রণেশ মৈত্র

০৫ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ২২:৩৫

একুশে পদক প্রাপ্তির শুভলগ্নে বিপ্লবী জননেতা বাদশা ভাই স্মরণে

আমিনুল ইসলাম বাদশা

আজ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০; টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে চোখে পড়লো বাংলাদেশ সরকার ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখার কারণে প্রয়াত জননেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। মরণোত্তর। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে এ কারণে অভিনন্দন জানাই। যদিও বাদশা ভাইয়ের একুশে পদক প্রাপ্তি অনেক আগেই কাম্য ছিল।

আমার বাল্যকাল থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত আমিনুল ইসলাম বাদশা ছিলেন আমার অন্যতম সহকর্মী-সহযোদ্ধা। এই আনন্দক্ষণে তিনি জীবিত না থাকায় তাঁর সহধর্মিণী, আমাদের প্রিয় ভাবীকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।

বাদশা ভাই আমার চেয়ে বয়সে বড়। তাঁর জন্ম তারিখ ৩০ এপ্রিল, ১৯৩০। আমার জন্ম তারিখ ৪ অক্টোবর ১৯৩৩। রাজনীতিতেও তিনি আমার সিনিয়র। তাঁর জন্ম পাবনা শহরে, আমার জন্ম গ্রামে। পাবনা শহরে স্থায়ী ভাবে চলে আসি ১৯৪৭ সালে। ভর্তি হই অষ্টম শ্রেণিতে তৎকালীন খ্যাতনামা গোপাল চন্দ্র ইন্সটিটিউশনে। তখনও বাদশা ভাইয়ের সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি।

পরিচয় ঠিকই হল,পাবনা শহরের রাজপথে। ১৯৪৮ সালের মার্চের এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে। রাজপথে ভাষা আন্দোলনের বিশাল মিছিলে। আসলে সেটা পরিচয় না বলে প্রথম সাক্ষাৎ বলাই শ্রেয় হবে। মিছিলে আসার উৎসাহ দেখে নাম ও কোন স্কুলের ছাত্র জানতে চাইলেন। বললাম। শুনে বললেন আমিতো ওই স্কুলেরই ছাত্র। ঠিক আছে বিকেলে ছাত্র ফেডারেশন অফিসে এসো, কথা হবে।

দিনকয়েক পরে এক সন্ধ্যায় গেলাম খেয়াঘাট রোডের ভাঙাচোরা টিনের ঘরে যেখানে ছাত্র ফেডারেশনের কার্যক্রম চলতো। বাদশা ভাই বললেন, সদস্য হতে। আমি বললাম ভেবে দেখি। এরপর তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান। ছাড়া পান ১৯৫০ সালে। মুক্তির পর থেকে তিনি প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি করতে শুরু করেন। আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি। দিনের পর দিন দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে কখনো বাসায়, কখনো ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে, কখনোবা রাজপথে। ইতিমধ্যেই আমরা কে সিনিয়র কে জুনিয়ার ভুলে সহযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। কারাগারের ভেতরেও তাই। যখনই পুলিশ গ্রেপ্তার করত, আটকাবস্থায় থানায় গিয়ে দেখতাম, বাদশা ভাই, প্রসাদ দা দিব্যি সেখানে বসে আছেন যেন আমারই অপেক্ষায়। এমনটাই চলতো ষাটের দশকের শেষ অবধি।

ন্যাপ গঠিত হল ১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে। বাদশা ভাই পার্টির নির্দেশে ১৯৫৮ সালে ন্যাপে যোগ দিলেন। পরে ন্যাপের বারংবার অপ্রত্যাশিত ভাঙনে আলতাফ হোসেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে গণতন্ত্রী পার্টি গঠন করেন।

বাদশা ভাইকে বিয়ের রাতেও পুলিশ তাকে রেহাই দেয় নি। বাসর ঘরে নববধূকে একলা রেখে তার বিয়ের রাত কাটল গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে। তারা তাকে ধরে নিয়ে যায়। কারণ পুলিশের ধারণা ছিল তিনি বিয়ে করছেন না। রাজনৈতিক কৌশলে বিয়ের নাটক সাজিয়ে গ্রেপ্তার এড়াচ্ছেন। অবশ্য তাদের এ ধারণা ছিল পুরোপুরি ভ্রমাত্মক।

বাদশা ভাই দুই শ্যালিকার বিয়ে দেন দুজন ন্যাপ নেতার সাথে। তার একজন সিরাজগঞ্জের সাইফুল ইসলাম, অন্যজন ঈশ্বরদীর আব্দুল হালিম চৌধুরী। তারা তিনজনই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তিনজনই পরে গণতন্ত্রী পার্টি গঠনে ভূমিকা পালন করেন। হালিম চৌধুরী আজও জীবিত, কিন্তু রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নন।

আমিনুল ইসলাম বাদশা সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন একেবারেই স্বেচ্ছায়। দেশে যখন প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেল, তিনি তখন শহরের বাসনপট্টিতে ছোট্ট একটা দোকান ভাড়া নিয়ে সমৃদ্ধ একটি বইয়ের দোকান খুললেন। দোকানে রাখতেন মার্কসীয় রাজনীতির বই, প্রগতিশীল লেখক লেখিকাদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এসব গ্রন্থ। মার্ক্সবাদে যেসব যুবকযুবতি আকৃষ্ট হতেন, তাদের জন্য প্রাথমিক রাজনীতি, অর্থনীতি শিক্ষার বই মজুদ রাখতেন। যাদের বই কিনে পড়ার সাধ্য ছিলনা তাদের দোকানে দাঁড়িয়ে বা বসে বই পড়ার সুযোগ দিতে কার্পণ্য করতেন না।

সাদাসিধে পোশাকের মানুষটিকে কখনো রিকশায় চড়তে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দূরে যেতে হলে বাসে যেতেন, শহরে সর্বত্র হেঁটেই চলাফেরা করতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, হেঁটে চলাফেরা মূলত দুটি কারণে- এক, ডায়াবেটিক রোগীর উপকার হয়। দুই, পরিচিতজনের সাথে আলাপের সুযোগ হয়।

আসলেই পরিচিত কাউকে পেলে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে যেতেন বাদশা ভাই। অবস্থা এমন হয়েছিল দূর থেকে তাঁকে দেখলে অনেকে অন্য রাস্তা দিয়ে গন্তব্যে যেতেন, তাঁকে এড়ানোর জন্য। কারণ সকলের হাতে তো অত সময় থাকতো না।

বাদশা ভাই ভাষা আন্দোলনসহ এ দেশের সকল স্বাধিকার আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ হয়ে, আমৃত্যু বয়ে বেরিয়েছেন পুলিশের বুলেট। তবে, তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি।
আমি দাবি জানাবো, বাদশা ভাইসহ পাবনার সকল ভাষা সংগ্রামীদের বাড়ির সামনের রাস্তা তাদের নামে করা হোক। জেলা পরিষদ, পৌরসভা খুব সহজেই কাজটি করতে পারে। সরকারের নিকট আবেদন, মুক্তিযোদ্ধার ন্যায় ভাষা সংগ্রামীদের তালিকাও অবিলম্বে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হোক।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পাশাপাশি বাঙালি পূণর্জাগরণ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হোক।

আমিনুল ইসলাম বাদশা ভাষা সংগ্রামে যে বিশাল অবদান রেখেছেন, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমরা পাবনাবাসী তা ভুলতে বসেছি। এই শুভ লগ্নে তাঁর বিদেহী আত্মাকে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাই।

  • রণেশ মৈত্র: সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ; একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত