রেজাউল আবেদীন

২২ নভেম্বর, ২০১৬ ১৯:৫৪

ব্যবসায়ের সফলতার মূলমন্ত্র ও ঝুঁকি সমূহের আলোচনা

ব্যবসায়ের ইতিহাস বেশ পুরানো। পুরানো দিনের ব্যবসা যুগের পর যুগ অতিবাহিত হয়ে আজকের আধুনিক বিশ্বে পদার্পণ করেছে। ব্যবসায়ে রয়েছে সফলতা এবং ব্যর্থতা ও ঝুঁকি সবই। একজন নতুন উদ্যোক্তাকে ব্যবসা শুরুর পূর্বেই তা জানা দরকার। ব্যবসায়ে রয়েছে ভিন্নতা, ব্যবসায়ের রকম ও ধরন নানাবিধ। কাজেই এক বাক্যে এর সফলতার মূলমন্ত্র ও ঝুঁকি সমূহের আলোচনা করা বেশ দুরহ বটে। ব্যাপক কার্যকারী গবেষণা ও বিশ্লেষণের পরে নিম্মে তা আলোচনা করা হল :

ব্যবসায়ের সফলতার মূলমন্ত্রঃ  
১। ব্যবসায়ের ভিশন, মিশন, লক্ষ্য ঠিক করা ও সেই মোতাবেক ব্যবসা পরিচালনা করা।

২। অধ্যাবসায়, কঠোর পরিশ্রম ও একাগ্রতা ব্যবসায়ে খুবই কার্যকারী ভূমিকা রাখে। ব্যবসা নিজে হোক, অংশীদারি ভিত্তিতে হোক পর্যাপ্ত সময় দেয়া চাই।

৩। সঠিক সময়ে সঠিক প্রদক্ষেপ নিতে হবে। কি করলে আপনার ব্যবসায় বাড়বে, লক্ষ্যমাত্রার মুনাফা অর্জিত হবে তা খেয়াল করে ব্যবসায়ের সিদ্ধান্তগুলা একে একে নিতে হবে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগলে আপনি অন্যজনের সাথে পরামর্শক্রমে আপনার প্রতিটি প্রদক্ষেপ নিন। অন্যের সাথে আলোচনা করলে আপনার সিদ্ধান্তে যদি কোণ ভুল থাকে তা সংশোধন করতে পারবেন।কন্সালটেন্ট বা পরামর্শদাতা আপনাকে এ ব্যাপারে সহায়তা প্রদান করতে পারেন।  

৪। ব্যবসায় শুরুর প্রাক্বালে একটি “ব্যবসায় পরিকল্পনা  Business Plan” করে নিন। বিজনেস কনসাল্টেন্ট বা ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টেন্টরা এসব ব্যাপারে পেশাদারী সেবা দিয়ে থাকেন। তাই তাদের স্মরণাপন্ন হোন। কিছু অর্থ খরচের ভয়ে পিছপা হবেন না।

৫। ব্যবসায়ে কৌশলগত দিকে (Strategic Focus) সূ-দৃষ্টি প্রয়োগ করতে হবে। বিগত বছরের ভুলত্রুটি চলতি বছরে প্রয়োজনে সংশোধন করতে হবে।  

৬। আপনার নিজের ভিতর যত ধরনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রয়োজনে তাঁর ষোলআনা ব্যবসায়ে প্রয়োগ করুন।

৭। দীর্ঘদিন সঠিকভাবে সেবা যত্ন করার ফলে একটি চারাগাছ যেমন আশাতীত ফুল ও ফল দেয় ঠিক তেমনি একটি ব্যবসাকে দীর্ঘদিন সেবা যত্ন করে বা পরিচর্যা করে বড় করতে হয়। রাতারাতি কোণ ব্যবসায়কে শুধুমাত্র একটি ফর্মুলা দিয়ে বড় করলে তার ফল অধিকাংশেই ভাল হয় না। প্রয়োজনে একাধিক পরিকল্পনা প্রয়োগ করতে হবে।   

৮। ব্যবসায়ে ভাল কর্মী নিয়োগ দেয়া চাই, আমি বলছি সঠিক পদে যোগ্য কর্মীর কথা “Right Man for the Right Position”। দক্ষতাসম্পন্ন সৎ ও সময় নিষ্ঠাবান কর্মী বা কর্মকর্তা একটি প্রতিস্টানের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন করতে সহায়তা করে। কর্মকর্তাদের সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। কর্মীদের তদারকি করলে ও ভাল ফল দেয়। সুপারভাইজার, ম্যানেজার গ্রুপ কর্ম বা Team Work or Team Building এর মাধ্যমে কাজ আদায় (ওয়ার্ক রিকভারী)  করে নিতে পারে কোম্পানীর চাহিদা মত। আধুনিক ব্যবসায়ে প্রকৃত পেশাজীবীর কোন বিকল্প নাই।

৯। কর্মীদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তাদের দক্ষতাঁর উন্নয়ন করা যায় এবং এর ফলে তারা কর্মক্ষেত্রে চাহিদামত কাজের যোগান দেয়।

১০। যোগাযোগ দক্ষতার উন্নয়ন নিশ্চিত করা চাই। কর্মীদের একে অপরের সাথে বা ক্রেতার সাথে মালিকের যোগাযোগের সহজ পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিতে হবে, বস মনোভাব নিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখলে চলবে না।

১১। ভাল সেবা বা পণ্যের যোগান নিশ্চিত করতে হলে পর্যাপ্ত কলকব্জা ও যন্ত্রপাতির সরবরাহ করা চাই।

১২। পণ্য বা সেবার মানের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্পন্ন পণ্য বা সেবার দিকে ভোক্তা বা ব্যবহারকারীর ঝোঁক বেশী।

১৩। পুরানো বা বর্তমান ক্রেতা বা ব্যবহারকারী (Customer Retention) ধরে রাখতে হবে। ক্রেতা ধরে রাখার যত কৌশল রয়েছে তা প্রয়োগ করতে হবে। যেমনঃ ক্রয়প্রতি পয়েন্ট বা বোনাস পয়েন্ট, মোড়ক ফেরত দিয়ে নতুন ক্রয়ে ছাড়, রেফারেল পদ্ধতি প্রয়োগ করলে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা যেমন লাভবান হবে ঠিক তেমনি বিক্রেতা বা কোম্পানী ও লাভবান হবে।

১৪। ক্রয়ের পরে সেবা “After Sales Service” প্রদান সংক্রান্ত যদি কোন অফার থাকে তাহলে সমস্যা দেখা দিলে তা সঠিকভাবে প্রদান করতে হবে। সেবার মান সব সময় উন্নত রাখতে হবে নতুবা প্রতিযোগী ব্যবসায়ী এই গ্যাপে ব্যবসার স্থান দখল করে নিতে পারে। যেমনঃ দেরী না করে ক্রয়কৃত পণ্য নস্ট হলে তা বদল করে দেয়া বা সময়ের মধ্যে মেরামত সেবা ফ্রিতে প্রদান করা।

১৫। প্রয়োজনে প্রতিযোগী ব্যবসায়ীদের পণ্যের মুল্য, সেবার মান, বিজ্ঞাপন কৌশল, বিক্রয়ের ও বাজারজাতকরনের এলাকা জেনে নিতে হবে এবং অত্যাধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগে ধাপে ধাপে মার্কেট লিডার বা ফলোয়ার অবস্থানে থেকে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে।  

১৬। দেশের ভিতরে চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি পণ্য উৎপাদন করলে বিদেশে রপ্তানি ও করা যায়। যেমনঃ প্রাণ আর এফ গ্রুপ এর পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

১৭। বিজ্ঞাপন খাতে প্রয়োজনমত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। আমরা জানি যে, প্রচারেই প্রসার। বিজ্ঞাপন দেয়া যেতে পারে অনলাইন ( সোশ্যাল মিডিয়ায়), ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, প্রিন্ট মিডিয়ায়, অফ লাইন সবদিকইছুতেই।    আর বিজ্ঞাপণ দিয়ে ক্ষান্ত থাকলেই চলবে না আপনাকে মার্কেটিং প্ল্যান (Marketing Plan) করে, সেই অনুযায়ী ধাপে ধাপে বাজারজাতকরনের প্রসার ঘটাতে হবে।

১৮। ই-কমার্স বা অনলাইনে ব্যবসায় প্রসার এখন উল্ল্যেখযোগ্য ভুমিকা রাখছে। একটি ওয়েব সাইট, পর্যাপ্ত হোস্টিং স্পেস নিয়ে বানালে আপনার ব্যবসার প্রসার হবে অতি দ্রুত, ওয়েব সাইটের মাধ্যমে ও পণ্য বিক্রয় করা যায়। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, গুগল ডট কম http://www.google.com বা বিং ডট কম http://www.bing.com এ সার্চ করে এখন ক্রেতারা পণ্য বাঁচাই করে কোনটি কিনবে বা কোনটি কিনবে না। স্মার্ট ফোনে ব্যবহার উপযোগী মোবাইল অ্যাপস ও কায্যকারী ভূমিকা রাখছে ব্যবসায়ের প্রসারে। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, আপনার ওয়েব সাইটটির সার্চ ইঞ্জিন ওপটিমাইজেশন (SEO) করালে অনেক ভিজিটর আপনার সাইটে আসবে ফলে আপনার বিক্রয় ও প্রসার দুটোই বেড়ে যাবে।

১৯। “BEP or Break Even Point বা সমচ্ছেদ বিন্দু”  এর মাণে হচ্ছে যে বিন্দুতে কোন লাভ বা ক্ষতি হয় না। একজন ব্যক্তি নতুন ব্যবসা শুরু করার পর প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, বিক্রয় কোন পর্যায়ে বা লেভেলে গেলে আমার কোম্পানী মুনাফা করবে? Break Even Point এ পৌঁছলে ব্যবসায়ের মালিক পক্ষ বুঝে যায় বা একটা ধারণা পায় যে তাঁর ব্যবসায়ের অগ্রগতি কোন দিকে যাচ্ছে? Break Even Point ফর্মুলা দিয়ে এর মান বের করা যায়। হিসাববিদ পরামর্শকগণ Cost-Volume-Profit (CVP) Analysis, বা Expense-Volume-Profit (EVP) analysis করে BEP এর ব্যাপারে ধারণা দেন।

ব্যবসায়ের ঝুঁকি সমূহঃ
জীবনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমনি ঝুঁকি না নিলে কোন অসাধ্য সাধন হয় না ঠিক তেমনি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ও ঝুঁকি গ্রহন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়ে বিচক্ষনতার সাথে ঝুঁকি নিতে হয়। ঠিকঠাক মত ঝুঁকি মোকাবেলা করে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলে সফলতা হাতের নাগালের মধ্যে আসতে বাধ্য।

ঝুঁকি নেয়া বলতে মূলত বুঝায় গভীরভাবে পরখ করে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে নিজের পুঁজি একটি ভাল ও লাভজনক প্রকল্পে বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করা। আপনার সকল পুঁজি শুধু মাত্র একটি প্রকল্পে বা ব্যবসায় খাটানোর কথা কিন্তু বলছি না। আপনার পুঁজি যদি কম হয় তাহলে কম ঝুঁকি যে ব্যবসায়ে রয়েছে সেখানে বিনিয়োগ করুন। আর যদি আপনার পুঁজির পরিমাণ অধিক হয় তাহলে কম কম করে একাধিক ব্যবসায়ে আপনার পুঁজি বা মূলধন বিনিয়োগ করতে পারেন।

ঝুঁকির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা যায়, যে লগ্নিতে মূলধনের বিপরীতে লাভ বা আসল ফেরত না আসার সম্ভাবনা রয়েছে তাতেই ঝুঁকি বিদ্যমান। ব্যবসায়ে নানাবিধ ঝুঁকি রয়েছে তন্মধ্যে প্রধানত দুইটি বড় ঝুঁকি হল- ক) আভ্যন্তরিন ঝুঁকি (Internal Risks), খ)বহিরাগত ঝুঁকি (External Risks)। আসলে অনিশ্চয়তা হতে ব্যবসায়ের ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। সেই সমস্ত ঝুঁকি কি কি তা বের করে তার মোকাবেলা করে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে।

নিম্মে সম্ভাব্য কি কি ঝুঁকি থাকতে পারে তাঁর আলোচনা করা হলঃ  
ব্যবসায় ঝুঁকিকে মোট ৮ টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথাঃ ১) কৌশলগত ঝুঁকি, ক) ব্যবসায়ের পরিবেশ খ) লেনা দেনা গ) লগ্নিকারীদের মধ্যে সম্পর্ক ।
২) আর্থিক ঝুঁকি, ৩) কর্মক্ষম (অপারেশনাল) ও প্রসাশনিক ঝুঁকি, ৪) কমপ্লাইন্স বা আইনগত ঝুঁকি, ৫) সুনামগত ঝুঁকি, ৬) কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি,  ৭) টেকনোলজি, প্রোপার্টি ও সরঞ্জাম ঝুঁকি, ৮) অন্যান্য ঝুঁকি, যেমনঃ প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি।

মোটকথা, যারা ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চান তাদের জন্য উপদেশ হচ্ছে, স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগ করুন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না করে। তাছাড়া ও, ব্যবসায়ের মালিক বা পরিচালকদেরকে খুব দ্রুত ঝুঁকি সমূহ বের করে তা মোকাবেলার মত ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই “ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা” নিয়ে রাখতে হবে। যদি কোন ঝুঁকির উদয় হয় তবে তা নির্ধারণ করে যেন খুব দক্ষতাঁর সাথে পেশাজীবি মনোভাবে সময়মত তা মিটানো সম্ভবপর হয় তবেই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ষোলকলা পূর্ণ হবে।

লেখক : সিইও এন্ড কন্সালটেন্ট, থটওয়ার্স কন্সালটিং এন্ড মাল্টি সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল এবং সহকারী পরিচালক( অর্থ), নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত