কাকন রেজা

১৯ মার্চ, ২০২৪ ১২:২০

সাংবাদিক ফাগুন হত্যাকাণ্ডের বিচারিক প্রক্রিয়ায় পিতার বয়ান ও মবজাস্টিসের উত্থান

সাংবাদিক ফাগুন রেজা

একজন বলছিলেন, ‘এই যে এত মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলেন, ক্রসফায়ারকে মবজাস্টিজ বলেন, এসব বলে লাভ হলো কী, ফাগুনের গ্রেপ্তারকৃত হত্যাকারীর তো জামিন হয়ে গেলো! বাদী হিসেবে আপনি জানতেও পারলেন না কখন হলো, কবে হলো!’ মাথা নিচু করে থাকা ছাড়া আর কী জবাব রয়েছে আমার কাছে বলুন তো দেখি। একজন পিতা, যার সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার এহেন কাণ্ডে এখন নিশ্চিত বলতে পারে, ফাগুনের হত্যাকাণ্ড ছিল কাঠামোগত এবং পরিকল্পিত।

একজন সাংবাদিককে হত্যা করা এখন কোনো ব্যাপার নয়। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সে ধারণাই দিয়েছে সবাইকে। ফাগুন হত্যাকাণ্ডে তো একজন খুনির স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, বেশ কিছুদিন জেল খেটেছে, তারপর রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যর্থতার ফোকর গলে বেড়িয়ে গেছে। কিন্তু সাগর-রুনি’র খুনিদের তো ধরাই যায়নি। করা যায়নি অনেক সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডের বিচার। কেন যায়নি বলতে গেলে তো নিজেকেও জালে আটকে পড়তে হবে। তাই কৌশল করে একে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যর্থতার কথা বলে চালিয়ে দেয়া ছাড়া বিকল্প কী আছে? খেজুরের বিকল্প আছে, বেগুনের বিকল্প আছে, কিন্তু এখানে স্তব্ধতার বিকল্প নেই।

একটা হত্যা মামলা এবং যে মামলা মোটামুটি আলোচিত। সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা সংক্ষেপে সবাই তাকে জানতো ফাগুন রেজা হিসেবে। প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী একজন গণমাধ্যমকর্মী। একটা গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের সাব এডিটর। যার হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে সারাদেশেই প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মানববন্ধন হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনই তো প্রতিবাদ করে মনে করিয়ে দেয়া সম্ভব নয় যে, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। এই বিচারের ভার রাষ্ট্র ব্যবস্থার। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে বা ব্যবস্থার দুর্বলতার ফাঁক গলে যদি একজন স্বীকৃত খুনি বেরিয়ে যায়, তাহলে তো মামলার বাদী-সাক্ষী থেকে পুরো সমাজই অনিরাপদ হয়ে ওঠে।

অনিরাপদ সমাজ তখন কী করে, সঙ্গতই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। উদাহরণ দিই- যেদিন লিখছি ১৮ মার্চ, সেদিনেরই প্রথম আলো’র খবর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মধ্যরাতে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়ার পর গ্রামবাসীর পিটুনি, যাকে আইনের পরিভাষায় বলা হয় গণপিটুনি তাতে নিহত হয় ৪ জন এবং আরেকজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ বলছে, তারা সত্যিই ডাকাতি করতে এসেছিল। ভালো কথা ডাকাতি করতে এসেছিল, কিন্তু এই ডাকাতি ঠেকানোর দায়িত্ব কাদের, সেই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই করা যায়। রাজনৈতিক বিরোধীদের কথিত নাশকতার পরিকল্পনার কথা আগে জেনেই আটক করা সম্ভব হলে, ডাকাতির পরিকল্পনার কথা আগে জানা সম্ভব হয় না কেন, এমন প্রশ্ন উঠে না আসার কোনো কারণ নেই। গ্রামবাসীরা অতিষ্ঠ হলে আইনের বাইরে গিয়ে মবজাস্টিস এর মতন ঘটনা ঘটাতে পারে। গণপিটুনি হলো রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যর্থতা। রাষ্ট্র ব্যবস্থা কতটা ব্যর্থ হলে গণপিটুনিই হয়ে উঠতে পারে বিচারিক মাধ্যম। প্রথম আলো’র গণপিটুনি বিষয়ক খবরে আরও পাবেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জে মাইকের ঘোষণা দিয়ে গণপিটুনি যুবক নিহত’, ‘টঙ্গিতে গণপিটুনিতে যুবকের মৃত্যু’, ‘পাবনায় গরু চুরি করে পালানোর সময় গণপিটুনিতে নিহত ৩’। আরও অসংখ্য ঘটনা রয়েছে গণপিটুনির। মবজাস্টিস যখন শুরু হয় তখন নিশ্চিত ধরে নেয়া যেতে পারে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোথাও গণ্ডগোল রয়েছে। না, এটা আমার কথা নয় খোদ আইনের কথাই। বিলম্বিত বিচার অবিচারের শামিল, এ কথা আইনই বলে। যেখানে বিলম্ব নয়, কোনো ক্ষেত্রে অবিচারই বিচার হয়ে ওঠে সেখানে তো মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেই।

ফাগুন হত্যা মামলায় আবার ফিরি। যেখানে বাদী আমি এবং এই বিচারের ভার রাষ্ট্র ব্যবস্থার। কোর্টে রয়েছে পুলিশের একটা আলাদা ইউনিট এমনসব বিচার প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধানে। কোর্ট ইন্সপেক্টর রয়েছেন, রয়েছেন তার আরও সহকর্মী। রয়েছে তাদের নিজস্ব অফিস। কিন্তু সেসব অফিসে কী হয়, তার প্রমাণ আমি নিজে। আমি জানি না, কবে আমার ছেলের খুনিদের জামিন হলো, কীভাবে হলো, কোন কারণে বিচারক তাকে জামিন দিলেন। প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। সাংবাদিক ফাগুন রেজা নিখোঁজ বা গুম হবার পর, তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল জামালপুরের জেলার সীমানায় রেললাইনের ধারে। তাই সঙ্গতই মামলাটি হয়েছে জামালপুরের থানা ও আদালতের আওতায়। কিন্তু আমি তো জামালপুর থাকি না, থাকলে হয়তো ব্যক্তিগত ভাবে দেখভাল করা সম্ভব হতো। যা আমার এক সাংবাদিক সহকর্মী, যিনি নিজেও একজন গণমাধ্যমকর্মী, তিনি জানালেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর ভরসা না করে বাদীর একজন উকিল নিয়োগ করা দরকার। এই দরকারটাও আইনের ভাষায় বাহুল্য। কারণ, রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিজস্ব ধারা রয়েছে, সেখানে হস্তক্ষেপটাও ঠিক আইনসংগত নয়। কিন্তু ওই যে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফাঁক-ফোকর, যা বন্ধ করতে হয় বাদীর নিজস্ব উদ্যোগে। সন্তানও হারাতে হয় এবং বিচার প্রার্থনায় তার পকেটও ফাঁকা হয়। এই অবস্থায় মবজাস্টিস তো সঙ্গতই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ওঠে কিনা?

এক বন্ধু বললেন, ‘ক্রসফায়ার তো এমনি এমনি হয়নি’। আগে হলে এমন কথার পিঠে বিতর্কে যেতাম, কিন্তু এবার মনে সায় দেয়নি, ফলে চুপ ছিলাম। এই চুপ করিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টাই হলো কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড, বিলম্বিত ও বিভ্রান্ত বিচার। প্রকৃত খুনিরা জামিন পেয়ে যায়, অথচ রাজনৈতিক মামলায় বছরের পর বছর জেল খাটতে হয় মানুষকে। ক্যাসিনো আর মাদক সম্রাটরা জামিনে মুক্ত হয়, তার আগে কাটায় হাসপাতালের কেবিনে আয়েশি সময় আর খাদিজারা অন্যায়ের অজুহাতে দীর্ঘসময় পার করে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। খুনিরা জামিন বের হয়ে পুনর্বার হত্যাকাণ্ড ঘটায় অথচ রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকে নিশ্চুপ। অনেকে এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র শব্দটি ব্যবহার করেন। তাদের রাজনৈতিক পরিভাষায় একে বলেন রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। না, এটা মূলত আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের তৈরি ব্যবস্থার গলদ, যা রাষ্ট্রকে চালায়। তাই মাঝেমধ্যে ব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হয়, প্রয়োজনে পাল্টাতে হয়। নিজেদের তৈরি ব্যবস্থার ফাঁক-ফোকর নিজেরা বন্ধ করতে না পারি, তবে সেই ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা অপরাধী চক্র ক্রমেই শক্তিমান হয়ে উঠবে এবং সেই ব্যবস্থা তারাই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে যার আলামত তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।

আমি সবসময় স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ার পক্ষে ছিলাম, নিজ ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা দেখার পরও, তার পক্ষেই আছি। কারণ আমি চাই বিচার প্রক্রিয়া সত্যিকার অর্থেই স্বাভাবিক থাক, স্বাভাবিক নিয়মে বিচার চলুক। অপরাধীরা বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই শাস্তি পাক। এবং সেই শাস্তি দেখে অন্য অপরাধীরা ভাবুক, অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হয়। এই ভাবনা যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে ওই যে বললাম, রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে অপরাধীরা চক্র। পিতা হিসেবে আমি কখনো পুত্রের খুনিদের ক্ষেত্রে মবজাস্টিস চাইনি, চাইনি ক্রসফায়ারে এর নিষ্পত্তি হোক। কারণ ক্রসফায়ার হয়তো ব্যক্তিগত ক্ষোভকে দমন করবে, কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যক্তি নয় সমষ্টিগত। এক বিচারের প্রক্রিয়া দেখে, অন্য অপরাধীদের উপলব্ধি ঘটার সম্ভাবনা থাকে। বিচারিক প্রক্রিয়া সঠিক হলে একসময় কারাগারই ওঠে যায়, অপরাধ নামে প্রায় শূন্যের কোঠায়। এমন রাষ্ট্রও বিশ্বে রয়েছে, যেখানে অপরাধের হার কমতে কমতে কারাগার তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে। এমনটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র সঠিক বিচারিক প্রক্রিয়ার কারণে। আমরা সে দিনের আশা তো করতেই পারি। তবে আশা করার আগে আমাদের কাজ হলো ব্যবস্থাটাকে ঠিক করা, প্রয়োজনে পাল্টানো। এর মূলত বিকল্প নেই।

  • কাকন রেজা : নিহত সাংবাদিক ফাগুন রেজার পিতা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত