দেব প্রসাদ দেবু

১৯ জুন, ২০১৬ ১৮:৪৪

বাবা বাড়ি ফিরলেন

ছবি: ফারুখ আহমেদ

বছর দেড়েক আগে যখন জ্যাঠামশাই মারা যান তখনই মনের অজানা একটা চাপ ছিলো, একটা প্রজন্মের, পূর্ব পুরুষের বিদায় যাত্রা বুঝি শুরু হলো এবার। জ্যাঠামশাই ছিলেন নিপাট গ্রাম্য এবং আধুনিকতা বিমুখ মানুষ। যিনি মোটর যানে চড়তেন না। সামাজিক দাওয়াতে যেতেন না। আক্ষরিক অর্থেই জ্যাঠামশাই ভয়ঙ্কর রকমের রক্ষণশীল হিন্দু ছিলেন। ডেকোরেশনের প্লেট-গ্লাসে খেতে চাইতেন না ওগুলো মুসলিমদের অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয় বলে, ওতে গোমাংস খাওয়া হয়। ধুতি পাঞ্জাবী ছাড়া কখনো শার্ট পরতে দেখিনি আমরা । ধর্ম-কর্মে অগাধ আস্থা, গোঁড়া এবং বিশ্বাসী হবার পরও প্র্যাক্টিক্যালি খুব একটা ইনভলভ হতেন না এসবে। মন্দির কিংবা মণ্ডপে গিয়েছেন হয়তো কালে ভাদ্রে, চুপিসারে। উচ্ছ্বাস ছিলোনা এসবে। নিজের ক্ষেত খামার নিয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। পারিবারিক ব্যবহার্য জিনিষপত্র যেটা ক্ষেত খামারের কাজে লাগে সেটা উনি নিজেই তৈরি করতেন যত্ন করে। একসময় তামাকের হুক্কা টানাতে প্রচণ্ড আসক্ত থাকলেও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে সেটাও উনি ছেড়ে দেন। জীবন যাত্রায় বাহুল্যের লেশ ছিলো না এতোটুকু।     

নিজের ছেলে মেয়েদের প্রতি রূঢ়তার একটা মেকি দেয়ালে নিজেকে সারাজীবন বেঁধে রাখলেও আমরা দুই ভাইয়ের প্রতি একটা অন্যরকম মমতা ছিলো জ্যাঠামশাইয়ের। ছোট বেলায় বাঘা যতিনের গল্প বলতেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের গল্প বলতেন মাঝে সাঝে। বিবিসি’টা শুনতেন আমাদের রেডিওতে। শুধু শুনতেন, মন্তব্য করতেন না কখনো। সন্ধ্যা রাতেই শুয়ে পড়তেন। ’৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর যেদিন স্বৈরাচারের পতন হলো, সেদিন শুধু ওনাকে উচ্ছ্বাস দেখাতে দেখেছি বিবিসি’র খবর শুনে। জ্যাঠামশাই ভালোবেসে এবং লুকিয়ে মৌসুমি খাবার খেতে দিতেন আমাদের। লুকিয়ে দিতেন দুটি কারণে। এক- বাবা আমাদের স্বাস্থ্য নিয়ে এতো বেশি ওরিড থাকতো যে দেশিয় ফল প্রায় খেতেই দিতো না। কেন জানি দেশীয় ফলের প্রতি বাবার একধরনের বিমুখতা ছিলো। যেমন লিচু খেলে পেট খারাপ করবে, কাঁঠাল খেলেও তাই, কলা খেলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে এই সব। তার বদলে মাঝে সাঁঝে বাবা আপেল কমলা কিংবা আঙুর কিনে আনতো দূরের বাজার থেকে। নিপাট গ্রামে সেটা তখন অনেকটাই বিলাসিতা। বাবার জন্যতো বটেই। সামান্য স্কুল শিক্ষকের নির্দিষ্ট আয়ে এটা বাড়াবাড়ি রকমের বিলাসিতাই। দেশিয় মৌসুমি ফলের প্রতি আমাদের সেই আগ্রহটা মেটাতেন জ্যাঠামশাই।    

আমাদের সেই জ্যাঠামশাই মারা যাবার পর আমি বাড়ি যেতে পারিনি। পারিনি কারণ পেশাগত ট্রানজেকশন পিরিয়ডে অদ্ভুতুড়ে এক জটিলতায় আটকে ছিলাম। যেটা সামাল দিতে তিন মাসের এক গোলকধাঁধায় পড়তে হয়েছিলো আমাকে। সেটা কেটে গিয়েছে, কর্মজীবন নিজ ছন্দে ফিরেছে। কিন্তু অন্য আতংকে স্বাভাবিকতার চেয়ে ভিন্ন এক জীবন আমার। ছকে বাধা, এক ঘেয়ে, অস্বাভাবিক, অনিশ্চিত। অফিস বাসার বাইরে তেমন কোথাও যাওয়া হয় না এখন।
   
বাড়ি যাওয়া হয়না অনেকদিন। কোন কারণ নেই, এমনিতেই। যখন যাওয়া জরুরি হলো তখন অনন্যোপায় হয়ে বছর খানেক আগে বাড়ি গেলাম। জরুরি ছিলো কারণ বাবা ভয়াবহ রকমের বার্ধক্য জনিত জটিলতায় ছিলো। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় অবস্থান বাড়িতে। বাবার সাথে বন্ধুত্বটা সেই কিশোর বেলাতেই হারিয়ে ফেলেছি আমরা। জ্যাঠামশাইয়ের মতো রূঢ়তার দেয়ালে বাবা নিজেকে আটকে ফেলেননি ঠিকই, কিন্তু একটা রাশভারী সূক্ষ্ম দেয়াল ঝেঁকে বসে বাবার চারপাশে। দূরত্বটার শুরুতে বড্ড কঠোর মনে হতো তাকে। পরে বুঝতে পারি প্রগাঢ় স্নেহ আর মমতা দিয়ে ঘেরা বাবার দেয়াল। না, ভাঙ্গার চেষ্টা আমরা কখনো করিনি, সাহস হয়নি। ভয় পেতাম খুব। চাইতেও পারিনি দেয়াল ভেঙ্গে কিছু, কিংবা চাইতে হয়ওনি খুব একটা। না চাইতেই পেয়েছি সব। যা পাইনি সেটা সাধ্যের সীমাহীন অতীত বলেই পাইনি। সীমাহীন অতীত বলছি একারণে একটা মানুষ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্কুলে শিক্ষকতা করে নিপাট একটা গ্রামে রাত নয়টা- দশটা পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলে মেয়ে পড়িয়েছেন নিজের পরিবারকে ভালো রাখবেন বলে। ছুটির দিনে বাড়ির চারপাশে সাগর কলার বাগান করেছেন অল্প কিছু আয় বাড়াতে।       
   
স্কুলে পড়ার সময় বাড়িতে ইলেট্রিসিটি ছিলোনা, হারিক্যানের টিম টিমে আলোয় পড়তাম আমরা। মাসের শুরুতে এই জ্বালানীটা কিনতেন গ্যালন ভর্তি করে, ছেলেরা পড়বে। গ্রামের ছেলে মেয়েরা যখন নিউজপ্রিন্টে রাফ খাতা ব্যবহার করে আমরা তখন হোয়াইট পেপারের রিম চিনি। বাবা শহর থেকে রিম ধরে কাগজ আনিয়ে নিতো, আমরা অপচয় করতাম। বাবার রা ছিলোনা এসবে। শিক্ষা উপকরণ নষ্ট করলেও আপত্তি নেই ওনার। আপত্তি ছিলো টিভি দেখা নিয়ে। টিভি দেখা বলতে বাড়ি থেকে আরো খানিক এগিয়ে গিয়ে, পাড়ার সামনের অংশে, যেখানে ইলেক্ট্রিসিটি আছে ওখানে চুপিচুপি ম্যাকগাইভার দেখতে যেতাম বুধবার রাতে। ফিরে এসে বকুনি খেতাম খুব। খুব রাগ হতো! স্কুলের ছেলেরা কতো কতো গল্প করে! আর আমরা দেখতেই পারিনা। কিন্তু সান্ত্বনা পেতাম এই ভেবে যে বাবা কখনো গায়ে হাত তুলতোনা, অন্যদিকে মা পিটুনি দিতো। টিভি দেখার অনুমতি ছিলো কেবল শুক্রবার। তাও সকাল সাড়ে নয়টার পর। মনে হতো ছকে বাধা জীবন প্রায়। বিপরীতে বাবা ফুটবল কিনে দিতো, র্যাকেট কিনে দিতো, বিকেলে খেলতে যেতে বলতো। খুব সেন্সেটিভ ছিলো প্রাইভেট মাস্টারের বেতন নিয়ে। এক তারিখে মাস্টারের বেতন দেয়া চাই। এমনও হয়েছে মাসের শেষে হাত খালি, কিন্তু ধার করে এক তারিখে বেতন দিয়ে দিয়েছেন। একটা ঘটনা বলি- ব্রজেন্দ্র স্যারের কাছে ইংরেজি-অংক এগুলো পড়তে যেতাম। একবার উনি খুব অসুস্থ। মাসের মাঝামাঝি সময়। হার্টে ভাল্ব লাগাবে। আমাদের একমাসের ছুটি। বাবাকে এসে বলার পর উনি সাথে সাথে রওনা দিলেন স্যারের বাসায়। মাসের মাঝামাঝি সময়ে গিয়ে দিয়ে আসলেন ঐ মাসের বেতন। স্যার যখন চিকিৎসা শেষে ফিরলেন, আমরা দেখতে যাবো স্যারকে, বাবার অনুমতি নিলাম যাবার জন্য (না বলে বাড়ি থেকে বেরুনো নিষেধ)। উনি আমাদের টাকা দিয়ে বললেন স্যারের বেতন দেয়া হয়নি গত মাসে, দিয়ে দিও। আমাদের জানা ছিলোনা বাবা সেদিন বেতন দিতে স্যারের বাসায় গিয়েছিলেন। স্যার টাকা ফেরত পাঠানোর পর আমরা জানতে পারি। বাবা ভুলে গিয়েছিলেন।  
 
স্কুল জীবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হলে কিছুটা যেনো স্বাধীনতা পেলাম পারিবারিক শাসন থেকে। কলেজে ভর্তি হবার পর যখন টিউশানি করার কথা বললাম, বাবা ক্ষেপে গেলেন খুব। সোজা বারণ করে দিলেন, এসব করা যাবেনা। ‘পড়াশুনা কর। সময় নষ্ট করোনা। টিউশানি করলে মেজাজ ঠিক থাকবেনা, নিজের পড়াশুনার ক্ষতি হবে’। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো বিরক্ত ছিলেন এই টিউশনির বিষয়ে। কিন্তু আমি শুনিনি সে কথা। বাবাকে জানানো হয়নি কিন্তু যেহেতু বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি তাই দেখার নেই কেউ। টিউশানি করতাম। গল্প বই কিনতাম, বিশেষত সেবা প্রকাশনীর বই, কিশোর ম্যাগাজিন, ক্রীড়ালোক, যায়যায় দিন এগুলো কিনতাম। মাস শেষে আবিষ্কার করলাম বাবা অন্য মাসের চেয়ে টাকা বেশি পাঠিয়েছেন। ভুল করলো? না। মা’কে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো টিউশনের কথা বলাতে বাবা ভেবেছে পাঠানো টাকায় ছেলের চলতে কষ্ট হচ্ছে, তাই বাড়িয়ে দিয়েছেন সাধ্যের মধ্যে। এই হচ্ছে আমাদের বাবা। গ্রামের একজন সামান্য স্কুল শিক্ষক। যিনি সাধারণত জুতো পড়তে চাইতেন না, সাদা সার্ট-প্যান্টের বাইরে রঙ্গিন কোন পোশাক আমরা কখনো তাকে পড়তে দেখিনি। বিলাসিতার কথা দূরে থাক, নিজের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু ছেঁটে ফেলেছেন ছেলেদের কথা ভেবে। একফোঁটা জমি কেনেননি, একটাকা সঞ্চয়ও করেননি ভবিষ্যৎ ভেবে। শুধু চেয়েছেন ছেলেগুলো পড়াশুনা করুক, আরামে থাকুক। সংসার চালাতে গিয়ে যিনি সিগারেট ছেড়েছেন, চা খাননি কখনো।
 
আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালীন সময়ে বাবা রিটায়ারমেন্টে চলে গিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষা বিভাবে ঘুষ দিয়ে অতি দ্রুত পেনশন এনক্যাশমেন্ট করে নেন। জমা রাখেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চয়পত্রে। সেই সুদ থেকে আমাদের সংসার চলেছে আমরা চাকুরীতে ঢুকার আগ পর্যন্ত। আমরা পেশাজীবনে ঢুকার পর বাবা হাত দিলেন বাড়ির কাজে।    

বাবা কখনো শহরে থাকতে চাইতোনা। গ্রামেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো বেশি। শহরে এলে দু’দিন পরেই ফিরে যাবার জন্য উথলা হয়ে উঠতো। সেই ফিরে যাওয়াটাই কাল হলো বাবার জন্য। মা ব্যস্ত ছিলো বাড়ির কাজে, বাবা পড়ে গেলেন বাথরুমে। মারাত্মক ফ্রেকচার হলো বা’ পায়ের সংযোগ স্থলে। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন সার্জারি করার। বয়স বিবেচনায় আমরা তিনজন স্পেশালিষ্ট কল করলাম। হার্ট, মেডিসিন, অর্থোপেডিক্স। অপারেশন হলো স্বাভাবিক ভাবে। বাবা বাসায় যাবেন দুদিন পর। আমি আবাসস্থলে ফিরলাম। পরের দিন দাদার ফোন- বাবা লাইফ সাপোর্টে! পড়ি মরি করে ছুটলাম আবার। ভয়ঙ্কর রকমের যন্ত্রণাদায়ক এক আর্টিফিশিয়াল সাপোর্ট এটা। মুখের ভিতরে বড় একটা পাইপ লাগানো। ইউরিনেট করার জন্য পাইপ লাগানো, শরীরের বিভিন্ন যায়গায় আরো কতো কতো তার লাগানো। সাত আটদিন সাপোর্টে থাকার পর বাবা রিকভার করেছে, রেসপন্স করছে। একসময় ফিরে এলো লাইফ সাপোর্ট থেকে। আক্রান্ত হলো নিউমোনিয়ায়। যুদ্ধ চললো আরো দশ বারো দিন। হঠাৎ একদিন আবার ডিটরয়েট করলো বাবার পজিশন। আমি তখন ঢাকায়। আবার সাপোর্টে নেয়া হলো। আমি হন্য হয়ে খুঁজে চলেছি বিমানের টিকিট। নাই। শেষ সময়ে কোন টিকিট পেলাম না। পড়ি মড়ি করে ছুটলাম বাসে। চোখের সামনে ভাসে আমি ঢাকা আসার আগে দেখে আসা আপাত সুস্থ বাবাকে। মুখের মাস্ক সরিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমন লাগছে।

-ভালো না। খুব কষ্ট। বাড়ি যাব...
এটুকু বলেই হাঁপিয়ে উঠেছিলো বাবা। কথা না বাড়িয়ে মাস্ক লাগিয়ে দিয়েছিলাম আবার। বলেছিলাম ঢাকা ফিরছি, উইক ইন্ডে আসবো। বাবা চোখ বুজে কী জানি বিড়বিড় করলেন। আমি ফিরে আসলাম আইসিইউ থেকে। আর আইসিইউতে যাওয়া লাগেনি আমার। বাবার ভয়ঙ্কর কষ্টের মুহূর্ত আমি দেখিনি, আমাকে দেখতে হয়নি। আমি দেখেছি বাবার 'শেষ ইচ্ছে পূরণ' হতে। বাড়ি ফিরতে। শান্ত দেহে বাড়ি ফিরতে। সুঠাম দেহের বাবাকে জীর্ণ-শীর্ণ ভাবে বাড়ির উঠোনে শান্ত ভাবে শুয়ে থাকতে। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ বাবা শেষবার বাড়ি ফিরেছেন। 


আপনার মন্তব্য

আলোচিত