নুরেআলম মিনা

১৮ জুলাই, ২০১৬ ১৮:৪৮

সিলেট সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত

(সিলেটের পুলিশ সুপার হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন নুরেআলম মিনা। সম্প্রতি সিলেট থেকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয় তাঁকে। সিলেট থেকে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি সিলেটে তাঁর দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণণা করে একটি লেখা পাঠিয়েছেন। সিলেটটুডের পাঠকদের জন্য লেখাটি হুবহু প্রকাশ করা হল।)

'সুনামগঞ্জ জেলা হতে বদলি হয়ে ২৮ এপ্রিল ২০১৩খ্রি: সিলেট জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করি। সিলেটের সাথে আমার পারিবারিক বন্ধন অনেক দিনের। আমার প্রয়াত দাদা শ্বশুর আহম্মদ মিয়া বৃহত্তর সিলেট জেলার অনেক থানার অফিসার ইনচার্জ ছিলেন। আমার পরলোকগত শ্বশুর সাবেক পুলিশ সুপার এটিএম তারেক সিলেট জেলায় চাকুরী করেছেন। সিলেট শহরে আমার দাদা শ্বশুরের বাড়ী ছিল। তিনি পরে সিলেটের বাড়ী বিক্রি করে শ্রীমঙ্গলে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সে সুবাদে শ্রীমঙ্গল আমার শশুর বাড়ী। আমার চাচা শশুরগণ শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারের সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সিলেট জেলায় আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব রয়েছেন।

কুলাউড়া ও মৌলভীবাজারের সার্কেল এএসপি এবং সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার থাকার সুযোগে সরকারী কাজে ইতোপূর্বে বহুবার সিলেটে এসেছি। কিন্তু এবারের আসাটা দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছরের। এ সময়ে নিকট থেকে গভীর ও নিবিড়ভাবে সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা ও উপভোগ করার সুযোগ আমার হয়েছে। পুণ্যভূমি সিলেট বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এবং বহমান সুরমা ও কুশিয়ারা বিধৌত দুটি কুড়ি একটি পাতার দেশ সিলেট বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত। জৈন্তিয়া পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য, জাফলং এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য ও ভোলাগঞ্জের সারিসারি পাথরের স্তুপে মুগ্ধ হয়েছি। প্রকৃতি তার আপন মনে সিলেটকে সাজিয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এখানে রয়েছে মনুষ্য সৃষ্টি স্থাপনা। এখানে ঘুমিয়ে আছেন হযরত শাহজালাল (র:) ও হযরত শাহপরান (র:)সহ ৩৬০ জন অলি আউলিয়া।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের আসাম, মেঘালয় ও খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় ঘেঁষা অসংখ্য হাওর, সবুজে ঘেরা পাহাড় ও চা বাগান, মৎস্য, বালু, পাথরসহ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বিশ্ব ঐতিহ্যমন্ডিত নিসর্গ ও পর্যটন সম্ভাবনাময় সীমান্ত জেলা। হযরত শাহজালাল (র:) ও হযরত শাহপরান (র:) মাজার, শ্রীশ্রী দুর্গা বাড়ী মন্দির ও ইকো পার্ক, জাফলং, পাংতুমাই, রাতারগুল, মালনী ছড়া চা বাগান, লালাখাল, লোভাছড়া নদী ও চা বাগান, বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি, বোরাক নদীর ত্রিমোহনা, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, এমসি কলেজ ও মদন মোহন কলেজ, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর, ক্বিন ব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি, শাহী ঈদগাহ, সিলেট জেলার সৌন্দর্য ও সংস্কৃতিকে আরো মহিমান্বিত করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ অগনিত মুক্তিযোদ্ধা দেশকে স্বাধীনে অবিস্মরনীয় ভূমিকা রেখেছেন এবং অনেকে শাহাদাৎ বরণ করেছেন। অনেক প্রবাসী কৃতি সন্তান রয়েছেন যারা  প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন। বর্তমান মাননীয় অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ অনেক গুণীজনের জন্ম সিলেট জেলায়। সিলেটে কোন রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও হানাহানি নেই। সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সম্প্রীতি সিলেটের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। সিলেটের জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও বটে।

সিলেট জেলার সকল জাতি, ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে দীর্ঘকাল যাবত মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য লালন করে আসছেন। সিলেট থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাসমূহ সিলেটসহ সারাদেশের সংবাদ প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে।

আমি পুবালী ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ও স্থানীয় দানশীল ব্যক্তিবর্গ এবং সকল অফিসার ইনচাজের্র সহযোগিতায় জেলা পুলিশ লাইনসে শহীদ এসপি এম. শামসুল হক মিলনায়তন, মিলনায়তন সংলগ্ন দোতলা রেস্ট হাউজ, পুলিশ লাইনস গেটে আরপি চেক পোস্ট, পুলিশ অফিসের সামনে গোলঘর, ক্যান্টিনের পাশে সেলুন, ফোর্সের ব্যারাকের নিচে রুম, পুলিশ লাইনসে মুক্ত মঞ্চ নির্মাণ, মটরযান শাখায় গাড়ী পরিষ্কারের জন্য র‌্যাম্প, রেশন স্টোরের পাশে রেশন নিতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের বসার জন্য গোলঘর, রেশন স্টোর ও ডি স্টোরের সামনে বারান্দা নির্মাণ করেছি। জেলা পুলিশ ভবন, পুলিশ অফিস, পুরাতন হল রুম ও প্যারেড গ্রাউন্ডের স্যালুটিং ডায়াস সংস্কার করেছি। তামাবিল পুলিশ ফাঁড়ী নির্মাণ করেছি। এছাড়াও প্রতিটি থানায় উন্নয়নমুলক কাজ ও প্রতিটি থানাকে সিসিটিভি’র আওতায় এনেছি। পুলিশ লাইনসের পুকুরের উত্তর ও পশ্চিম পাশের রাস্তা প্রশস্ত ও পাকা করানো হয়েছে। পুলিশ লাইনসে পুনাকের জন্য বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করেছি যা প্রায় শেষের পথে। আরআরএফ সিলেটের জন্য গোলঘর সদৃশ বিশ্রামাগার নির্মাণ করেছি। আরোও অনেক কাজ করার প্রয়োজন এবং প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল কিন্তু সময়, সুযোগ ও সীমাবদ্ধতার কারণে করতে পারিনি। কবির ভাষায়: চলে যাব/শত অপূর্ণ বাসনার/ক্ষত চিহ্ন বুকে নিয়ে।

১৮ দলীয় জোটের প্রতিরোধের মধ্যে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ খ্রি: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪ খ্রি: উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, বিভিন্ন সময়ে পৌরসভা নির্বাচন ও এ বছরের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও কোন প্রকার দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি ও হানাহানির ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করেছি। সিলেট জেলার ডাকাতি ও সামাজিক অপরাধসহ মাদক ব্যবসা, চোরাচালান এবং জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। দায়িত্ব পালনে সিলেটের জনগণ আমাকে সহযোগিতা করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর সিলেটে দায়িত্ব পালন করায় সিলেটের মাটি ও মানুষের প্রতি আমার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যে কারণে সিলেট থেকে বদলি হওয়ায় মনে খুব ব্যথা অনুভব করছি।

সময়ের স্বল্পতার কারণে সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারিনি। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন এবং চট্টগ্রাম জেলা ভ্রমণে সকলকে আমন্ত্রণ জানাই।'

নুরেআলম মিনা : পুলিশ সুপার সিলেট

আপনার মন্তব্য

আলোচিত