রণেশ মৈত্র

২৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০৩

বাংলাদেশের বাম আন্দোলন বর্তমানের নিরিখে-১

২৮ অক্টোবর বসবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কংগ্রেস তথা জাতীয় সম্মেলন-যদিও তা জাতির মনে কোন রেখাপাত করতে সক্ষম হবে কি না তা অগ্রিম এখনই বলা যাবে না। তবে এই দলটিতে আমি দীর্ঘদিন ছিলাম।

পাকিস্তানোত্তর কালে যাঁরা দলটিকে নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন-আবার ষাটের দশকে রুশ-চীন দ্বন্দ্বে যখন এক মারাত্মক আদর্শিক বিভক্তি দেখা দিল-তখন চীন উগ্রপন্থার হাত থেকে দলটিকে যাঁরা সক্রিয় ভাবে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন-তাঁদের মধ্যে আমিও একজন হওয়ায় আজও এই ঐতিহ্যবাহী দলটির আমি একজন নগণ্য শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই দলটির বর্তমান নেতৃত্ব না পুঁছলেও দেশের বামপন্থী আন্দোলনের নবতর বিকাশের পথের জটিলতা সকল সংকীর্ণতা কাটিয়ে মার্কসীয় উদারতার পথে আসুক আসন্ন কংগ্রেস এমন চিন্তাকে এড়িয়ে চলার অবকাশ আরও অনেকের মত আমার নেই। তাই বিষয়টি নিয়ে বিলম্বে হলেও কলম ধরতে হলো।

নিজেও যখন আজ প্রায় ৬৮ বছর ধরে বামপন্থী রাজনীতিতে এই ৮৪ বছর বয়সেও সাধ্যানুযায়ী সক্রিয় রয়েছি-তখন বাম মহলের ত্রুটি বিচ্যুতির কথা নিজ হাতে লেখার কাজটি প্রকৃতই দুরূহ। কিন্তু ব্যাপকভাবে আত্ম-সমালোচনা পর্যালোচনা ব্যতিরেকে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কোন বিকল্প পথ নেই। মার্কসবাদও সেই শিক্ষা দেয়।

সমাজতন্ত্র কিন্তু শুধুমাত্র দল-বিশেষের সম্পদ নয়-সমাজতন্ত্র জনগণের সম্পদ। জনগণই তা অর্জন করবেন তার জন্যে প্রয়োজনীয় লড়াই-সংগ্রামও তারাই করবেন। পার্টি এবং আমরা যারা ঐ আদর্শের কর্মী তারা জনগণকে অনুপ্রাণিত ও সংগঠিত করি মাত্র। দলের বিশেষ কোন নামের প্রতি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বহু দেশে কোন মোহ দেখি নি। আমি নব্বই এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত অস্তিত্বশীল সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলির কথা বলছি। কোন কোন দেশে একাধিক দলেরও অস্তিত্ব ছিল -যেমন বুলগেরিয়া। কোথাও কোথাও ছিলো ওয়ার্কার্স ও পীজেস্টস পার্টি নামে, কমিউনিস্ট পার্টি নামে নয়।

বাংলাদেশেও একাধিক দল রয়েছে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। এগুলির মধ্যে কোনটি আসল কোনটি নকল তা আজও বিচারের সময় আসে নি। তাই সম লক্ষ্য নিয়ে যাঁরাই কাজ করছেন (এমন কি দলের বাইরেও যদি তেমন থেকে থাকেন) তাঁর মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া এবং কংগ্রেসের তাদের সাথেও পরামর্শ করা অবশ্যই কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত বিশেষত: যেখানে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিসারী প্রতিটি দলই অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং ব্যাপক জনগণের মধ্যে প্রভাব গড়ে তুলতে আজও কোন দলই সক্ষম হয় নি। এমনই একটি পরিস্থিতিতে আমরা কংগ্রেস সম্মেলন প্রভৃতি অনুষ্ঠিত করতে চলেছি।

এই সময়টার আরও নানা দিক আছে যা লক্ষণীয়। পাকিস্তানোত্তর যুগের পূর্ববাংলার মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা মার্কসবাদ লেনিনবাদের যথেষ্ট পরিমাণে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং পার্টির শক্তিবৃদ্ধিতে, নানা আন্দোলন সংগ্রামে এবং এমন কি ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাদের সামনে উপস্থিত ছিল মহান সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। সেই বিশ্বের চাক্ষুষ সাক্ষাতের সুযোগও অনেকের জীবনে ঘটেছিল। দেশী-বিদেশী শোষণের হাত থেকে মুক্তি, মানুষে মানুষে সম-অধিকার, নারীর অধিকার ও মর্যাদা, বেকারত্বহীন সমৃদ্ধ জীবন, যুদ্ধ-মুক্ত পৃথিবী, শ্রমজীবী মানুষের সর্বাধিক মর্যাদা, বিজ্ঞানকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া, অদৃষ্টবাদ নয়-কর্মবাদ, বিজ্ঞান-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, মানব-কল্যাণে নিয়োজিত সকলের প্রতি অপরিসীম মর্যাদা, শিশু-সাহিত্য সংস্কৃতির সর্বোচ্চ বিকাশ সাধন এগুলি তো কথার কথা ছিল না-চাক্ষুষ দেখা ব্যাপার ছিল অনেকের কাছেই। বই-পত্র পড়েও জেনেছেন অনেকে যদিও পাকিস্তান আমলে সমাজতন্ত্রে বইপুস্তক ক্রয়-বিক্রয় এবং ঘরে রাখাও ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

ঐ যুবসমাজ দেখেছে কীভাবে কমিউনিস্ট-বামপন্থীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সাথে হাত মেলাতেও দ্বিধা করেন নি বরং ক্ষেত্র বিশেষে তাদের সাথে শান্তি/অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেছেন। দেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বামপন্থী কমিউনিস্টদেরকেই নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। দরিদ্র সন্তানেরা কলেরা জাতীয় সেকালের ছোঁয়াচে রোগীদের চিকিৎসায় নির্দ্বিধায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করে জীবনের ঝুঁকি নিতে । বন্যার্তদের সহায়তায় দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মধ্যে সাধ্যমত খাবার তুলে দিয়ে প্রাণে বাঁচতে সাংস্কৃতিক টিম তৈরি করে গানের মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করে সাহায্য সংগ্রহ করতে। দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ-বিরোধী গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে।

দেখেছে কমিউনিস্ট-বাম পন্থীরা জাত-পাত মানতো না, হিন্দুর রান্না মুসলমান, মুসলমানের রান্না হিন্দুরা দিব্যি খেয়েছে বহু ক্ষেত্রেই সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে। এগুলি তুমুলভাবে অনুকূল প্রতিক্রিয়া রচনা করেছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এভাবে প্রগতিশীলতার বিকাশ ঘটেছে বামপন্থীদের শক্তি সংগঠন গোপনে গোপনে গড়ে উঠেছে। আজ কোথায় আছি আমরা? পারছি কি তেমন কোন উদাহরণ সৃষ্টি করতে? দেখাতে পারছি কি সমাজতান্ত্রিক দেশের অস্তিত্ব বা সফলতা? পারছি কি তরুণ-তরুণীদের মনে তেমন কোন স্বপ্ন দেখাতে? সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয়, নিপীড়িত জাতি সমূহের প্রতি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নৈতিক ও বৈষয়িক সহমর্মিতা ও সক্রিয় সহযোগিতা আজকের কিশোর-কিশোরীরা দেখার সুযোগ না পাওয়ার অসুবিধাও মস্ত এক সমস্যা।

অপরপক্ষে বিশ্বজুড়ে মুসলিম সন্ত্রাসবাদের যে হিড়িক এবং সেই সন্ত্রাসবাদের সাথে মূলত মুসলিম বিশ্বের বিশেষ করে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের যেভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং এখনও উঠছে বাম আন্দোলন ও সংগঠনের বিকাশের পথে তাও এক মস্ত প্রতিবন্ধক। এই সন্ত্রাসবাদের স্রষ্টা, উদ্যোক্তা, মদদদাতা-সবই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তারা এটা সৃষ্টি করেছে মূলত: মুসলিম বিশ্ব থেকে প্রগতিকামীদেরকে নিধন করার জন্য। আফগানিস্তান থেকে তৎকালীন সোভিয়েত সমর্থিত সরকার উৎখাতের জন্য তারা তালেবান বাহিনী গড়ে তুলেছিল। ইরাকের সাদ্দাম সরকার কোন বামপন্থী সরকার ছিল না, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে সাদ্দাম ইরাকের বিপুল তৈল সম্পদ জাতীয়করণ করে মার্কিন তথা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের তেল সম্পদ লুণ্ঠনের পথে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন তারই নির্মম পরিণতি স্বরূপ আমেরিকা নির্লজ্জভাবে ইরাক আক্রমণ করে একটি মিথ্যা অজুহাতে যে সাদ্দাম পারমানবিক অস্ত্রভাণ্ডার লুকিয়ে রেখেছে। জাতিসংঘের তদন্তে তা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর জাতিসংঘের বা বিশ্ব-জনমতের প্রতি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে তারা ইরাকে সাদ্দাম সরকারকে নির্মমভাবে উৎখাত করেছে শুধু তাই নয় সে দেশটির সকল সম্পদ ধ্বংস করেছে-বাগদাদ নগরীকে গুড়িয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি।

তেমনই তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা এবং এখনও জামায়াত বি.এন.পি‘র প্রতি তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন বাঙালি জাতি ভুলতে পারে না। একই কারণে বাংলাদেশ সরকার মুখে বারবার বললেও আজ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীকে বে-আইনি করছে না-বরং তারা বাংলাদেশের ঐ ঘোরতর অপশক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে কখনও বা সাংবিধানিক বৈধতা দিয়ে আবার কখনও বা-নিজেদের দলীয় সদস্য পদ দিয়ে। এগুলি হতে পারছে একদিকে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সর্বত্র তুলনামূলকভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের তীব্রতা হ্রাস পাওয়ার ফলে আবার আমেরিকাই যেন ইসলামী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী পরিচালিত লড়াই এর নেতৃত্ব দিচ্ছে এমন একটা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়ে।

দেশের প্রচার মাধ্যমগুলিও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রচারণার মাধ্যমে তাদের মুখোশ খুলে দিতে আগের মত আর উৎসাহী নয়। আবার ভারতের একজন বিশিষ্ট কলামিস্ট সম্প্রতি তাঁর এক লেখায় (বিডি নিউজ ২৪ এ প্রকাশিত) চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালে হিলারি ক্লিনটন ঢাকা এসে দীর্ঘ সময় বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আলোচনা করে বাংলাদেশের নির্বাচনে বি.এন.পি‘র প্রতি তাঁদের দৃঢ় সমর্থন থাকবে এমন কথা দিয়েছিলেন। ঐ একই সময়ে তিনি কোলকাতায় গিয়ে সদ্য বিজয়ী মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে অভিনন্দন জানিয়ে হিলারি বলেছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটাতে তাঁদের বিস্তর তেলখড় পোড়াতে হয়েছে ও বিলিয়ন্স অব ডলার খরচ করতে হয়েছে। মমতাও মার্কিন ও ভারতের বৃহৎ একচেটিয়া পূঁজির প্রভাব বলয়ে আত্মসমর্পিত।
[লেখার দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল]

রণেশ মৈত্র : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ। ইমেইল : [email protected]

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত