শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

১২ আগস্ট, ২০১৬ ০২:২৪

সমৃদ্ধ দেশ গড়তে যুব সমাজকে প্রাধান্য দিতে হবে

আন্তর্জাতিক যুব দিবস ২০১৬

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্ন-এর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টি’র শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে তরুণ বা যুব সমাজ। আবার মধ্যপ্রাচ্যের আরব বসন্তর দিকে তাকালেও দেখা যায় মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন, তিউনিসিয়া, বাহরাইনে বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা আর স্বৈরশাসকের দু:শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তরুণরাই মূল ভূমিকা রেখেছিল। দেশে গণজাগরণ মঞ্চ প্রথম যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তাও কিন্তু করেছিল তরুণ সমাজ।

ইউএনএফপিএ’র সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বে ১০-২৪ বছর বয়সী ১৮০ কোটি মানুষ রয়েছে যা মোট জনসংখ্যার চারভাগের এক ভাগ। বাংলাদেশের ‘জাতীয়  যুব নীতিমালা’ অনুসারে আবার ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের ‘যুব’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ হিসেবে মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই যুব। তারুণ্যের এ বয়সটিকে অভিহিত করা হয় ‘যুদ্ধে যাবার সময়’ হিসেবে। একসময় ঢাল-তলোয়ার নিয়ে পরাশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল। এখনকার যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল অকল্যাণের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে আর নিজেকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখা।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় অংশীদার ও শ্রমশক্তির মূল যোগানদাতা এই যুব সম্প্রদায়। অভিবাসন ও দেশের তৈরি পোষাক খাতে যুব সমাজের একটা বড় অংশ কাজ করছে। অন্যদিকে,যারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে কাজ করছেন তাদের অবদানও কোন অংশে কম নয়। দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে তরুণদের কাছ থেকে সক্রিয় অবদান চাইলে যুববান্ধব সমাজ গঠনের দিকে গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। তরুণদের সৃজনশীল বা দেশমাতৃকার কল্যাণে নিবেদিতের যেমন উদাহরণ রয়েছে তেমনি ঐশীর মতো ভুল পথে যাওয়া তরুণ বা যুব সমাজও চোখে পড়ে। ধনী ঘরের সন্তানেরা যখন মাদক ব্যবসা বা গাড়ী চোরাচালান চক্রের সাথে যুক্ত হয়,প্রথম কাতারের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী যখন মৌলবাদ ও খুনের সাথে জড়িত হয় তখন সত্যিই উদ্বেগ দেখা দেয়।

তারুণ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু,দেশে শারীরিক অসুস্থতাকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়, মানসিকটাকে ততটা দেয়া হয় না। এক হিসেবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৬.১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব) যে কোন ধরনের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। ব্যক্তিত্বে সংঘাত, বন্ধুত্বের দ্বন্দ্ব, হতাশা, রাগ, ক্রোধ, পারিবারিক সমস্যা, হতাশা ইত্যাদি কারণে তরুণ প্রজন্ম দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। মানসিক অসুস্থতা একসময় শারীরিক অসুস্থতায় রূপ লাভ করে। পর্যাপ্ত মানসিক সুস্থ থাকার পরিবেশ না পাওয়ায় তরুণরা একসময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। মাদক ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং পারিবারিক অনুশাসন ও মানসম্মত শিক্ষার অভাবের কারণে তরুণরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।

তারুণ্যের বিকাশ ও উন্নয়নে ১৯৯৮ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অব মিনিস্টার রেসপন্সিবল ফর ইয়ুথ’ ১২ আগস্টকে ‘আন্তর্জাতিক যুব দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব করা হয়। পরের বছর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক যুব দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা পালন শুরু হয়। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন তরুণদের কর্মের মাধ্যমেই সম্ভব। তরুণদের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে নিজেদের জন্য, সমাজের জন্য ও জাতির জন্য কাজে লাগানো বিশেষ প্রয়োজন। এ জনগোষ্ঠীর কর্মস্পৃহা ও কর্ম উদ্দীপনার উপর জাতির সার্বিক উন্নতি নির্ভর করে। কিন্তু এ জন্য মানসিক সুস্থ থাকার পরিবেশ তাদের নিশ্চিত করতে হবে। তরুণ এ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য পরিবার, সমাজ তথা সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।

জেন্ডার সমতা নিশ্চিত, দুর্নীতি নির্মূল, ক্ষুধা-দারিদ্র দূরীকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, শিশু ও মানবাধিকার রক্ষা, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে অনগ্রসরমান বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিতদের মৌলিক অধিকার রক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে তরুণ সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া গণমাধ্যমে বিশেষ করে কমিউনিটি রেডিও এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যুব সম্প্রদায় সমাজ সচেতনতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

টিআইবি’র অনুপ্রেরণায় গঠিত ইয়ুথ এনগেজমেন্ট এন্ড সাপোর্ট (ইয়েস), ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটিভ সিটিজেন, বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশীপ সেন্টার, জাতিসংঘের ইউএন ভলান্টিয়ার্স এবং ইয়ুথ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, জাগো ফাউন্ডেশন, ইপসাসহ বেশকিছু সংস্থা তরুণ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে বিষয়ভিত্তিক ইতিবাচক ও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের লক্ষে সামাজিক আন্দোলনে তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহ-শিক্ষা কার্যক্রম যেমন বিতর্ক, ক্যারিয়ার ক্লাব,আবৃত্তি,নাট্য সংগঠনরাও দক্ষতা অর্জনে ভূমিকা রাখছে।

অন্যদিকে, মাদকদ্রব্য, পর্ণোগ্রাফী, বেকারত্ব, অস্ত্রবাজিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ। আবার এক শ্রেণীর যুব সমাজকে কৌশলে ধর্মের অপব্যাখ্যার দ্বারা বিপথগামী হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড সংগঠিত হচ্ছে রাজনৈতিক এবং গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের তাগিদেই। আবার, দেশের এক শ্রেণীর যুব সম্প্রদায় পাশ্চাত্যের অনুকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকাটাই এদের কাছে সব। সমাজ, দেশ-জাতি বা পরিবারের চেতনা ‘ব্যাকডেটেড’ চিন্তা বলে মনে করতে অভ্যস্ত।

এসব সমস্যা থেকে তরুণদের রক্ষা করতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোন বিকল্প নেই। এখানে পরিবার এবং রাষ্ট্র যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, ধর্ম এমনকি তরুণরা নিজেরাও। আমাদের দেশে একটি প্রকট সমস্যা হচ্ছে তরুণদের জন্য কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তাদেরকে হয়তো বিবেচনায় নেয়া হয় কিন্তু সরাসরি মতামতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। বর্তমান নীতি নির্ধারকরা একসময় তরুণ ছিলেন এমন যুক্তি এখানে খাটানো ঠিক হবে না। কারণ ২০ বছর পূর্বে বাংলাদেশের তরুণদের অবস্থা আর এখনকার প্রেক্ষাপটই এক নয়। এ সমস্যা শুধু রাষ্ট্রে নয়; সমাজে, পরিবারেও একই সমস্যার ভোগে তরুণ সমাজ।

সরকার বিশেষ করে কর্মমুখী শিক্ষার দিকে নজর দিলেও শিক্ষিত বেকারদের জন্য সরকারের পক্ষে এখনও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। মেধাবী তরুণদের মেধা পাচার বন্ধ করে পর্যাপ্ত সম্মান ও প্রণোদনার কোন বিকল্প নেই। নাহলে দেশের সম্পদ নিয়ে উন্নত দেশগুলোই গর্ব করবে। দেশ বঞ্চিত হবে। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে (রূপকল্প ২০২১) তরুণদের পর্যাপ্ত মানসম্মতভাবে শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

তরুণদের চাহিদা মাফিক উন্নয়ন কৌশল, পরিকল্পনা ও নীতিমালা জরুরী। এমন একটি জাতি আমাদের প্রত্যাশা যেখানে যুব সম্প্রদায় বেকারত্ব, মাদক, পর্ণোগ্রাফী, অস্ত্রবাজি থেকে মুক্তি  পাবে। সেই সাথে উৎপাদনমুখী বাস্তব শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, নেতৃত্বসহ সম্ভাবনাময় সকল গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মানসিক সুস্থ তরুণরা স্বপ্রণোদিত হয়ে সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে অধিক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন, বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ, সরকারি তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত, জাতীয় বাজেট প্রণয়ন ও প্রকল্প প্রণয়নে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সকল অনগ্রসরদের অধিকার নিশ্চিতের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবে। পরবর্তীতে তরুণদের কাছে ক্ষমতা অর্পিত হলেই দেশ পাবে উপযুক্ত ও কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সাংবাদিক। ইমেইল : [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত