রণেশ মৈত্র

২৪ অক্টোবর, ২০১৬ ১২:৫১

কমরেড অজয় রায়, লাল সালাম!

ঠিক কবে অজয় দার সাথে শেষবারের মত দেখা হয়েছিল - এখন আর তা ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে দেখা না হলেও শেষ কথা হয় ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বরের পরে দিন কয়েকের মধ্যে মোবাইলে। আমি তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়ে একটি কেবিনে ছিলাম। ঐ অবস্থায় তাঁকে কল দেই একদিন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন, পাবনা না কি ঢাকা?” বললাম,“দাদা, আমি ঢাকায়, তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ” উদ্বিগ্ন চিত্তে বললেন, “কি অসুখ? কোন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন?” বললাম,“হার্টের মাইন্ড এটাক। প্রফেসার আতিকুল ইসলাম যত্ন সহকারে চিকিৎসা করছেন। ভাল হয়ে যাব।” আবারও তাঁর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। কত নম্বর কেবিনে? সঙ্গে বৌদি আছেন তো?” বললাম, “কেবিন নং আপনাকে দেব না-কারণ আপনার অসুস্থ শরীর নিয়ে এই বয়সে আসাটা আমরা চাই না। আর আমার অবস্থারও উন্নতি ঘটছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কিছু সুবিধাও পাচ্ছি। আর হ্যাঁ, পূরবীও সঙ্গে আছেন। দিবারাত্র নিয়মিত দেখাশুনা করছেন অত্যন্ত নিবিড় ভাবে। ডাক্তার নার্সদের পরিসেবাতেও আমরা মুগ্ধ।”

অজয় দা বললেন,“যা হোক, কখন কেমন থাকেন জানাবেন কিন্তু”। বললাম“অবশ্যই”। যতদূর মনে পড়ে কমরেড অজয় রায়ের সাথে এই আমার শেষ কথোপকথন।

অজয় দার জন্ম ময়মনসিংহ জেলার অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীও তিনি নিয়েছেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন স্কুল জীবন থেকেই। এমন একাডেমিক কোয়লিফিকেশনস থাকলেও তিনি কদাপি কোন চাকুরীর দিকে পা বাড়ান নি। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। তার কাজ তো ছিল সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট পার্টিকে ঘিরে।

ছাত্র জীবনেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন অবিভক্ত ভারতের আমলে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে। তখন থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টিই করেছেন উঠেছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য পর্যন্ত। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিলম্বের বিপর্যয়ের পর তার অভিঘাতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙ্গন সৃষ্টি হয় তখন থেকে আর তিনি দলটিতে থাকেন নি কিন্তু রেখেছেন মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের অবিচল আস্থা।

এখন একটি আন্তর্জাতিক মতবাদে বিশ্ববাসী জননেতা তাঁর জীবনে বহু সমাজতান্ত্রিক দেশ একাধিকবার ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন তাঁর নিজ দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে। ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার সন্তান অজয় রায় তাঁর জীবনে কমরেড মনি সিংহ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি নগেন সরকার, সুনীল রায় এবং দেশ -বিদেশের অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতার সান্নিধ্য লাভ করেছেন এবং সাম্যবাদের নানা দিক নিয়ে আলোচনাও করেছেন সবার সাথে গভীর আগ্রহে।

একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসেবে দেশের সকল সমস্যাই তাঁকে পীড়িত করেছে বটে কিন্তু তাতে তিনি মুখ থুবড়ে পড়েন নি বরং সেগুলো তাঁর সহকর্মী সহযোদ্ধাদেরকে সাথে নিয়ে কিভাবে কার্যকরভাবে মোকাবিলার কাজে দায়িত্বশীলতার সাথে তিনি অগ্রসর হতেন দ্বিধাহীনভাবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্কসবাদের সঠিক প্রয়োগ কিভাবে সম্ভব বাংলার মাটিতে বাঙালির গ্রহণ যোগ্যভাবে সমাজতন্ত্র কোন পথে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে তা নিয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তা ও তাতে যথেষ্ট স্বকীয়তা ছিল।

দেশে কেন সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার লাভ করছে মুক্তিযুদ্ধের ও অতীতের নানা মাত্রার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় স্বত্বেও সে সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করে তা তাঁর লেখা বইতে লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ করেছেন। এক কথায় সমাজের দুষ্টক্ষতগুলিকে চিহ্নিত করেই ক্ষান্তি দিতেন না অজয় রায় সেগুলির উপযুক্ত চিকিৎসা ও নিরাময়ের পথ সন্ধানে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। কোন ধরাবাঁধা গৎ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করার পাত্র ছিলেন না অজয় রায়। তিনি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার বৈশিষ্ট্যে ছিলেন সদা-সমুজ্জ্বল।

নব্বুই-এর দশকে যখন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বিপর্যস্ত হয়ে গেল - তখনকার সেই বিপর্যস্ত মন ও চিন্তা নিয়ে অজয় দা তাঁর ভাবনাগুলি নি:শংক চিত্তে প্রকাশ করেছেন যদিও তার সাথে দ্বিমত ঘটার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। আমরা একটি গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি অনেকেই আর তা হলো মার্কসিয় গ্রন্থ সমূহে যা যে ভাষায় লিখিত আছে তার প্রতিটি অক্ষর এবং দাঁড়ি, কমা-সেমিকোলন যেন মেনে চললেই শুধু সাচ্চা কমিউনিস্ট হওয়া যাবে-এমন একটি বিশ্বাসের সাথে অন্ধভাবে ছুটে চলাই যেন যথার্থ। কিন্তু মার্কসবাদ গতানুগতিক কোন বিষয় নয়-একটি সামাজিক বিজ্ঞান এবং আজতক মার্কসবাদই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ বিজ্ঞান যা কোথাও থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে শেখায় না-তা গতিশীল। এবং সে কারণেই ঐ তত্ত্বের সৃজনশীল প্রয়োগের ফলেই আমরা আমাদের সমাজ-বিপ্লব যথার্থভাবে ঘটাতে পারি। একটি বদ্ধ-জগত তৈরি করায় এবং ভিন্নমতের প্রশ্রয় না দেওয়ার কারণ যে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ তা যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারা যাবে ততই দ্রুত আমরা আমাদের দেশে সমাজবিপ্লব ঘটাতে পারব। কিন্তু যাঁরা সব কিছু নিজেদের মধ্যে সীমিত রাখা এবং ভিন্নমতের অবাধ প্রকাশের সুযোগ না দেওয়াকে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা বলে আখ্যায়িত করতে অভ্যস্ত তাঁরা যে শুধু কেন্দ্রিকতাই বুঝতেন এবং তা তাঁদের অনুভবে আজও
আসছে না। অথচ তার ফলে সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের কাজটি বিঘ্নিত ও বিলম্বিতই হচ্ছে শুধু।

কমরেড অজয় রায় ছিলেন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এবং অসাধারণ সাহসী ব্যতিক্রমি ব্যক্তিত্ব। তিনি সংবাদপত্রে কলাম লিখতেন এবং তা শুধুমাত্র সমসাময়িক রাজনৈতিক সমস্যাবলী চিহ্নিত করে তার সমাধান কোন পথে তা প্রকাশ ও প্রচারেই নিবেদিত ছিল। তাতে স্থান পেতো জাতীয় রাজনীতির সাফল্য ব্যর্থতা আর পেতো নিপীড়িত জনগণের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা জ্ঞাপন ও তাদের সমস্যা নিয়ে সংগঠিত উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার সুস্পষ্ট উল্লেখ। আজ সেক্ষেত্রেও এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো।

যখন রুশ-চীন দ্বন্দ্বের বহি:প্রকাশ ঘটলো ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি তম কংগ্রেসের নতুন সৃজনশীল বক্তব্য অনুমোদনের পর বিশ্বব্যাপী তা রীতিমত ঝড় তুলেছিল কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যে। বাংলাদেরও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মাওজে দং এর নেতৃত্বাধীন চীন ঐ সিদ্ধান্তগুলিকে ভুল এবং পরিত্যাজ্য বলে উল্লেখ করে সারা পৃথিবীতে মাও এর নেতৃত্বাধীন উগ্রমতের ভিত্তিতে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভাজন সৃষ্টি করতে উদ্যত হলো অজয় রায় তখন ঢাকা কেন্দ্রী কারাগারে আটক থেকে গোপনে রুশ মতবাদের যথার্থতা ব্যক্ত করে তা বাইরে পাচার করতেন। ২৬ মেলে তখন আমিও আটক - তিনি আমাকে বেছে নিয়েছিলেন ঐ গোপনীয় অথচ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজে সহযোগিতা করতে। দুজন মিলে ঐ কাজ নিয়মিত পরিচালনা করে সাধ্যমত আমরা চেষ্টা করেছি পার্টিটাকে রাজনৈতিকভাবে বাঁচাবার এবং অনেকাংশেই আমরা তাতে সফলও হয়েছিলাম বলেই পার্টিটাকে তার অধিকাংশ কমরেড সহ রাজনৈতিক ভাবে বাঁচানো তখন সম্ভব হয়েছিল। সে দিনের নেতৃস্থানীয় কমরেড বা কেউই আজ আর বেঁচে নেই।

অবশেষ অজয় দাও চলে গেলেন। এক মহাশূন্যতার সৃষ্টি হলো সৃজনশীল চিন্তায় বামপন্থী আন্দোলন রচনার ক্ষেত্রে যাকে বিভ্রান্তরা অবশ্য এখনও দক্ষিণ পন্থী বিচ্যুতি বলে মনে করেন। কেউ কেউ তাঁকে “কমরেড” বলতেও চান নাÑএমনই বিভ্রান্তির কবলে পড়েছে এদেশের বামপন্থী আন্দোলন যা থেকে দ্রুত উদ্ধারের পথ এখুনি খুঁজতে হবে।

অজয় দা অবশেষে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চ গঠন তাঁর পরিপক্ব রাজনৈতিক চিন্তার একটি ইতিবাচক প্রতিফলন। তার অভাবে সংগঠনগুলি যেন ঝিমিয়ে না পড়ে।

বাংলার মাটিতেই তিনি থাকতে চেয়েছিল। সে ইচ্ছা তাঁর পরিবার ও সহকর্মীরা যথাযথভাবেই পূরণ করবেন। অজয় রায়ের - কমরেড অজয় রায়ের মৃত্যু নেই। তাঁকে দূরদেশ থেকে স্যালিউট জানাই।

  • রণেশ মৈত্র : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ। ইমেইল : [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত