এম ফাওজুল কবির খান

০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:৫৮

আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধের অভাব, সাইফুর রহমান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ

(২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এম সাইফুর রহমান। আজ তাঁর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী।)

আমরা জাতি হিসেবে স্মৃতিভ্রষ্ট। আমরা কখনো ভুলে যাই রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কারণে, আবার কখনো কৃতজ্ঞতাবোধের অভাবে। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বর্তমান স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধে আমি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে আমার ব্যক্তিগতভাবে জানা তার কয়েকটি অবদান উল্লেখ করব এবং তাকে সম্মাননা জানানোর বিষয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করব।

নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে আমরা চারজন যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ফিরে আসি। তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ছিলেন নুরুল হোসেইন খান। তিনি বিদ্যোত্সাহী ব্যক্তি ছিলেন। সে সময় আমরা কনিষ্ঠ পদের কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাদের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআরের নীতিনির্ধারণ সভায় নিয়ে যেতেন। সাধারণত কমিশনার ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের এ ধরনের সভায় যোগদানের কথা। আমরা কেউই তখনো কমিশনার হইনি। পরবর্তীতে শাহ আব্দুল হান্নান এনবিআরের চেয়ারম্যান হলে তিনিও এ ধারা অব্যাহত রাখেন।

অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের প্রথম বৈঠকের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর বলা যাবে না। তিনি আমাদের সামনে সিনিয়র কর্মকর্তাদের বকাঝকা করলেন, যা আমার ভালো লাগেনি। আবার যখন এনবিআরের চেয়ারম্যান আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, তখন তিনি চশমার উপর দিয়ে খানিকটা তাকালেন। আমার মনে হলো, তিনি আমাদের অবজ্ঞাই করলেন। দ্বিতীয় বৈঠকে যাওয়ার আগে আমরা চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছে আবদার করলাম— আমরা অনেক জুনিয়র, আমাদের না নিলে হয় না? আমরা নথিপত্র ঠিকই তৈরি করে দেব। চেয়ারম্যান মহোদয় আমাদের বললেন, মিনিস্টার সাহেব বকাবকি করলেও লোক ভালো। তাছাড়া অভ্যাস হয়ে যাবে!

উল্লেখ্য, এম সাইফুর রহমান ও নুরুল হোসাইন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলেন। দ্বিতীয় বৈঠকে আমাদের ভুল ধারণা ভেঙে গেল। তিনি আমাদের লক্ষ করে বললেন, কী ব্যাপার তোমরা তো কিছুই বলছ না? অর্থাৎ তিনি আমাদের উপস্থিতি ঠিকই খেয়াল করেছেন। আমরা কিছুটা ভয়ও পেলাম।

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল বলা যায় বদ্ধ অর্থনীতি (closed economy)। সর্বোচ্চ শুল্কহার ছিল ৩৫০ শতাংশ; নির্দিষ্ট ও মূল্যভিত্তিক মোট শুল্কহারের সংখ্যাও ছিল ২৭। আমদানি ও রফতানি ছিল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। আবগারি শুল্ক ব্যবস্থায় করের ওপর কর আদায় হতো। আবগারি কর প্রদানকারী প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। আয়কর ব্যবস্থাও ছিল পশ্চাত্পদ। ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রান্তিক আয়করের হার ছিল ৫৫ শতাংশ। ছয় স্তরের করহার প্রচলিত ছিল। এ সত্ত্বেও কর ও জিডিপির অনুপাত ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। সার্বিকভাবে শুল্ক ও কর ব্যবস্থা অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছিল।

এম সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শুল্ক ও কর ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলা হয়। উচ্চ শুল্কহার হ্রাস, নির্দিষ্ট শুল্কহারের পরিবর্তে মূল্যভিত্তিক শুল্কহার প্রবর্তন এবং শুল্কহারের সংখ্যা হ্রাস করা হয়। আমদানি নীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। বেশির ভাগ পণ্য আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। স্বল্পসংখ্যক পণ্যের একটি নেতিবাচক তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যা আমদানি করতে ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে। আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকা সংকুচিত করা হয়। আবগারি করের পরিবর্তে মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তন করা হয়। আয়করের উচ্চ প্রান্তিক হার হ্রাস করা হয় এবং করহারের সংখ্যাও কমানো হয়। ফলে সার্বিকভাবে বাণিজ্যনীতি উদারীকরণ এবং কর ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার সাধিত হয়। ফলে কর ও জিডিপির অনুপাত বাড়ে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পায়।

এ কথা ঠিক যে, উল্লিখিত সংস্কার কর্মসূচির বেশ কয়েকটি আইএমএফ-এর Extended Structural Adjustment Facility (ESAF), Industrial Sector Adjustment Credit-II(ISAC-II) এবং Public Resource Management Adjustment Credit (PRMAC)-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। আসলেই তখন বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য পরিস্থিতি ছিল নাজুক। তাই এ ধরনের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য সহায়তা ছাড়া সরকারের গত্যন্তর ছিল না। এজন্য অনেকই তখন অভিযোগ করেছিলেন যে, তিনি দাতা সংস্থার ক্রীড়নক ছিলেন। আসলে ব্যাপারটা তেমন নয়। নিচের কয়েকটি উদাহরণ তা স্পষ্ট করে দেবে আশা করি।

এম সাইফুর রহমানের সভাপতিত্বে বিশ্বব্যাংকের সংস্কার কর্মসূচি সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একদিন আলোচনা হচ্ছিল। এনবিআর থেকে উচ্চ করহার ও কর বন্ধনির সংখ্যা হ্রাস এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাণিজ্যনীতি উদারীকরণ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয়। ফলে সভায় বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবগুলো গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সভার পর ড. মসিউর রহমান আমাকে তার কক্ষে ডেকে নেন। সেখানে ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রমও উপস্থিত ছিলেন। চা খেতে খেতে তারা আমাকে বললেন, কী ফাওজুল কবির, মিটিংয়ে তুমি তো কিছু বললে না? আমি বললাম, আমি চেয়ারম্যান ড. একরাম হোসেনের ফাইল বহনকারী কর্মকর্তা হিসেবে সভায় যোগ দিয়েছি। এনবিআর থেকে সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হচ্ছে। আমার তো কিছু বলার কথা নয়। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক কোনো সহায়তা না দিলেও আমাদের উচ্চ করহার হ্রাস করা উচিত। কেননা আমি নিশ্চিত যে, কেউই এ ধরনের উচ্চহারে কর দিচ্ছেন না। প্রমাণ কী? তারা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, আমাকে এক হাজার আয়কর রিটার্নের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলে আমি এটি পরীক্ষা করে দেখতে পারি। যা অনুমান করেছিলাম তা-ই। এসব উচ্চহারে ৫৫, এমনকি ৪০ শতাংশ হারেও ঢাকার কর অঞ্চলগুলোর কেউ কর দেয়নি। এক পাতায় আমার বিশ্লেষণ লিখে অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাই। এবার অর্থ সচিব নাসিম উদ্দিন আহমেদসহ সবাই মিলে অর্থমন্ত্রীর কক্ষে যাই। পা কাঁপছিল। ভয়ে ভয়ে অর্থমন্ত্রীকে বললাম। বিশ্বব্যাংক কোনো টাকা না দিলেও আমাদের সংস্কারগুলো করা উচিত বলে টাইপ করা কাগজটি তার সামনে তুলে ধরলাম। তিনি দ্রুত পড়ে বললেন— একদম ঠিক, আমি নিজেও জানি এসব— বেশি বেশি হারে কেউ ট্যাক্স দেয় না। আমরা বসে থাকতে থাকতেই তিনি ইআরডি সচিব ইনাম আহমেদ চৌধুরীকে ফোনে বললেন, বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দল ঢাকা ত্যাগ না করে থাকলে তাদের যেন আবার আলোচনায় ডাকা হয়। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক চাইলেই নয়, বরং জাতির প্রয়োজনেই সাইফুর রহমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। উল্লেখ্য, অর্থ সচিব নাসিম উদ্দিন আহমেদ ও আমি ওয়াশিংটন ডিসিতে এ-সংক্রান্ত ঋণচুক্তি আলোচনা চূড়ান্ত করি।

আরেকবার দুদিন ধরে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কর সংস্কার প্রস্তাবের রাজস্ব প্রভাব বিশ্লেষণ শেষ করে দেখলাম, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কর সংস্কার প্রস্তাব সাংঘর্ষিক। আইএমএফের শর্ত ছিল— কর ও জিডিপির অনুপাত প্রতি বছর দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। আবার বিশ্বব্যাংকের শর্ত ছিল— সর্বোচ্চ শুল্কহার ৭৫ শতাংশ করতে হবে। আমার বিশ্লেষণে দেখতে পাই যে, আইএমএফের শর্ত মানতে হলে সর্বোচ্চ শুল্কহার ১০০ শতাংশ হতে হবে। সচিবকে বিষয়টি জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় ইন্টারকমে সচিবের তলব। আমি কিছু বলার আগেই নুরুল হোসাইন খান বললেন, মিনিস্টার সাহেব এইমাত্র ফোন করেছিলেন। তার নির্দেশ হলো, সর্বোচ্চ শুল্কহার ৭৫ শতাংশ নয়, ১০০ শতাংশ হবে— এটি আমরা যেন বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দিই। আমি দুদিন ধরে গলদ্ঘর্ম হয়ে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, মন্ত্রী মহোদয় তার উপস্থিত বুদ্ধিতে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন! আমি আইএমএফের দলনেতাকে আমার বিশ্লেষণ দেখাই। তিনি আমার সঙ্গে একমত হন এবং বিশ্বব্যাংককে সর্বোচ্চ শুল্কহার ১০০ শতাংশ নির্ধারণে সম্মত করেন। শুল্কহার হ্রাসের ফলে যাতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করার বিষয়ে কড়া নির্দেশ ছিল তার।

এম সাইফুর রহমানের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করেছেন প্রবল বিরোধিতার মুখে। কায়েমি স্বার্থবাদীরা তার প্রবল বিরোধিতা করেছে। মন্ত্রিপরিষদে তার সহকর্মীরাও তার পাশে দাঁড়াননি। ভ্যাট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি তার দলের বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। এ সত্ত্বেও জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তির স্বার্থে তিনি অবিচল থেকেছেন। জাতি আজ অবধি তার দৃঢ় চরিত্রের সুফল ভোগ করছে।

লেখক: সাবেক সচিব ও অধ্যাপক

সৌজন্যে : বণিক বার্তা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত