একুশ তাপাদার

১৩ আগস্ট, ২০১৬ ০১:৪১

অসামান্য কিছু স্মৃতি আর তারেক মাসুদ

এক সময় সিনেমার পোকা ঢুকেছিল মাথায়। দেশি-বিদেশি প্রচুর স্বাধীনধারার চলচ্চিত্র দেখে কিছু একটা করে ফেলব এমন হাবভাব ছিল ঘুরতাম। জীবনে অনেক কিছুর মত এই ইচ্ছাও পূর্ণতা পায়নি। তবে ওই ইচ্ছার নড়াচড়ায় কিছু গুণী মানুষের সংস্পর্শ অল্প সময়ের জন্য হলেও পেয়েছি। নিঃসন্দেহে তারমধ্যে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ সবচেয়ে বড় আসনে থাকবেন।

'অন্তর্যাত্রা' সিনেমাটা মুক্তি পাওয়ার পর ২০০৭ সালের শুরুর দিকে প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। শাবির চোখ ফিল্ম সোসাইটির তৎকালীন সভাপতি জন সিসিল মণ্ডলের কাছ থেকে তারেক ভাইয়ের নাম্বার নিয়ে তাঁকে ফোন করে সিনেমাটা সিলেটে প্রদর্শনীর প্রস্তাব করি। তারেক ভাই সম্ভবত সেদিন এরকম একটা প্রস্তাবেরই অপেক্ষা করছিলেন। প্রথম দিনেই দীর্ঘ আলাপে হল বুকিং করে ফেলতে বলেন তিনি। চূড়ান্ত হয় অন্তর্যাত্রা সিলেটে প্রদর্শিত হবে ৮ দিন ব্যাপী। আয়োজন করবে প্রথমআলো বন্ধুসভা, সিলেট। আমি সেই সংগঠনের হয়েই তারেক মাসুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বে ছিলাম। পরে প্রান্তিক পর্ষদ নামে আরেকটা সংগঠন নিয়েও তাঁর সঙ্গে কাজ করা হয়েছে।




তারেক মাসুদ প্রদর্শনীর ২/৩ দিন আগেই সিলেট চলে আসেন। সপ্তাহখানেক আগেই অবশ্য তাঁর ভাই নাহিদ মাসুদকে পাঠিয়ে সমস্ত কিছু রেকি করে নিয়েছিলেন। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি সিনেমা প্রদর্শন ও  বিপণনের সমস্ত কাজ তিনি একাই করতে পারতেন। কেবল সিনেমা বানানোই যে পরিচালকের কাজ নয় তাঁর তৎপরতা দেখেই বুঝেছিলাম।  সিলেটে অন্তর্যাত্রার ৮ দিনে ১৬ টা প্রদর্শনী হবে সেজন্য বসার সিট থেকে শুরু করে স্ক্রিন তৈরি, সাউন্ড কোন কিছুতেই কোন খামতি রাখতে চাইতেন না। প্রদর্শনীর ঠিক আগের দিন কাজী নজরুল অডিটোরিয়ামের  (তখনকার এম সাইফুর রহমান মিলনায়তন) স্ক্রিনের সাদা রঙ কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলে তারেক ভাই রঙ আনিয়ে নিজ হাতে রঙ করতে শুরু করেন। সব কাজে নিজেই নেমে পড়ায় ইউনিটের লোকেরা আর বসে থাকার সুযোগ পেত না।

যেহেতু প্রদর্শনীর দায়িত্বে ছিলাম আমরা কাজেই প্রচার প্রচারণার সব দায়িত্বও ছিল আমাদের উপর। কিন্তু তারেক মাসুদ নিজেও নেমে পড়েন প্রচারণায়। শহরে প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসে হাজির হয়ে তিনি বলতে লাগলেন, "আমার নাম তারেক মাসুদ, আমি একটা চলচ্চিত্র, সিনেমা, ফিল্ম বা মুভি তোমরা যে নামেই ডাক সেরকম কিছু একটা তৈরি করেছি। এই চলচ্চিত্রের এই প্রেক্ষাপট... অমুক দিন অমুক জায়গায় এটা দেখানো হবে, আমি চাই সবাই এসে এটা দেখবে।" এই কাজ বাংলাদেশের আর কোন চলচ্চিত্র পরিচালক করতে পারেন কিনা আমার জানা নেই। তারেক মাসুদের এই প্রচারণার  ফলে সেসময় সিলেট শহর জুড়ে তাঁর সিনেমা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। এতে অবশ্য কিছুটা বিপাকের জায়গায়ও ছিল। কারণ রাজনৈতিকভাবে তখন জামায়াতে ইসলামী বেশ শক্তিশালী,  "মুক্তির গান" আর "মাটির ময়না" চলচ্চিত্রের জন্য তারেক মাসুদ তাদের কাছে বরাবরই নিষিদ্ধ এক নাম । হঠাৎ করেই তাই সিলেটজুড়ে তারেক মাসুদের বিচরণ তাদের কাছে বেশ কিছুটা অস্বস্তির কারণ ছিল। এসব কারণেও তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হচ্ছিল।

তবে প্রদর্শনী শুরুর পর প্রতিটি শোতেই বিপুল দর্শকের সমাগম ঘটে। অনেককেই একাধিকবার সিনেমাটা দেখতে দেখেছি। প্রদর্শনের সার্বিক মান ও তারেক মাসুদের অসাধারণ অ্যাপ্রোচ এর বড় কারণ ছিল।

পরবর্তীতে ২০১০ সালে  রানওয়ে সিনেমা মুক্তির পর ফের যোগাযোগ হয় আমাদের। প্রান্তিক পর্ষদ সিলেটে শর্টফিল্ম "নরসুন্দর" ও "রানওয়ে" সিনেমা প্রদর্শনীরও আয়োজন করে। সেবার তিনি সিলেট এসে স্ক্রিপ্ট  রাইটিং এর উপর একটা কর্মশালাও করেছিলেন। তাঁর সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে অনেক কিছুই শেয়ার করেছিলেন। ওটাই তাঁর শেষবারের সিলেট আসা হয়ে রইল। শেষটা খুব সুন্দর না হওয়ার আক্ষেপ আমাকে পোড়াবে আজীবন।

"রানওয়ে" সিনেমার প্রেক্ষাপট ছিল জঙ্গিবাদ যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক। মিশুক মুনিরের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফির কারণেও চলচ্চিত্রটি ভীষণ প্রশংসিত হয়। জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক শেকড় কোথায়, বিএনপি-জামায়াতের সময় কীভাবে কোন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এটি ফুলে-ফেঁপে উঠল তাঁর ইঙ্গিত ছিল "রানওয়েতে"। ধর্মীয় জঙ্গিবাদের কদর্য জগত থেকে তরুণের ফিরে আসার দৃশ্য দেখিয়ে আশাবাদের জয়গানও শোনাতে চেয়েছেন তারেক মাসুদ। নরসুন্দর শর্টফিল্মে  যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুজাহিদের কর্মকাণ্ডের তথ্য তোলে ধরায় সেসময় তৈরি হতে যাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আরও উৎসাহ পেয়েছিল। একবার আলাপে সেটাও বলেও ছিলেন।

চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা তারেক মাসুদকে মতাদর্শগতভাবে গভীর একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছিল বলে আমার ধারনা। তারেক মাসুদ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তাঁর সেই পারসেপশন তোলে ধরতে চেষ্টা করতেন। তাঁর মধ্যে চিরায়ত বাংলার সমন্বয়বাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল। ২০১৩ সালের ঐতিহাসিক শাহবাগ গণজাগরণ ও এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তথা ব্লগার খুন, ধর্মীয় উগ্র পরিবেশ, জঙ্গিবাদের নব উত্থানের সময়ে তারেক মাসুদের বেঁচে থাকা অনেক দরকার ছিল। তিনি এই সময়টাকে ফ্রেমে বন্দি করে সংকটের কারণ অনুসন্ধানে উদ্যোগী হতে পারার মত সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তাঁর বছর দুয়েক আগেই নির্মম সড়ক দুর্ঘটনায় তাকে হারাতে হয় আমাদের।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ছিল রমজান মাস। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে টিভির পর্দায় তারেক মাসুদের মৃত্যু সংবাদ আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের ভঙুর চলচ্চিত্রকেও স্তব্ধ, স্থবির করে দিয়েছিল নিঃসন্দেহে। তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনির আজকের চলমান সংকটের শেকড় কোথায় তা জানতেন। কীভাবে, কোন উপায়ে আমাদের সহনশীল জীবনধারা অসহনশীলতায় বিষাক্ত হয়ে গেল এর কারণ উপলব্ধি করে উত্তরণের উপায় খোঁজবার মত সবচেয়ে যোগ্যতার ব্যক্তি ছিলেন এই দুজন।

২০০৭ সাল থেকেই দেশভাগ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। একটা সিনেমা তৈরি করতে যে অনেক পড়াশোনা,অনেক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের দরকার হয় তা হয়ত সাধারণ দর্শকের বোঝবার কথা নয়। ২০০৭ সালের চিন্তা ২০১১ সালে এসে আলোর মুখ দেখার পথ তৈরি হতেই নিভে গেল সব আলো।  "কাগজের ফুল" নামক সেই চলচ্চিত্রের লোকেশন দেখার কাজে যাওয়ার পথেই হারিয়ে গেলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অক্সিজেন! আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে কেবল একটা কথাই বলবার আছে, তারেক মাসুদ আপনি নমস্য!


আপনার মন্তব্য

আলোচিত