শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

১৮ আগস্ট, ২০১৬ ১৭:২৮

সেলিম আল দীন : শেকড়সন্ধানী নাট্যসংস্কৃতির মুকুটহীন রাজা

আবহমান বাংলা ভাষার ঐতিহ্যসঞ্চারী নাট্যগগনের এক মুকুটহীন রাজা। ছিলেন হাজার বছরের বাঙালী নাট্যসংস্কৃতির এক অনুসন্ধানী দ্রষ্টা। দূরযানী এই অনিশ্চিত, অন্ধকার ও রহস্যময় বন্ধুর সড়কে প্রায় একা একাই আÍপরীক্ষায় মগ্ন থেকেছিলেন সারা জীবন। সৃজনশীলতার কুঁড়ি ঝরিয়ে, বীজ ছড়িয়ে, মরাপাতার মতো প্রচলিত মরা ভাবনাগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রক্তিম বেদনার মতো ফল ফলিয়েছেন। সমস্ত বিপর্যস্ত ও অনিশ্চয়তাকে আস্তিনে গুটিয়ে রেখে অজানার উদ্দেশে কাঙ্ক্ষিত শিখরে পৌঁছানোর প্রেরণায় অভিযাত্রী হয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন আমৃত্যু।

নাটক থেকে শুরু করে সঙ্গীত, পালা, বহুবিধ অভিনয়রীতি নিয়ে তার ভাবনা ছিলো সবসময় শেকড়সন্ধানী। সম্ভবত এ কারণেই, তিনি ভিন্ন ভাবনার অপূর্ব এক কারিগর। একের পর এক নাট্যসৃজনে তিনি বাংলা নাটকের নতুন বাঁক সৃষ্টি করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা নাটকের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা সেলিম আল দীন।

বাংলা নাট্যজগতে তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ শেরপা। তার আগে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া এই দুর্গম ও অনিশ্চিত নাট্যভুবনের কথা আর কেউ এভাবে ভেবেছেন কী না, সন্দেহ জাগে।

সেলিম আল দীন বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য বিরলপ্রজ নাম। তিনি শুধুমাত্র নাট্যকার নন, ছিলেন একজন নাট্য গবেষকও। তার গবেষণাগ্রন্থ ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্য’ এর এক বিশাল পরিধি জুড়ে তিনি প্রাগাধুনিক বিভিন্ন লোকজ নাট্যরীতি সম্পর্কে অনুসন্ধানে তৎপর ছিলেন। ঐ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, বাংলা থিয়েটার বা নাটকের সূত্রপাত ১৮ বা ১৯ শতকে ঘটেছিল, এই দাবি তিনি মানেন না। হাজার বছরের প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ক্রম ধারায় নাট্যচর্চা বহমান ছিলো। এই নাট্যরীতি ক্রম বিবর্তনের পথ ধরে এগিয়েছিলো। এতে শুধু যে নাট্যরীতির পরিবর্তন ঘটেছিল তা নয়, বরং তা ভাষারও সংস্কার সাধন করেছিল।

বাংলা নাটককে যিনি প্রচলিত ধারা থেকে বের করে এনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে নবরূপে ও ভিন্নমাত্রায় প্রাণবন্ত করেছিলেন তিনি সেলিম আল দীন। তার অভিসন্দর্ভ ‘মধ্যযুগের বাঙলানাট্য’ পাঠ করলে নাটক সম্বন্ধে চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে যায়।

পাঁচালীরীতিতে লেখা তার নাটক বাংলায় নতুন না হলেও উপস্থাপন রীতি প্রসেনিয়াম নাটকে প্রথম। তার কোন নাটকের মঞ্চ কেমন হবে তা আগে কখনোই বোঝা যেত না। এই প্রথা ভাঙ্গতে তাকে বহু বাধা অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। নীরিক্ষাধর্মী কাজের ক্ষেত্রে আলোচনা কিংবা সমালোচনা থাকে, তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। প্রজ্ঞা, চিন্তার প্রাগ্রসরতা তাকে সেই পথ পেড়িয়ে আসতে সাহায্য করেছে। তাছাড়া নাটক ছাড়া ভিন্ন কোন চিন্তা না থাকার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

প্রথা ভাঙার এ সাহস ও যোগ্যতা সেলিম আল দীন অর্জন করেছিলেন। মান্দি সম্প্রদায় তার ‘বনপাংশুল’ নাটকের উপজীব্য। নাটকের অনেক বক্তব্য এখনও অনেকের কানে অনুরণিত হয়।

‘চাকা’ তারই আরেকটি সৃষ্টি। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘মানুষের কোন আলাদা পরিচয় ও ঠিকানা নেই। এই পরিচয় ও ঠিকানা না থাকলে তার জাতও থাকে না’। ‘চাকা’র শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি- যখন মৃত মানুষটার ঠিকানা পাওয়া গেল না তখন তাকে মাটি ফেটে তৈরি হওয়া গর্তে ফেলে দেয়া হয়। সেলিম আল দীনের প্রাতস্বিকতা এখানেই।

আচার্য সেলিম আল দীন তার ‘নিমজ্জন’ নাট্যের হৃদয়নিঃসৃত পঙক্তির মাধ্যমে এক আশ্চর্য অভিনব কাব্যিক অভিজ্ঞতায় পৃথিবীর গণহত্যার ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন। প্রাচীন থেকে মধ্যযুগ ও আধুনিক কালে বিশ্বে ঘটে যাওয়া গণহত্যার লোমহর্ষক বয়ান তার ‘নিমজ্জন’ নাটক। এ নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

সেলিম আল দীনের দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রকৃত ব্যাখ্যায় দেখা যায়, গ্রিক রিচুয়াল থেকে যদি গ্রিক ট্র্যাজেডির জন্ম হতে পারে। সেটি  নিয়ে উত্তরকালে শিল্পতত্ত্ব রচিত হয়। তবে প্রাচ্যেও ধর্মতত্ত্ব থেকে কেন শিল্পতত্ত্ব অনুসৃত হবে না বা হতে বাধা কোথায়? তুরস্ক, ইরাক, ইরানের সুফি তত্ত্বের ধারায় বাংলায় চৈতন্যদেব ‘অচিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ নামে যে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের প্রচলন করেন, তাকেই আধুনিক কালের করে তোলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘বস্তুতপক্ষে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের আবিষ্কারের পরে বা ওই শিল্পতত্ত্বের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মানোর ফলে আমি চলতি অর্থে নাটক লিখি না। আমার লেখাগুলো ঐতিহ্যবাহী বাংলা পাঁচালি ও কথকতার ধারায় সমকালীন প্রয়াস।’

সেলিম আল দীন দ্বৈতাদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী হলেও পরে তিনি নিজস্ব এক নাট্যরীতির উদ্ভাবন করেন যার নাম ‘ফোররিয়ালিজম’। এই দর্শনের মধ্য দর্শনের এক সার্থক নান্দনিক রূপ এ-নাটক। পাশ্চাত্য সভ্যতা, সাম্রাজ্যবাদের হাতের গুটিতে যেমন উঠে আসছে আণবিক অন্ধকার। সভ্যতার মধ্য দিয়ে মানুষের এই বিনাশী আয়োজনের অশুভ যান্ত্রিক বুদ্ধিতে সৃষ্ট দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভাবিত সর্বনাশের ইঙ্গিত রয়েছে এ নাটকে।

তথাকথিত সভ্যতা কীভাবে গণহত্যার মাধ্যমে বিশ্বকে অনিশ্চিত ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে, তার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে এ নাটক। এ নাটকের মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, যাদের যতো গণহত্যা করার শক্তি বেশি তারা সবচেয়ে বেশি সভ্য। এই অসভ্যতাকে সভ্য বলে যারা বিশ্বে ডামাডোল পেটাচ্ছে আর হত্যা-খুন করে বেড়াচ্ছে।

‘নিমজ্জন’-এ বিবৃত হয়েছে বিশ্বে গণহত্যার চিত্র। বাংলা ভাষায় এ সম্পর্কিত এই মাত্রার রচনা দ্বিতীয়টি আছে বলে আমাদের জানা নেই। অর্থাৎ এটি একটি অদ্বিতীয় নাটক। এ নাট্যরীতিতে দ্বৈতাদ্বৈতবাদের সমর্থক সেলিম আল দীন একটি নতুন শিল্পপরিভাষা কিংবা শিল্পতত্ত্ব যুক্ত করেছিলেন, যা ফোররিয়ালিজম বা ‘সম্মুখ বাস্তববাদ’ নামে পরিচিত। তার উপখ্যানধর্মী নাটক ‘স্বর্ণবোয়াল’। এ নাটকের প্রধান চরিত্র খলিশা মাঝি হলেও নাটকটিতে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’ উপন্যাসের ছায়া বিম্বিত হয়।

তখন সান্তিয়াগোকে মনে হয় খলিশা মাঝি। আর এর মধ্য দিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যে সম্মিলন লক্ষ্য করা যায় তা সেলিম আল দীনের নাটকের চিরায়ত ফর্ম ভাঙ্গার ঢং হলেও বিষয়টি অন্যান্য নাটকের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

গদ্য-পদ্যের বিভাজন স্বীকার করতেন না সেলিম আল দীন। নিজের রচনাকে দাবি করতেন ‘ননজেনরিক’ বলে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমি সব সময় চেয়েছি আমার লেখা নাটকগুলো নাটকের বন্ধন ভেঙে অন্যসব শিল্পতীর্থগামী হোক। কারণ শিল্পে আমি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী।’

প্রজ্ঞা, মেধা, মনন ও দক্ষতায় যে ক’জন নিরলস সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের সহজিয়া লোকজ বাংলার উর্বর সংস্কৃতিকে বহুমাত্রায় বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন নাট্যকার সেলিম আল দীন ছিলেন তাদের ভেতর অন্যতম। বাংলার হাজার বছরের পুরনো লোকজ উপাদান ব্যবহার করে এই পোড় খাওয়া, চির সংগ্রামী, সরল, স্বাধীনচেতা, আত্মনির্ভর, নির্ভীক, সাহসী মানুষদের জীবনকাব্যের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি অত্যন্ত সাবলীলভাবে সেলিম আল দীন তার প্রতিটি নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। চরিত্রের এই যুক্তিসংগত গ্রহণযোগ্যতার কারণেই নাটক তখন শুধুই নিছক মঞ্চের ভাষা হয়ে থাকেনি, তার নাটকের প্রতিটি সংলাপ জীবন সংগ্রামের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত।

এরিস্টটল নাটক সম্পর্কে বলেছিলেন, মানুষের জীবনের সাথে প্রকৃতি জড়িয়ে রয়েছে। আর সে কারণেই মানুষ প্রকৃতসৃষ্ট এক উন্নত মননপুষ্ট প্রাণী। তার জীবনের অপার চাহিদা হলো সমাজ বদল করা। মরা-চেপড়া সমাজ তার কখনোই পছন্দ নয়। সমাজ বদলের জন্য মননশীলেরাও বেছে নেয় যেসব সাংস্কৃতিক মাধ্যম, নাটক তার মধ্যে অন্যতম।

জীবনের অপার চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা-ভালোবাসার অণু-পরমাণুর বাস্তব-অবাস্তব প্রতিফলন হলো নাটক। আর সে কারণেই জীবনের দিনলিপির আয়নায় এই নাটকের প্রতিটি চরিত্র আমাদের সামনে ধরা দেয় বহুরূপী হয়ে। আমরা যারা সমাজবদ্ধ জীব এবং আমাদের তৈরি এই সমাজকে আঁকড়ে ধরেই যখন আমাদের বাঁচা-মরার হিসেব-নিকেশ তখন আমরা জড়িয়ে পড়ি প্রতিদিনের জীবনের সাথে এক অস্তিত্বের লড়াইয়ে। এ লড়াই কি শ্রেণী সংগ্রাম?

যদি শ্রেণী সংগ্রাম নাও হয়, তবুও সংস্কৃতির বিকাশমান মাধ্যমের কারণে নাটক সবার অজান্তেই শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠবে- এর কোন বিকল্প নেই। কারণ শ্রেণীকে বদলাতে হলে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিকল্প নেই। এ যেন এক বিকল্পহীন লড়াই। আর সে কারণেই সেলিম আল দীন ধীরে ধীরে জায়গা করে নেন বাংলার প্রতিটি আঁকা-বাঁকা প্রান্তরে, নোনা জল হয়ে হাঁটে-মাঠে-ঘাটে, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মানুষের হৃদয়ের গহীনে।

নাট্যাঙ্গণে যারা জীবন ঘষে আগুন জ্বালায় সেলিম আল দীন তাদের মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদা। নাট্যজগতে তিনি যে আলোর মশালের প্রজ্বলন ঘটিয়ে ছিলেন তা জ্বলবে যুগের পর যুগ। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পৌঁছে গেছে নাটক। এসব স্বপ্ন দেখেই তিনি দীপ্র আলোকদ্যুতি জ্বেলেছিলেন।

আজ ১৮ আগস্ট। আবহমান বাংলানাট্যের প্রবাদপ্রতিম দ্রষ্টা সেলিম আল দীন-এর জন্মদিন। ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার অন্তর্গত সোনাগাজী থানার সেনের খালি গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন তিনি। নাট্যাচার্যের জন্মদিনে আমাদের গভীর প্রণতি।।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সাংবাদিক। ইমেইল : [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত