মগত সংস্কার বিরোধী আমি। তাই কোন সমালোচনায় কান না দিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলাম দুজনকে।

দ্বিতীয় পর্বে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটতে থাকল আমাদের সংসারে। আমার যে বাবা সারাজীবন ইগো রেখে চলেছেন, তিনি আমার তুলনামূলক অল্পবয়সী মায়ের পাশে শিশু হয়ে গেলেন। আমার নতুন মায়েরও জীবনে কোন টেনশন নেই। আগের একটা দুঃখময় বিবাহিত জীবন পেরিয়ে তিনি নতুন সঙ্গী, নতুন জীবন পেলেন। তাঁর নতুন সংসারে অর্থনৈতিক বিলাস আছে, কাজের প্রেসার নেই, সন্তান জন্মদানের জটিলতা নেই। ফলে তিনিও উজাড় করে আমার বাবাকে আনুগত্য, প্রেম আর সেবা দিতে থাকলেন। আমার বয়সের ভারে কিছুটা ক্লান্ত বাবা এমন প্রেম আর সেবায় গলে গলে গেলেন। সন্তান হিসেবে উনাদের প্রেম আর মায়ের সারাজীবনের অপ্রাপ্তি আমাকে হাহাকারে ভোগাল। কিন্তু আমি চিরকাল প্রেম পূজারী। ফলে অল্প দিনেই "মেনে" নয়, "মনে " নিলাম তাদের দাম্পত্য সুখ। নতুন মায়ের জীবনে আমি কোন ঝামেলা তৈরি করলাম না বলে তাঁর সাথেও আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। টুকটাক ঝামেলা পেরিয়ে আমরা এখন তাই বেশ ভালো আছি।

এখন হিসেব করি দেখি সমাজে অসম বিবাহে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? অবিবাহিত নারীর সাথে বেশি বয়সী পুরুষ বা বেশি বয়সী নারীর সাথে অবিবাহিত কম বয়সী পুরুষের বিয়ে হলে? কিন্তু কেন?

যদি যৌনতার কথা বলেন, তাহলে আমি বলবো যে অর্থের সাথে যৌন শক্তির তীব্র সম্পর্ক বিদ্যমান। একজন ধনবান নারী বা পুরুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য থাকে, তারা ভালো খাবার খায়, পুষ্টি, শিক্ষা, চিকিৎসা, সচেতনতায় এগিয়ে থাকে। ফলে দীর্ঘদিন তাদের শরীরে যৌনতা বিরাজ করে। অপরপক্ষে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকা নারী পুরুষের বয়স যা-ই হোক, পুষ্টি, চিকিৎসা, টেনশনের কারণে তাদের সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে না। একজন সচেতন নারী বা পুরুষ, যারা চিন্তায় অগ্রগামী, তার যদি শুধুমাত্র যৌনতাকে জীবন ধরে তবুও এমন সঙ্গীই বেছে নেবে। এর বাইরে জীবনের নানাবিধ কাজে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা নারী পুরুষ বেশ উদার হয়। বিধিনিষেধের বেড়াজালে সঙ্গীকে ওতটা বাঁধতে চায় না। কারণ তাঁদের নিজের উপর আত্মবিশ্বাস থাকে। তারা সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়েই জীবনকে উৎযাপন করতে শেখে। এছাড়া সঙ্গী ছেড়ে গেলেও হারানোর ভয়ে নির্যাতক হয়ে উঠে না। কারণ, অর্থ, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত থাকলে যেকোনো দুঃখ বেদনা কাটিয়ে উঠা সহজ হয়। ফলে হারানোর ভয়ে সঙ্গীকে খুব একটা নিয়ন্ত্রণ করতে যায় না।

সচেতন নারী পুরুষতো এমন দাম্পত্য চায়, না-কি? বয়সে পরিপক্ব হলে মানুষের সহনশীলতা বাড়ে, পুরোনো সম্পর্কের জটিল অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা শিক্ষা নিয়ে ম্যাচিয়র্ডও হয়। আইনত, ধর্মতো কোনভাবেই এমন সম্পর্কে বাধা নেই। উপরন্তু বহু সুবিধা বিদ্যমান।

শুধুমাত্র যৌনতাই জীবন নয়, আর যৌনতাই যদি জীবনে প্রধান হয় তবুও ধনীরা, সচেতনরা এ বিষয়ে এগিয়ে থাকে। সুতরাং, এ সমস্ত সমালোচনা চিন্তার দৈন্য ব্যতিত কিছুই নয়। তাই, নিজেদের পশ্চাৎপদতা কুৎসিত ভাবে ফলাও করে প্রচার করে জায়েজ করারও কিছু নেই।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত