আমিনুল হক পলাশ

০২ অক্টোবর, ২০১৬ ১৮:০৩

সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকদের দৌরাত্ম্য ও সমাধানে সম্ভাব্য করণীয়

ঢাকা শহরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে ভোগান্তির কথা আমাদের সবার কমবেশি জানা। বোধ করি ঢাকা শহরে এমন একজন মানুষও পাওয়া যাবে না যিনি প্রয়োজনের সময় অটোরিকশা খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হননি কিংবা ভাড়া নিয়ে অটোরিকশা চালকদের সাথে বাক বিতন্ডা করেননি। সিএনজিচালিত এসব অটোরিকশার ভাড়া দ্বিগুন করা হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে নূন্যতম ভাড়ার পরিমাণ। কিন্তু কিছুতেই কমছে না চালকদের দৌরাত্ন্য। মিটারে যাওয়া বাধ্যতামূলক হলেও সে নিয়মের থোরাই কেয়ার করে অটোরিকশা চালকরা।  

মন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং রাস্তায় নেমেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি ঘটাতে পারছেন না। মোবাইল কোর্ট বা প্রশাসনিকভাবে কড়াকড়ি করা হলে পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতি ঘটে, কিন্তু সার্বিকভাবে অবস্থার উন্নতির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দিনকতক পূর্বে মোঃ আবদুল্লাহ আল ইমরান নামক একজনের পোস্ট থেকে জানতে পারলাম মিটারে যেতে না চাওয়ায় জনৈক অটোরিকশা চালকের বিরুদ্ধে বিআরটিএ তে অভিযোগ করায় সেই অটোরিকশা চালক ও মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। উনাকে ধন্যবাদ যথোপুযক্ত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। এই ঘটনা জেনে সমগ্র ব্যাপারটা নিয়ে নতুন করে ভেবেছি আমি।

বাস্তবতা হলো আমরা নিজেরা যদি সচেতন না হই তাহলে শুধু মাত্র আইনশৃংখলা বাহিনী বা প্রশাসনের পক্ষে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখা কখনোই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে কখনো এই অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। মিটারে যেতে না চাইলে এর জোরালো প্রতিবাদ করিনি, কিংবা মিটারের চেয়ে বেশি ভাড়ায় অটোতে চড়েছি। বেশিরভাগ মানুষ আমার মতোই নীরবে এই অন্যায়কে মেনে নিচ্ছেন, প্রশ্রয় দিচ্ছেন যার ফলে লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে অটোরিকশার ভাড়া। আমরা প্রত্যেকে যদি প্রতিবাদ করতাম, অতিরিক্ত ভাড়ায় না চড়তাম, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতাম তাহলে অবশ্যই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতো। আমার বা আমাদের দায়টুকু স্বীকার করতেই হবে।

এটাও ঠিক যে, পরিস্থিতি বেশিরভাগ সময় হয়তো আমাদের অনূকূলে থাকে না। আমরা মোটামুটি টাইট শিডিউল নিয়ে বের হই, রাস্তায় জ্যামের কথা মাথায় রেখে কেউ অটোয় ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি করে সময় নষ্ট করতে চাই না। অটোরিকশা যে চাইলেই পাওয়া যায় ব্যাপারটা তাও না, পাওয়া গেলেও হয়তো পছন্দের গন্তব্যের বাইরে অনেক সিএনজিওয়ালা যেতে চায় না। তাই অনেকসময় পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমাদের অতিরিক্ত ভাড়ার দাবি মেনে নিতে হয়। তাছাড়া অভিযোগ করার পদ্ধতিটাও অনেকে জানেন না, এই ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক আচরণ পাওয়া যায় না। তাই উটকো কেউ আর প্রতিবাদ বা অভিযোগ করতে চায় না।

এই সমস্যা সমাধানের খুব সহজ একটা উপায় আছে। আমরা সবাই এন্ড্রয়েড ভ্যাট চেকার এপ্লিকেশনের কথা জানি।বলা যায় ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে এই এপ্লিকেশন মোটামুটি বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ভ্যাট চালান নম্বর ছিলো না এমন বহু প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নম্বর নিতে বাধ্য হয়েছে, ভ্যাটের নামে ইচ্ছামতো বিল আদায়ের ঘটনাও বন্ধ হয়েছে। এরকম একটি এন্ড্রয়েড এপের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়া সিএনজি চালকদের ব্যাপারে অভিযোগ করার পদ্ধতিটা সহজ করা যেতে পারে। বলা যায় এখন হাতে হাতেই স্মার্টফোন। তাই এমন একটা এপ যদি তৈরি করা যায় যার মাধ্যমে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করা বা কোন গন্তব্যে যেতে না চাওয়া অটোরিকশা চালকদের অবস্থান, হয়রানির বিবরণ ও সিএনজির ছবি তুলে এপের মাধ্যমে অভিযোগ করা যাবে যা সরাসরি বিআরটিএতে বা নিকটস্থ ট্রাফিক পুলিশের দপ্তরে পৌছে যাবে তাহলে খুব সহজে হয়রানির শিকার যাত্রীরা অভিযোগ করতে পারবে এবং করবেও। কিছু অভিযোগ আমলে নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে এই হয়রানি অনেকাংশেই দূর হবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রতিটা ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির এমন কার্যকর ব্যবহারই তো ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল সুর হওয়া উচিৎ।  

এর বাইরেও কিছু কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। এই লিখাটা লিখার আগে আমি প্রায় দশজন অটোরিকশা চালকের সাথে কথা বলেছি। তাদেরও বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। বেশিরভাগ সিএনজি মালিকই সরকার নির্ধারিত জমার টাকার চেয়েও বেশি টাকা নেয়। তাই অতিরিক্ত জমা আদায় করা সিএনজি মালিকদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্যাসের প্রাপ্যতার ব্যাপারটাও নিশ্চিত করা জরুরি। কেননা গ্যাস নিতে গিয়ে বেশিরভাগ অটোরিকশাকেই লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয় যাতে তাদের অনেক সময় নষ্ট হয়। আরেকটি খুবই গুরুতর অভিযোগ হলো প্রাইভেট অটোরিকশার দৌরাত্ম। আমি নিজেও ব্যাপারটি লক্ষ করেছি। প্রাইভেট অটোরিকশার সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে যেগুলোতে কোন মিটার থাকে না। যাত্রী পরিবহনের অনুমতিও তাদের নেই। কিন্তু এখন রাস্তায় নামলেই দেখা যায় সিলভার কালারের প্রাইভেট গাড়ি। দুঃখের ব্যাপার হলো রাস্টাঘাটে ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনে দিয়েই নিত্য তারা চলছে ঢাকা শহরে। তাদের বিরুদ্ধে খুব কমই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। এই প্রাইভেট অটোরিকশাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজনে তাদের লাইসেন্স দিয়ে মিটার বসাতে বাধ্য করতে হবে। এই প্রাইভেট অটোরিকশাগুলো ইচ্ছামাফিক ভাড়া আদায় করে বলেই মিটার থাকা সত্ত্বেও যাত্রী পরিবহনের জন্য নির্ধারিত সবুজ অটোরিকশাগুলো অনেকক্ষেত্রে মিটারে যেতে চায় না, তাদের যাত্রীর প্রাপ্যতাও কমে যায়।

এই ব্যাপারগুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কারী অটোরিকশা চালক ও মালিকদের বিরুদ্ধে আশু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কেননা এইসব ভোগান্তির কারনেই সরকারের অনেক অর্জন মানুষ ভুলে যায়। তাছাড়া সরকারের স্বদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবহণ সেক্টরের একটা বড় অংশ নিত্য নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাবে এটা মেনে নেয়া কস্টকর, এটা সরকারের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই ব্যাপারে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

আমিনুল হক পলাশ : সহকারী পরিচালক, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা।

এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত