সৈয়দ রাসেল

১৯ জুন, ২০১৬ ১৩:২২

বাবা: অন্তহীন ভালোবাসি

চাকরি সূত্রে নিজের আমাদের থেকে অনেক দূরেই ছিলো বাবার প্রাত্যহিক বসবাস। কখনও এ শহরে কখনও বা ওশহরে বদলির কারণে বাবা আর আমাদের দেখা হতো অন্তত মাস পাঁচেক পর পর। বাবা কখনো বলে কয়ে বাড়িতে আসেননি। বিকেল বেলা বাড়ির পশ্চিম পাশে খেলতে গিয়ে অজানাভাবে হঠাৎ করেই বাড়ির পথে ধীর পায়ে অগ্রসরমান বাবাকে আবিষ্কার করতাম। দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কাঁধের ব্যাগ কষ্ট করে হলেও তুলে নিতাম আমাদের কাঁধে। তারপর বাবার আগে আগে হেঁটে চলতাম বাড়ির পথে। সেই ছোট্টবেলা দীর্ঘ বিরতি দিয়ে পাওয়া বাবার সান্নিধ্য অনেক আরাধনার অনেক আনন্দের। বাবাকে নিয়মিত কাছে না পেয়ে মাঝে মাঝে অনেক মন খারাপ হতো। তবু প্রয়োজনে বাবার এই দূরে থাকাটা মেনে নিতাম।

এখনও মনে আছে, ছোট্ট বেলা বাবা আমাদেরকে নিয়ে অনেক মজা করতেন। মাঝে মাঝে আদুরে হাতে চিমটি কাটতেন, তারপর পেট থেকে শয়তান বের করার নাম করে সুড়সুড়ি দিতেন! বাবার এমন অসম্ভব ভালোবাসার সাথে আমাদের ভালোলাগার উপলব্ধিগুলো তুলে ধরা অনেক কঠিন।

বাবা শীতের সকালে ব্রাউন কালারের বিশাল একটা চাদর পরে যখন খাটের উপর বসতেন, তখন আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে কে আগে বাবার কোলে বসবে এ নিয়ে অনেকটা কাড়াকাড়ি লেগে যেতো। আ যে এই সুযোগ পেতো তার আনন্দের সীমা থাকতো না। শুধু মুখটা বের করে বাবার কোলে একেবারে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকার অনুভূতিটা আসলেই অন্যরকম।

তারপর ১৯৯৩ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাবার স্বেচ্ছায় অবসর। আর সেই থেকেই বাবার মেজাজি হয়ে ওঠা। সারাক্ষণ শুধূই উপদেশ। এভাবে জীবন চলবে না, খেলাধুলায় পেট ভরবে না, এই করো ওই করো। আমাদের সেই সহজ সরল বাবার আদুরে স্পর্শ আর ভালোবাসা কোথায় যেনো নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো। বাবাকে আর বাবা হিসেবে পাইনি, পেয়েছি শুধুই একজন কট্টর পরামর্শক হিসেবে। তবে আমাদেরকে শাসন করার মতো কোন উপলক্ষ সৃষ্টি হয়নি বলে বাবার শাসন দেখিনি।

১৯৯৩ থেকে ২০১০ সাল। আমরা ভাই বোনেরা তখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। বেঁচে থাকার মতো সামান্য একটা চাকরিও করি। তবু বাবার উপদেশ আর শেষ হয়নি। যেন আমি কিছুই একেবারেই অকর্মণ্য।

অবসরকালীন এই দীর্ঘ সময় শুধুই উপদেশ ছাড়া বাবা আমাদেরকে নিয়ে কখনও সামান্য হাসি মুখে কথা বলতে দেখিনি। যদিও এই উপদেশগুলো আমাদের ভালোর জন্য, তারপরও মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগতো। আরো খারাপ লাগতো উপদেশগুলো আমাদেরকে সরাসরি না বলে মাকে বলতেন, এজন্য। অনেকদিন উপদেশ শোনে রাগ করে বলেছি- ‘আপনি সারা জীবন বেশ ভালো একটা সরকারি চাকরি করার পরও গ্রামের বাড়িতেও আমাদের জন্য একটা ভালো ঘর পর্যন্ত বানাতে পারেননি। তো এতো বুদ্ধি আর উপদেশের কোন মানে নেই। দেখবেন আমরা ঠিকই পারবো।’ শোনে বাবা আর কিছু বলতেন না।

তবে সামনাসামনি বাবা আমাদেরকে শুধু বকাঝকা করলেও বাইরের অনেকের কাছে আবার আমার লেখালেখির প্রশংসা করতেন। শোনে বেশ ভালোই লাগতো। প্রশংসা শোনে কার না ভালো লাগে! তাও বাবার মুখ থেকে।

বাবা অনেক বেশি সিগারেট খেতেন। এ নিয়ে বাবার সাথে অনেক ঝগড়াও হতো। বকাঝকার কারণে কতোবার বাবা সিগারেট খাওয়া বাদ দিলেন আর ধরলেন! তবে সবশেষে যখন সিগারেট ছাড়লেন তখন নানা অসুখ বাবাকে একেবারে মুঠোয় পুরে নিয়েছে।

বাবা মনে প্রাণে একজন আওয়ামীলীগার ছিলেন। বলতে গেলে অন্ধভক্ত। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। আ’লীগের প্রতি বাবার অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণে ৯৬এর নির্বাচনে আমাদের বাড়িতে কোন জামায়াত সমর্থক তাদের প্রার্থীর পক্ষে লাগাতে পোস্টার লাগাতে পারেনি।  

 এইতো বছর দেড়েক পূর্বে বাবা ভীষণ অসুস্থ, একেবারে শয্যাশায়ী। ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত। বিরোধীদল এই বাঁধের জন্য আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করছে আর আ’লীগ নিজেদেরকে নির্দোষ  প্রমাণ করতে নানা কথাই বলে যাচ্ছে। কিন্তু কারো কথায় প্রকৃত বিষয়টা ওঠে আসছে না। নেতৃবৃন্দের উদ্ভট কথা শোনে বাবার সে কি রাগ। একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমি টিপাই বাঁধের ব্যাপারে জনগণকে জানাবো। যা খাতা কলম নিয়ে আয়, আমি বলবো আর তুই লিখবি।’ কথামতো খাতা কলম নিয়ে প্রস্তুত হলে বাবা বলতে শুরু করলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বলেই চলেছেন। তিনি যে এতো জানেন আর তাঁর মুখ থেকে এসব অজানা তথ্য জেনে এমন বাবার ছেলে হিসেবে গর্বে আমার বুকটা ভরে ওঠেছিল। এমনিতেই জানতাম, তবু বাবার কথা থেকে আবারো জানলাম যে আমাদের রাজনীতিবিদরা কতোটা মূর্খের মতো কথা বলে।

বড় হওয়ার পর বাবা আমাদেরকে এতোটা ভালোবাসেন তা বুঝলাম ২০১০ এর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডের পথে পা বাড়ানোর সময়। বিদায়ের কয়েকদিন আগে থেকেই বাবার কান্না শুরু। বিদায়ক্ষণে আমাকে জড়িয়ে ধরে এতো কাঁদলেন। বিমানে ওঠার আগ পর্যন্ত যতোবার বাসায় ফোন করেছি ততোবারই শুনেছি বাবার কান্না থামেনি। এই অস্থির কান্নার কারণে বাবাকে একসময় অপারেশন থিয়েটার পর্যন্ত যেতে হলো। চিকিৎসকদের মতে হঠাৎ পাওয়া বড় ধরণের কষ্টই বাবার এই অসুখের কারণ। বাবার এই নীরব ভালোবাসা তখন থেকেই অনুধাবন করতে শুরু করেছিলাম।

কয়েকমাস পর দেশে এসে আবারো সেই আগের চাকরিতে যোগ দিলাম। তবে বাবা হয়তো মনে করেছিলেন আমাকে পেয়ে বসেছে বেকারত্বের অভিশাপ। এজন্য আমাকে নিয়ে ছিলো তাঁর যতো চিন্তা।

এইতো মৃত্যুর ক’মাস আগে একদিন বাবা আমাকে বাজার থেকে কলা আনতে বলেছিলেন, সাথে টাকাও দিতে চেয়েছিলেন। টাকা আছে বলে আমি নেই নি। সেদিন তখনো আমি বাসা থেকে বের হইনি। শুনতে পাই চোখ বন্ধ করে বিছানায় শায়িত বাবা মাকে বলছেন, ‘তাকে কলা আনতে (আমি) টাকা দিলাম, কিন্তু সে নিলো না, সে টাকা কোথায় পাবে? সে কি রোজগার করে?’

কথাটা শোনে চরম মমতায় সেই ছেলেবেলার মতো বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করেছিলো। আবার খারাপ লেগেছিলো, খুব খারাপ লেগেছিলো যে আমার প্রতি বাবার এমন গভীর ভালোবাসা কখনও বুঝতে পারিনি বলে।

২০১০ সালের শেষের দিকে বাবার শরীর ভীষণ খারাপ। একবারেই শয্যাশায়ী। কিন্তু বাবা ডাক্তারের কাছে যেতে চাইতেন না। বাবা মনে করতেন ডাক্তারের কাছে গেলেই অনেক টাকা প্রয়োজন হবে আর সেই টাকার যোগান দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এরপর অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার জানালেন বাবার শ্বাসযন্ত্র অকার্যকর হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। চিকিৎসকের পরামর্শনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বাবার শারীরিক অবস্থার ক্রমশ আরো অবনতি। ওখান থেকে বাবা আর ভালো হয়ে বাসায় ফেরেননি। দীর্ঘ পাঁচ দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে বাবা মৃত্যুর সাথে লড়াই করলেও অবশেষে তাঁকে পরাজিত হতে হয়। বাবাকে ঘিরে স্বজনদের কান্নার রোল ওঠে। যে কান্না সবাইকে জানান দেয় বাবার মৃত্যুর কথা।

বাবা আমাদেরকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারতাম না। আর যাকে ভালোবাসা যায় উপদেশ তো তাকেই দেয়া যায়। শুধু উপদেশ দিয়েই নয়, মৃত্যুর আগে একাধিকবার আমাদেরকে নিরবে জানান দিয়েছেন তাঁর ভালোবাসার কথা। অথচ আমরা বাবাকে বলতে পারলাম না, বুঝাতে পারলাম না ‘বাবা তোমাকে আমরা অনেক ভালো বাসি।’  

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


আপনার মন্তব্য

আলোচিত