০৭ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:৪৫
এমন নয় কর্মসূত্রেই প্রয়াত অধ্যাপক আবদুর রহিমের সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি যখন এমসি কলেজে পড়তাম, আর আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা শাবিতে পড়ত; তখন তাঁর নাম প্রথম শুনেছিলাম; টি এম আহমদ কায়সারের মাধ্যমে। তিনি রহিম আজিজ নামে লিখতেন। তখনকার দিনে আমরা সবাই লেখকদের খুঁজে বেড়াতাম; তিনি কবিতা লিখতেন।
একবার শহরে ‘বইপত্রে’ কায়সার পরিচয় করিয়েও দিয়েছিল তাঁর সাঙ্গে। লিটলম্যাগ-সূত্রে আমাদের নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তিনি, আর পড়েও থাকবেন দু-একটা লেখা আমার। কারণ তখন আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন লিটলম্যাগে লিখতে শুরু করেছি। সেটা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। জাহাঙ্গীরনগর থেকে পাশ করে সাস্টে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হয়েছেন তিনি; আমরা-সব ছাত্র।
এদিকে শাবিতে যখন ২০১১ সালে আমি যোগদান করতে যাব আমাকে নিয়ে কিছু ঝামেলা তৈরি হয়; মানে ‘রাজনীতি’ শুরু হয়। সমস্যা দেখানো হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমসি কলেজের স্নাতক সম্মান ডিগ্রি আমার (কথা তো ঠিক; স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অবশ্য চ.বি.তে); অথচ তখন এমসি কলেজ বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন; কেউ-বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা সাধারণ ফলাফল নিয়েও। আমার ছিল পিএইচডি ডিগ্রি, আর অনার্স-মাস্টার্স দুটাতেই আমি মেধাতালিকার ওপরের দিকের রেজাল্টধারী; এছাড়া আমি কর্মরত এমসি কলেজের সহকারি অধ্যাপক পদেও, রয়েছে অনেক প্রকাশনা; ঢুকব মাত্র প্রভাষক পদে। সুতরাং আমার মাথায় কিছু ঢুকে না। জানতে পারলাম আমার নিয়োগ বোর্ডে অধ্যাপক আবদুর রহিম ‘নোর্ট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন। আমার মন খারাপ ছিল।
ক্যাডার সার্ভিস থেকে এখানে এসে কম বেতনে ও নিম্নপদে যোগদান করা এবং এই বিরোধিতা আমাকে একটু শঙ্কিতও করেছিল, সিদ্ধান্তটি ঠিকঠাক নিয়েছি তো? তাছাড়া অধ্যাপক আবদুর রহিম বিভাগীয় প্রধান। কিন্তু কেন জানি মনে ভরসা পেয়েছিলাম; এককালে কবিতা লিখতেন যে-মানুষটি তিনি নিশ্চয় আমাকে অসহযোগিতা করবেন না! আমার ধারণা সঠিক ছিল; যোগদান করতে গিয়ে দেখলাম তিনি সহজভাবেই গ্রহণ করেছেন আমাকে। তবে দু-একদিন দুজনের মধ্যে একটা অস্বস্তিও ছিল। আর সেই অস্বস্তি তিনি একদিন ভেঙে দিলেন নিজে থেকেই।
একদিন অপরাহ্নে বিভাগীয় প্রধানের অফিসে কেউ নেই, শুধু আমি আর তিনি। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘জফির, শোনো!’
শুরু থেকে তিনি আমাকে ছাত্রতুল্য ভেবে ‘তুমি’ই সম্বোধন করতেন। আমি শিক্ষকজ্ঞান করতাম তাঁকে। দুজনে ছিলাম আবার সতীর্থও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক দানীউল হকের ছাত্র হিসেবে। ওখানে আমি পিএইচডি করি। দানীউল স্যার তাঁর ব্যাপারে অনেক কথা বলতেন আমাকে। সে সবই ইতিবাচক।
তিনি পানি খেতে উঠলেন, একগ্লাস পানি খেলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন, দাঁড়িয়েই। বললেন, আমি তোমাকে জানি; আসলে তোমার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। কিন্তু বোঝো তো; রাজনীতি একটা খারাপ জিনিস। তুমি কিছু মনে করো না। আমি তোমাকে অসহযোগিতা করব না। তুমি মন থেকে সব ফেলে দাও। আসো একসঙ্গে কাজ করি। আমার দ্বারা তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।
একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন; গরম সেই হাত, তাঁকে খুব আবেগপ্রবণ মনে হলো। আমিও একটু এগিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বুক মিলালাম। বললাম, স্যার, আমি সব বুঝি; আমি কিছু মনে করিনি। মনে রাখবও না কিছু। আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আর আমি এখানে কাজ করতে এসেছি, রাজনীতি করতে নয়।
তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কী লিখছি।... মনের খেদ প্রকাশ করলেন, নিজে লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারেননি বলে। লিখতে পারছেন না বলে। বিশেষ করে সৃষ্টিশীল লেখা।
সম্পর্ক আমাদের সহজ হয়ে ওঠে।
বছরের শেষের দিকে একদিন আমাকে তিনি চেম্বারে ডাকলেন। বললেন, আসো, আমরা একসাথে কাজ করি; গবেষণা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী বিষয়। বললেন, তুমি ভাবো।
আমাদের দুজনেরই ফিল্ড ছিল সমাজভাষাবিজ্ঞানের। আমি ডায়েলেক্টলজির ওপর কাজ করেছি, আর তিনি লিঙ্গুয়েজ-প্ল্যানিংয়ের ওপর। সুতরাং জ্ঞানতাত্ত্বিক যোগাযোগ ভালো দুজনের। বিষয়টা মন্দ হবে না।
আমরা গবেষণা-প্রকল্পের কাজ শুরু করলাম। বাংলা টার্মিনোলজির ওপরে। গবেষণা-প্রস্তাব তৈরি করলাম দুজনে মিলে, প্রিন্ট দিয়ে দেখাতে বসলাম। বললেন, সুন্দর হয়েছে। প্রকল্পের গ্রান্ট আমরা পেলাম সে-বছর। টাকা পয়সার সব হিসাব তাঁর কাছে ছিল, যা খরচ হতো তিনি প্রশ্ন না করে দিতেন। সম্মানী যখন ভাগাভাগি হবে; তিনি চাইলেন সমান সমান ভাগাভাগি করতে। আমি রাজি হলাম না, বললাম প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর হিসেবে আপনি যা পাবেন তা নিবেন, আমি আমার পদানুযায়ী নেব। তিনি নিমরাজি হলেন, বললেন বেশিরভাগ কাজ তো তুমিই করেছ, টাইপ-টুইপ ইত্যাদি। আমি বললাম, সমস্যা নেই; আমি তো জুনিয়র।
সিনিয়র অধ্যাপক ও বিভাগের প্রধান হিসেবে তাঁর সঙ্গে কাজ করছি এটা আমার জন্য সম্মানের বিষয় ছিল, এছাড়া সিনিয়রদের সঙ্গে কাজ করলে শেখাও যায় অনেক। আমার লাভ তো অর্থ, অন-অর্থ দুই মিলেও হলো।
এরমধ্যে একটা ঘটনা ঘটে। আমি তখন নীচের দিকে ক্লাস করতাম। জুনিয়র বলে ওপরের ক্লাসে পড়ানোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি তখনো। যদিও এমসি কলেজে আমি এমএ ক্লাসে পড়িয়ে এসেছি। একদিন অপরাহ্নে বললেন, কথা আছে; দেখা করো।
তাঁর মুখ গম্ভীর ছিল; চিন্তিত থাকলে তিনি পানি খেতেন। পানি খাচ্ছিলেন। আমি তাঁর পাশে বসলাম। একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলেন; নামহীন একটা অভিযোগপত্র। আমার নামে।
কয়েকজন শিক্ষার্থী দিয়েছে। আমি পড়লাম। বললাম, নাম তো নেই কারো এখানে। আর জিজ্ঞেস করলাম, আপনি পেলেন কীভাবে?
বললেন, চার-পাঁচ জন ছাত্র দিয়ে গেছে। মুখের ওপরে আমি বললাম , এটা নোংরামি। ছাত্রদের কেউ ব্যবহার করছে। এটা ঠিক না। আপনি এ বাড়তে দেবেন না!
তিনি চুপচাপ ছিলেন। বললেন, হেড হিসেবে আমাকে তো গ্রহণ করতে হয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি পড়েছেন অভিযোগগুলো?
বললেন, হ্যাঁ।
সাত-আটটি অভিযোগের প্রথম দুটি ছিল আমি দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ধরে ক্লাস নিই এবং ক্লাসে এত তথ্য দিই আসলে তা পরীক্ষার জন্য দরকার নেই। যতসব মেরিটলেস অভিযোগ।
আমি হাসলাম, রসিকতা করে বললাম; যাই হোক নৈতিকতার স্খলন দিয়ে যে অভিযোগ করেনি তাই রক্ষে!
আমার কৌতুকে তিনিও হাসলেন।
তারপর তাঁর চোখে চোখ রেখে আমি বললাম, এখন আমার কথা হলো, আপনি এই অভিযোগ আমলে নিয়েছেন কি না?
তিনি বললেন, না।
-তাহলে তো আর কথা নেই।
তিনি তখন অভিযোগ পত্র ছিঁড়ে ফেললেন। আমার সামনেই। বিনে ফেলে দিলেন পরে।
আমি বললাম, কারো দীর্ঘ ক্লাস ভালো না লাগলে বেরিয়ে যাওয়ার তো সুযোগ আছে।... আর আমি যেভাবে পড়াই, সেভাবেই পড়াব।
তিনি আর কোনো কথা বলেননি। আমি শুধু বললাম, এসব প্র্যাকটিস ভালো নয়; এসব হতে দিলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ভেস্তে যাবে। পরিবেশও নোংরা হবে।
আমার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
পরের বছর আবার তিনি প্রস্তাব করলেন, চলো, গবেষণা-প্রপোজাল জমা দিই। আমিও রাজি হলাম। বিষয় ঠিক করলাম, রবীন্দ্রনাথের ভাষাতাত্ত্বিক চিন্তার ওপর। গ্রান্টও পেলাম, কাজ করলাম।
এর পরের বছর মণিপুরীদের ভাষার ওপর আমরা প্রপোজাল জমা দিলাম, কিন্তু কী কারণে পেলাম না। বললেন, এত ভালো প্রপোজাল ছিল; দিল না কেন বলতে পারো? আমি বললাম, জানি না তো।
পরে তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে আমার গবেষণা করার সুযোগ হয়নি। আর, তাঁর সঙ্গে তখন আমার সম্পর্ক মধুর থেকে মধুরতর হয়ে গেছে।
আমার কাছ থেকে রেয়ার বই ধার নিতেন; আমিও তাঁর কাছ থেকে বই আনতে বাসায় যেতাম। গল্প করতাম, চা খেতাম। আবেগ নিয়ে কথা বলতেন; ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছু। কিন্তু কথা তিনি খুব কম বলতেন।
একদিন তিনি হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন। বললেন, তুমি হঠাৎ রেগে যাও কিন্তু খুব নরোম মনের মানুষ। বুঝলাম কিছু একটা বলার জন্য ভূমিকা করছেন তিনি।
আমি বললাম, অন্যায় কিছু হলে কেবল এটা হয় আমার ক্ষেত্রে। মাথা ঠিক থাকে না।
বললেন, আমি তো প্রথম প্রথম তোমাকে খুব অবজার্ভ করতাম। কারণ, তুমি চাকরির দরখাস্ত করার পরে একজন আমাকে বলেছিল, তুমি খুব ফেরোসাস টাইপের মানুষ!
শব্দটার অর্থ আমি জানতাম। একটু কষ্ট পেলাম, একজন মানুষের আমার সম্পর্কে এই ধারণা? কী এমন করেছি তার সঙ্গে? আমি কিছু ভেবে উঠতে পারছিলাম না। অনুমান করছিলাম, এমন ফেরেশতা কে হতে পারেন!
আমার বেদনার্ত মনোভাব বুঝতে পারলেন তিনি; বললেন আমি দীর্ঘদিন সেভাবেই তোমাকে ভেবেছি। কিন্তু কেন যে তিনি এমন কথা বলেছিলেন আজও বুঝে উঠতে পারি না।
তাঁর চোখে মানুষ সম্পর্কে একটা হতাশার ভাব ছিল। চোখ চকচক করছিল।
আমি বললাম, আমি মনে হয় বুঝতে পারছি তিনি কে?
পান খেতে খেতে হাসি মুখে বললেন; বোঝার কী দরকার! এমন মানুষের কথা ভেবেও লাভ নেই।
আমি বললাম, দেখুন, এমন মানুষের কথা আপনি কিন্তু আমলে নিয়েছিলেন!
তিনি বললেন, আমি যাচাই করেছি, বিশ্বাস তো করিনি। আসলে অনেকে চাইত না তুমি এখানে চাকরি করো! আসলে কেউ কাউকে ছোটো করতে পারে না, আর আটকে রাখতেও পারে না। যে কাজ করে তাকে কেউ আটকে রাখতে পারে না।
এদিকে আমি তখন দেশের বাইরে যেতে শুরু করেছি। সেমিনারে, বেড়াতে। তখন তাঁর হেডশিপ নেই, অনেকটা ফ্রি হয়েছেন। আমাকে একদিন বললেন তোমার সঙ্গে কোনো জায়গায় সম্ভব হলে নিও। আমি জিজ্ঞেস করলাম, যাবেন?
কয়েকমাস পরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেমিনার হবে। আমি বললাম, চলুন আসামে।
আসাম থেকে নিমন্ত্রণপত্র আসল, ওরা একটা সেশনের চেয়ার করল তাঁকে। ভিসা প্রসেসিঙে যাব, বললেন, আমি একা যেতে পারব না; সঙ্গে আরেকজনকে নিতে হবে। বাংলা বিভাগের পুরোনো এক ছাত্রের কথা বললেন, তারও নিমন্ত্রণপত্র আসলো।
শেষ পর্যন্ত তাঁর যাওয়া হলো না।
আমি ফিরে আসার পর আফসোস করলেন। আসলে তাঁর মধ্যে সবসময় একটা হোম-সিকনেস কাজ করত।
তাঁর সঙ্গে এক-সময় হাসি ঠাট্টার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়; একাডেমির আলাপের বাইরে দেখা হলে বলতাম, কী খবর কবি-সাহেব?
তিনি লজ্জা পেতেন, হাসতেন; বলতেন, কবি তো তুমি। এই আমি, যৌবনে যেমন হয়, লিখেছি আর কি।
আমাকে ডাকতেন ‘কবিবর’ বলে, দেখা হলেই, সব সময়। কী কবিবর কেমন আছ? আমি হাসতাম।
আমি বলতাম, লিখেন না কেন?
বলতেন, বয়স হয়েছে, ভালো লাগে না।
আমি বলতাম, কী আর বয়স আপনার; দেখলে তো ইয়াং লাগে। আসলে ইয়াং ম্যান আপনি! নিজে নিজে বুড়া হলে কি চলে?
বলতেন, বুঝেছ, ভালো লাগে না।
এই একটা কথা অনেক শুনেছি তাঁর মুখে। আমি বলতাম, হতাশ হবেন না; হতাশ হলেন তো শেষ।
হতাশ ছিলেন তিনি নানা কারণে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তাঁকে ভালো থাকতে দেয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হওয়ার পরও সিন্ডিকেট থেকে বাদ পড়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন তিনি।
এদিকে তাঁর বন্ধুরা ভিসি হয়েছেন, বড়ো বড়ো পদে গেছেন; তিনি এখানে পড়ে আছেন, কেউ কেউ তাঁকে খোঁচাও দিত। এতে আক্ষেপ বাড়িয়ে তুলত তাঁর, আরো হতাশ হতেন হয়তো।
তিনি বাংলা বানানের ওপর কাজ করেছেন; বইও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর নিজের একধরনের ধারণা ছিল বানানের ওপর, আমার সঙ্গে মিলত না। আমি যুক্তি দিতাম, তিনিও যুক্তি দিতেন। বাংলা বানানের ইতিহাস জানতেন তিনি। আমি বলেছিলাম এ নিয়ে বই লিখুন, বলতেন; দেখি।
প্রায়ই দূর থেকে বলতেন, এই জফির, এই শব্দের বানান কী, বল তো?
ভাষা-পরিকল্পনার ওপর বইটি যখন দেন, আমি বললাম, পড়ব। পড়েওছিলাম, বলেছিলাম; আমার কিছু মতামত আছে; লিখিতভাবে জানাব। হেসে বলেছিলেন, তোমার কি সেই সময় হবে?
আমি বলেছিলাম, সিরিয়াসলি বলছি; আমার আসলেই কথা আছে, বিরুদ্ধে নয়; মতামত।
বলেছিলেন, আচ্ছা।
মাঝে মাঝে বলতাম, গদ্যও তো পারেন লিখতে, লিখেন না কেন?
হেসে বলতেন, ভাইরে, তোমার মতো শক্তি নাই।
আমি বলতাম, আপনি চেয়ারে বসলেই হবে; শুরু করেন।
আমি তখন ন্যাশনাল কারিকুলামে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বইয়ের কাজ করেছি; বইটি ভুলে ভরা ছিল একসময়; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ আর আমি নতুন সংস্করণে ঠিক করে দিই। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, মেয়ের সূত্রে। প্রশংসা করেছিলেন। নতুন কারিকুলামের বইগুলোতে লেখক হিসেবে যখন কাজ করি, বইগুলো প্রকাশ হতে থাকে তখন বিতর্ক হয়।
আমাকে বললেন তিনি; কীসব বই লিখছ তোমরা?
আমি বললাম, বেশির ভাগ মানুষ না পড়েই মন্তব্য করে; আর কই, বাংলা বই নিয়ে কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই। বইটি দেখে পরামর্শ দেবেন।
বলেছিলেন, দিও। দেওয়া হয়নি বই আমার।
আমরা দুজনে যে-গবেষণা করেছিলাম, তা ছিল মৌলিক কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি। আমি প্রায়ই বলতাম, চলুন ওগুলো প্রকাশ করি। তিনি বলতেন, তুমি তো ব্যস্ত মানুষ, করো।
আমি বলতাম, সব গুছিয়ে আপনাকে নিয়ে বসব।
কিন্তু বসা হয়নি আমাদের।
গত বছরের শুরুর দিকে হঠাৎ বুঝতে পারি তিনি আমাকে এড়িয়ে চলছেন। তিনি শিশুর মতো ছিলেন; মনকে পড়া যেত। আমি ভাবলাম, কিছু একটা হয়েছে।
জিজ্ঞেস করি একদিন, কী কবি-সাব, কেমন আছেন? জবাবে না দাঁড়িয়ে তিনি ‘আছিরে ভাই’ বলে চলে যান। আমি বিস্মিত হই এই আচরণে। এর আগে একট ব্যাপার ঘটেছিল, যা এখানকার আলোচনার বিষয় নয়, সে জন্য তো তা হতে পারে না।
তাঁর প্রতি আমারও কোনো বিরাগ নেই। তাহলে? আমি বুঝলাম সরল মানুষটাকে কেউ কিছু বুঝিয়েছে!
আবিষ্কারও করলাম, সে বছর তিনি গবেষণার গ্রান্ট পাননি; আর কেউ তাঁকে বলেছে; আমি রিভিউ করেছি আর ‘নট’ করে দিয়েছি। কিন্তু আমি কোনো প্রপোজাল রিভিউ করিনি। আর সহকর্মীদের গবেষণা মূল্যায়নে আমি সবসময় ইতিবাচক মন্তব্য করেছি এপর্যন্ত; প্রমাণ আছে সব জায়গায়। অথচ বিনা কারণে আমি দোষী হয়ে ঘুরছি তাঁর সামনে। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
কিছুটা অভিমানও হলো তাঁর ওপর; আমাকে তো জানেন তিনি; জিজ্ঞেস করলেই পারতেন?
কিন্তু স্বভাবসুলভ আমি বিচলিত থাকি এবং বুঝতে পারি কারা এটা করেছে। কিন্তু তাঁর এ মনোভাব আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।
আমি গবেষণা সেন্টারের তৎকালীন পরিচালকের কাছে বিষয়টা শেয়ার করি এবং আমার অনুশোচনার কথা বলি। তিনি বলেন, আপনি তাঁর ভুল ভাঙাতে পারেন।
আমি বিভাগের দুজন সহকর্মীর সঙ্গেও শেয়ার করি; তাঁরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলে মনে হয়নি। বলেছিলাম, আপনারা স্যারকে বলিয়েন, আমি কোনো রিভিউ করিনি। আর কানকথা-পাড়া মানুষদের কথা তিনি কেন শুনবেন? অভিমান ও ভালোবাসা থেকেই কথাগুলো বলেছিলাম।
অবশেষে এক দুপুরে আমি তাঁকে প্রসঙ্গটি তুলি। সরাসরি বলি, ‘স্যার, আপনাকে মনে হয় কেউ বলেছে আমি আপনার প্রপোজাল রিভিউ করেছি। কথাটা ঠিক নয়, মিথ্যাচার।’
কথার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁর হাবভাবে বুঝলাম, আমার ধারণা ঠিক; এ কারণেই তিনি অভিমান করে আছেন।
জবাব দিলেন, তুমি যখন রিভিউ করোনি তাহলে তো কথা নেই।
মনে হলো পুরোটা নিঃসন্দেহ হতে পারেননি তিনি; বললাম, আপনি সেন্টারের গিয়ে যাচাই করে নিতে পারেন; আমার কথা সত্য কি না।
হাসলেন এবার, বিশ্বাস করলাম তো তোমার কথা।
তারপর সম্পর্ক আবারও স্বাভাবিক হয়, আমাকে কবিবর বলে ডাকা শুরু করেন।
যখন আইএমএলের পরিচালক হলেন, আমি অভিনন্দন জানিয়ে বললাম; এবার একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্স করেন কবিসাহেব। জাপান, চায়না, ইউরোপ থেকে বড়ো বড়ো অধ্যাপকদের এনে বক্তৃতা করান। আমার পরিচয় আছে; সাহায্য করব আপনাকে।
জবাবে বললেন, দেখি কী করা যায়, বুঝি আগে।
মাস কয়েক আগে একদিন রাতে দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব বেঙ্গলি ল্যাগুয়েজ আমার খুব দরকার পড়েছিল। বইটি তাঁর কাছেই রয়ে গেছে। পরের দিন দেখা হলো বিভাগে, বললাম, স্যার বইটি একটু দেবেন?
হেসে বললেন, তোমার কাছে তো আরেকটা কপি আছে, তাই এটি আমার কাছে রেখে দিয়েছি।
আমি বললাম, আপনার তো দেখি সব মনে আছে।
আসলে পুরোনো তিন খণ্ডের সংস্করণ একটি থাকা সত্ত্বেও রূপা থেকে প্রকাশিত অখণ্ড বইটি আমি সংগ্রহের জন্য কিনেছিলাম। আমি বললাম, তাহলে দরকার নাই পুরানটা দিয়ে কাজ সেরে নেব। এটি বরং আপনার কাছে থাকুক।
হেসে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন তিনি।
বইকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। আমি বই দিলে খুশি হতেন। প্রত্যাশাও করতেন। সেদিন বিষয়টা বুঝেছিলাম।
ঢাকা থেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ গেস্ট আমাদের বিভাগে এসেছিলেন। যাওয়ার বেলা যখন দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল, একফাঁকে আমার ওপর তাঁর অনুযোগটা বেরিয়ে পড়ল। ‘জফিরের অনেক বই; প্রতি বছর বই বের হয়, আগে দিত এখন আর দেয়না আমাকে।’
আমি অনেক লজ্জা পেয়েছিলাম। আসলে কোভিডের পর প্রকাশকরা তেমন বেশি বই লেখকদের দেয় না। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেককে দিতে পারি না। তাই হয়তো দেওয়া হয়নি।
লজ্জা ঢাকার জন্য বললাম, কই দেই তো আপনাকে; সব বই!
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, কই তোমার নতুন কবিতার বই তো দাওনি!
আমি ভেবেছিলাম বইটির খবর তিনি জানেন না।
আমি স্বীকার করলাম, হ্যাঁ, এটা দেওয়া হয়নি।
বই তো নয়, আসলে এর সঙ্গে একটা অনুভূতির সম্পর্ক ছিল বুঝতে পারি। ভেবেছিলাম আমি করচ গাছ দেব তাঁকে।
কিছুদিন একদিন দুপুরে দেখতে পাই তিনি বিভাগীয় অফিসকক্ষে বসে হাঁপাচ্ছেন। তাঁকে খুব ক্লান্ত ও বিমর্ষ মনে হয়। জানতে পারি কিডনি সমস্যাটা জটিল হয়ে উঠছে। আমি বললাম, আপনি রেস্ট নেন।
সেদিন তিনি খুব ফিটফাট ছিলেন। সোনালি রঙের ঘড়ি ছিল কব্জিতে। আমি হেসে বললাম, আরে বিয়ের ঘড়ি নাকি; কি চকমকে!
ঘড়িটি আসলেই সুন্দর ও নতুন ছিল। হেসে বলেন, সেই স্মৃতি বহন করে চলেছি। এই সম্বল।
অধ্যাপক আবদুর রহিম একজন স্মৃতিকাতর মানুষ ছিলেন; কিন্তু প্রকাশ করতেন না। আজ সেইসব সোনালি স্মৃতি নিয়ে তিনি চির রেস্টে চলে গেলেন, আর আমি ভাবিনি কখনো তাঁর জন্য এভাবে এখন স্মৃতিতর্পণ করতে বসতে হবে। যখন আমার মন ভীষণ ভারাক্রান্ত, বিষণ্ন আর চঞ্চল।
তিনি আমার কাছে এক উজ্জ্বল স্মৃতি; তাঁর দিক থেকে স্নেহের, আমার দিক থেকে শ্রদ্ধার। সরল মানুষ ছিলেন তিনি। সহজ মনের।
সেই ভয়াল সংবাদটি চোখে পড়েছে রাত দেড়টায়, মোবাইলের স্ক্রিনে। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু সত্যি কি নেই?
আমি ভাবি, কোথায় হারিয়ে যায় মানুষ? জীবনের শীর্ণ পথ ধরে; কোথায়, কোন অন্তরীক্ষে?
অক্টোবর ৭, ২০২৫, সিলেট
ডক্টর জফির সেতু : কবি, আখ্যান-লেখক, গবেষক ও অধ্যাপক।
আপনার মন্তব্য