সুশান্ত দাস

২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ ১৪:১৯

শ্রদ্ধার্ঘ্য : সত্যেন্দ্র চেয়ারম্যান

হাওরের দেশ, পানির দেশ, ভাটির দেশ। হেমন্তের সবুজ দিগন্ত আর বর্ষায় ভাসান পানির লীলাখেলা। এই ভাসান পানিতে ভেসে যাওয়া, তলিয়ে যাওয়ার ন্যায় উচ্চ শিরে দাঁড়িয়ে, টিকে থাকাও দেখা যায়। বর্ষায় মৃদু বাতাসে ছলাৎ ছলাৎ, প্রবল বাতাসে মাতঙ্গিনী, রূপালী জোছনায় ফকফকা এমন জল প্রবাহে লতানো জলজ উদ্ভিদে জলজ প্রাণীগুলো খোঁজে আশ্রয়। বড় বড় করচ, হিজলের খাল-বাকল, ঝরা পাতা, পোকা খেয়ে পায় ভরসার জায়গা। এসব জলজ জীবন চিত্র হিসেব-নিকেশে চোখে পড়ার মতো যেমন আসে না; তেমনি হাওরের জন জীবন ও সামাজিকতায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিবর্গের অনেক জীবন কর্মও চোখে লাগেনা। প্রচার প্রচারণায় পরে থাকে দৃষ্টির অগোচরে। তবে লোকমুখে ভেসে বেড়ায় তাঁদের কর্মের খ্যাতি। ফিরে আসে সমাজ, সামাজিকতার বিচরণে।

এমনই এক চরিত্র বাবু সত্যেন্দ্র চন্দ্র দাশ। ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, হাওয়র-ভাটির গ্রাম্য সালিশ ব্যক্তিত্ব চেয়ারম্যান। তাই সমধিক মানুষের কাছে সত্যেন্দ্র চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচিত। ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি, মেধাবী সালিশ ব্যক্তিত্ব।

জন্ম ১৯৩২ সালের ৭ জুলাই। হবিগঞ্জ জেলার, বানিয়াচং উপজেলার, সেকান্দরপুর গ্রামে। পিতার নাম সুরেন্দ্র চৌধুরী মাতার নাম মাতঙ্গিনী চৌধুরী। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সত্েযন্দ্র দাশ ছিলেন সবার বড়।

শিশু সত্যেন্দ্র পড়াশোনা শুরু করেন গোগরাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ১৯৫৭ সালে মেট্রিক পাশ করেন নবিগঞ্জ যোগল কিশোর(জিকে)উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৯৫৯ সালে এইচএসসি পাশ করেন নটরডেম কলেজ থেকে। অতঃপর ১৯৬২ সালে ডিএইচএমএস তিন বৎসর মেয়াদী কোর্স শেষ করেন ঢাকা হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ হতে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ, পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের যাতাকলে। রাজনীতি ছিল তুঙ্গে। উঁকি দিলেন রাজনীতিতে।স্লোগান যপে নিলেন ‘ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি’র। খবর আসলো গ্রাম্য বিত্তশালী পিতা সুরেন্দ্র চৌধুরীর কাছে। যুব সত্যেন্দ্রকে ফিরিয়ে আনলেন বাড়িতে। কিন্তু যাঁর চরিত্রে রাজনীতির বীজ ডুকে পড়েছে তা-কি আর বিনাশ করা যায়? স্থানীয় ভাবে মিশে যান সাম্যের সমাজ বিনির্মানে; কমিউনিস্ট আদর্শে। গোপন যোগাযোগের বন্ধন হয়েওঠে কমরেড বরুণ রায়সহ হাওরের প্রান্তিক গণমানুষের নেতাদের সঙ্গে। গড়ে তোলেন গণ মানুষের রাজনীতির ভিত্তি। হয়ে ওঠেন মাঠ পর্যায়ের নেতা। ১৯৬৪ সালে নির্বাচিত হলেন লোকাল মেম্বার। অতঃপর ১৯৬৮ সালে মেম্বারদের দ্বারা নির্বাচিত হলেন চেয়ারম্যান। জয় করেন প্রান্তিক মানুষের হৃদয়। হয়ে ওঠেন সেবাব্রতী। চলে আসে ৭০-র নির্বাচন। ৭১-এ বেজে ওঠে মুক্তির পালা। এতো বড় সংসার এতো লোকের দায়িত্বের ভার কাঁধে থাকলেও ভুল করেননি মুক্তির আন্দোলনের সকল রসদ জোগাতে, উদ্দীপনা যোগাতে। স্ব-শরীরে নিজে না যেতে পারলেও ভাইদের পাঠিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হল। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হল।

মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু মুজিব নেতৃত্বে, তাই যুদ্ধ পরবর্তীতে আর পূর্বের রাজনীতিতে ফিরে যাননি। মুজিব আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছেন। হয়েছেন জনপ্রতিনিধি। হয়েছেন দীর্ঘ দুই যুগের বেশি প্রায় ২৫ বছর কাগাপাশা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি।
১৯৯৬ সাল। ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শাহ এসএম কিবরিয়ার নেতৃত্বে হবিগঞ্জ জেলার সকল উপজেলায় গড়ে ওঠে নতুন কমিটি। বানিয়াচং কমিটিও তার ব্যতিক্রম নয়। মনোনিত হন সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে।

প্রগতির ছোঁয়া। আঘাটে ঘাট, আপথে পথ কিংবা ‘বাপ দাদার নাম নাই চাঁন মোড়লের নাতি’এসব প্রবাদ প্রবচন ঘটমান সমাজে যখন চলমান; তখন বলতে দ্বিধা নেই কে চায় বাপ দাদার প্রতিষ্ঠা ছাড়তে! আর নামধাম তাত পরিচয় তো প্রশ্নই ওঠেনা! সত্যেন্দ্র চেয়ারম্যানসহ তাঁর ভাই বোন ছয় জন। সবাই যার যার মতো কম-বেশ পড়াশোনা করেছেন। মেজো ভাই বাবু সুবোধ চন্দ্র দাশ।

পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে। ছিলেন প্রিন্সিপাল, লক্ষীপুর ডিগ্রি কলেজের। উনিও ছাত্র জীবনে নীল পতাকার ছাঁয়া তলে দাঁড়িয়েছিলেন। পারিবারিক অতিথি হিসেবে উপস্থিতির কারণে, কোন এক বর্ষার কথোপকথন হতে জানতে পারি উনাদের পূর্বপুরুষরা নাম শেষে চৌধুরী ব্যবহার করতেন। ছিল ‘তাল্লুকী-ভূসম্পদ’। কালের পরিক্রমায় এসব ছেড়ে দিলে নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা ও সমাজ প্রগতির মুখে হাঁটতে গিয়ে, হয়ে গেলেন দাশ। সেই থেকে পিতা চৌধুরী লিখলেও নিজেরা শুরু করলেন দাশ।

সত্যেন্দ্র চেয়ারম্যান ছিলেন অনলবর্ষী। জানতেন ভাল ইংরেজি। আচরনে ছিলেন শিক্ষিত ও ভাল উপস্থাপক।

তাঁর বাড়িতে চলছিল কোন এক অনুষ্ঠান। উঠান ভরা মানুষের ভিড়। খুবই স্বাভাবিক ঘরে পড়া শার্ট ও লুঙ্গি পড়া অবস্থায় উপস্থিত হতে হয়েছিল উনার ডাকে। পরিচয় করিয়ে দিলেন ঐ এলাকার আদর্শ শিক্ষক-ব্যক্তিত্ব সর্বজন শ্রদ্ধেয় ধীরেন্দ্র বাবুর সংগে (বোয়ালিয়া ফকির মোহাম্মদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক)। লুঙ্গি পড়াবস্থায়, উঠান ভরা এতো এতো মানুষের সামনে, শিক্ষক ধীরেন্দ্র বাবুর নৈকট্যে আমাকে হিমালয়সম প্রশংসা ও স্নেহাচারনে সবাইকে তাক করে দিয়েছিলেন। যা আচরনগত শিক্ষিত ও ভাল উপস্থাপনা ছাড়া কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। সন্তান সমতুল্য হলেও পড়িয়ে দিয়েছিলেন স্নেহাসিক্ত সম্মানের মুকুট।

সত্যেন্দ্র চেয়ারম্যান বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ১৯৬৫ সালে। বিয়ে করেন নেত্রকোনার আরেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান বেলা রানীকে। তিনি তিন পুত্র ও ছয় পুত্রী সন্তানের জনক ছিলেন। পুত্ররা শিক্ষকতা, পাট অধিদপ্তর, এনজিও সংস্থায় কর্মরত সহ বড় কন্যা শিক্ষকতায় আছেন। সত্যেন্দ্র বাবু শিক্ষার প্রতি ছিলেন অনুরক্ত। তৎকালীন সময়ে নিজ ভাই-বোন সবাই কম-বেশ পড়াশোনা করলেও নিজের সবক’টি সন্তানকে পড়াশোনার বাহিরে রাখতে দেখা যায় নি। যদিও সবাই উচ্চ ডিগ্রীধারী নন। তিনি আশির দশকে নিজ গ্রাম সেকান্দরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন তাছাড়াও নব্বইয়ের দশকে কাগাপাশা জনতা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন।

গত ১৫ জানুয়ারি বুধবার তাঁর পরপার গমনে এলাকায় পড়ে শোকের ছায়া। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক শুভানুধ্যায়ী হতে আসছে শোক বাণী। তাঁর এই মহা প্রয়াণে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক পরিচিতি: সুশান্ত দাস: রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত