০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ২১:৫৪
নিরাপদ ময়াল আদর্শ সমাজ গঠনের উত্তম স্থান। যেখানে জান-মালের নিরাপত্তা নেই সেখানে সমাজব্যবস্থা সুন্দর থাকে না। সুখের বসতিও গড়ে উঠে না। সে হিসেবে ভাটি ময়ালে সমাজব্যবস্থা এখন আর আগের মত বিচার-বৈঠক কিংবা দলীয় অনুশাসনে নেই। যদিওবা এখন হাওর বসতিতে সেই আদি জলদস্যুদের তাণ্ডব নেই। বাণিজ্য-ডিঙা কিংবা দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বিত্তবানের সোনা-কড়ি লুটে নেওয়ার দস্যিপনা নেই। তবে একটি কথা না লিখলেই নয় তৎকালে দস্যুবৃত্তির আড়ালে তারা অন্য কোন প্রকার ক্ষতি সাধন করত না। কেবল সম্পদ সংগ্রহই ছিল তাদের মূল লক্ষ। হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণ করার মত ঘৃণ্য মনোবৃত্তি তাদের ছিল না। শুধুই গোষ্ঠী নিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই তারা ধনলুট করত। যাদের জীবনাচারে ছিল সামাজিক দায়। লুণ্ঠিত ধন আনাহারিদের বিলিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল তাদের।
তখন জলদস্যুগণ ছিল অধিকার ও রাজনৈতিক মূল্যবোধে সচেতন। কিন্তু বর্তমানে হাওরাঞ্চলে এই অবস্থা নেই। ব্যক্তি বিদ্বেষ ও স্বার্থ মিটাতে চোর-ডাকাত-সন্ত্রাসীদের উৎপাত মাতাল ঢেউয়ের মত আঘাত হানছে হাওরের গ্রামে গ্রামে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে বর্ষাকালে গ্রামবাসী ডাকাত আতঙ্কে দিন কাটায়। গাঁয়ের বিত্তশালীরা তখন জান-মাল নিয়ে নিরাপদ গঞ্জে চলে যায়। তখন অসহায় দরিদ্রগোষ্ঠীই কেবল নিরুপায় হয়ে জীবন বাজী রেখে গ্রামে বসবাস করে। ফলে ক্রমেই ভেঙে পরছে হাওরের গ্রামীণ আদর্শ সমাজব্যবস্থা। প্রশ্ন জাগে আধুনিক যোগে ধন-সম্পদ নিরাপদ রাখার অনেক উপায় থাকা সত্বেও কেন গ্রাম ছাড়তে হবে? তার মূল কারণ- অপহরণ ভয়! ধর্ষণ! মৃত্যু ভয়!
ডাকাতরা শুধু সম্পদ নয়, ব্যক্তিকেও আঘাত করে নানা কারণে। এমন নজির হাওরে অনেক আছে। অনেক বিত্তশালীকে অপহরণের ঘটনা শোনা যায়। যারা অধিক অর্থ দিয়ে মুক্তি পেয়ে আজ সপরিবারে নগরজীবনে প্রাণে বেঁচে আছেন। এ ক্ষেত্রে চাকুরীজীবী বা শিক্ষকের সংখ্যাই অধিক। তাই নিরাপত্তার অভাবে বর্ষাকালে হাওরের গ্রামগুলিতে স্বজনের আনাগোনাও কমে গেছে। নাইওর কিংবা বিয়ে-সাদির আয়োজন এখন বিত্তবানরা নগরে বসেই করে থাকেন দায়সারা নিয়মে। যার ফলে শুধু কৃষিব্যবস্থাই নয় গ্রামীণ লোক ঐতিহ্যের ধারাও ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে। যা বাঙালি জীবনের মূল স্তম্ভ। নিরাপত্তার অভাবে হাওরের কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্যতা এখন কর্পোরেটদের গ্যাঁড়াকলে ইটখোলার ধূয়ায় মিশে যাচ্ছে অপরিকল্পিত ভাবে।
চাকুরীজীবী সমাজও এখন জন্মমাটি ভুলে আদি পেশা কৃষি ছেড়ে নিরাপদ শহরের খুঁজে। ফলে কৃষি উৎপাদন আনুপাতিক হারে শুধু কমছেই না দিনে দিনে পতিত জমিও বাড়ছে। বাড়ছে স্বল্পমেয়াদের হাওরের পরিবেশ অ-পরিপন্থি প্রকল্প ও কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশ। তাই হাওরবাসী এখন শহরে বস্তিবাসী হয়ে জীবন কাটাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। কিন্তু কেন? তার অনেকগুলি কারণের মধ্য নিরাপত্তা মূল কারণ কেননা জমির মালিকদের বেশির ভাগেই নগর কেন্দ্রিক। আর যার মূল কারণ নিরাপত্তা। এ ব্যাপারে না বললেই নয় যে হাওরে চাকুরীজীবীদের মধ্যে বিশেষ করে শিক্ষক সমাজেই অধিক সংখ্যক বলে মনে হয়। তাই তাদের চিত্র তুলে ধরলে দেখা যায় যে, শিক্ষকদের বেশির ভাগ নিকটবর্তী নগরেই বসবাস করেন। যার মূল কারণ নিরাপত্তাহীনতা। শিক্ষকদের নগরে বসবাসের ফলে সময়মত স্কুলে যাওয়া আশাও সম্ভব হয় না। কেননা প্রকৃতি নির্ভর হাওরে তেমন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও গড়ে উঠেনি। তাই দৌড়ঝাঁপ করে স্কুলে পৌঁছে পাঠদানেও বিঘ্ন ঘটে। হাওরে 'বর্ষায় নাউ আর হেমন্তে পাউ' নিয়ে নগর থেকে গ্রামীণ কর্মস্থলে যোগদান শুধু সময় সাপেক্ষই নয় ব্যয় ও শ্রম সাপেক্ষও বটে। যা হাওরের শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়ে পড়ারও একটি অন্যতম কারণ বলা যায়।
এখানে একটি প্রশ্ন আসে, হাওরের গ্রামীণ সমাজ কেন তাদের নিরাপত্তা বলয় নিজেরাই তৈরি করে তুলতে পারছে না? হ্যাঁ, সংগ্রামী হাওরবাসীর কাছে এমনটি আমরা আশা করতেই পারি। শুধু তাই নয়, যেখানে হাওরবাসী নিজ উদ্যোগেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করে আসছে সেখানে নিরাপদ সমাজ তৈরিও কেন সম্ভব নয়? এ প্রসঙ্গে বলা যায়, নিজ উদ্যোগে নিরাপত্তা নিয়েও হাওরবাসী প্রশংসার দাবীদার। কেননা বিশেষ করে বর্ষাকালে তারা গ্রামভিত্তিক দলীয় পাহারাদার হিসেবে গ্রামে গ্রামে নিজেরাই কাজ করে। শুধু তাই নয় গ্রামের চারপাশ বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়ে নিরাপদ বেষ্টনি তৈরি করে। রাতে গ্রামে প্রবেশদ্বার বন্ধ রাখে। তবুও কাজের কাজ হয় না। কারণ বর্ষায় যখন অঝরে বৃষ্টি নামে তখন সামান্য টর্চলাইটের আলোতে অন্ধকার রাতে ডাকাত তদারকি করা সম্ভব হয় না। ফলে ডাকাতদল বেষ্টনি কেটে প্রবেশ করতে পারে অনায়াসে। তারপর ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে যখন একের পর এক বন্দুকের গুলি ছুড়তে থাকে তখন ঘুমে থাকা বউ-পোলাপান নিয়ে পানিতে ঝাপ দিয়ে নাক জাগিয়ে আত্মরক্ষা ছাড়া কীইবা করার থাকে।
হাওরবাসীর ঢাল-তলোয়ার, থুড়ি-বল্লম ও মাটি-পাথরের ব্যবহার তখন বন্দুকের কাছে অসহায় হয়ে যায়। আর যে সকল গ্রামে বন্দুক আছে সে সকল গ্রাম কিছুটা নিরাপদ। কিন্তু দুঃখের বিষয় বন্দুকওয়ালারা এখন শহরবাসী। এদিকে থানাপুলিশ বা নৌপুলিশ যা রয়েছে তাদের সাহায্য পাওয়ার পূর্বেই নিরাপদে ডাকাতি সম্পন্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে থানাপুলিশের সাথে হাওরবাসীর আইন-আদালত ফরমায়েশের ভোগান্তি ছাড়া আর তেমন কিছুই করার থাকে না। বর্ষাকালে পানিবন্দি অসহায় হাওরবাসী তখন থানায় গিয়ে জবানবন্দি দিতে দিতে ডাকাত খুঁজার সাধ মিটে যায়। এখন বর্ষাকালে ডাকাতি কিছুটা কমলেও অপহরণ আতঙ্কে অনেকেই গ্রামছাড়া।
এতো কেবল বর্ষাকালীন কাহিনী। হেমন্তেও আতঙ্ক কম কিসের। মোটরসাইকেলে করে অপহরণের কথাও শুনেছি অনেক। গৃহস্থের গরুচুরি এ সময় নিত্যদিন হয়। কৃষিকাজে ব্যবহৃত মেশিনসহ নানা উপকরণ হেমন্তকালে জমিতে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা নেই। হাওরবাসী যেখানে ঘরের দোয়ার খুলে ঘুমিয়ে পরত সেখানে দরোজায় তালা দিয়েও নিরাপদ হওয়া যায় না। গোয়াল ঘরে এখন গরুর পাহারাদার হিসেবে মানুষ থাকতে হয়। কৃষিকাজে ব্যবহৃত কোনরকম উপকরণ ঘরের বাহিরে রাখার সুযোগ নেই। পূর্বে যেখানে মাড়াই করে রাখা শতশত মন ধান হাওরে মাড়াই খলায় নিরাপদ ছিল সেখানে বাড়ির উঠোনেও এখন তা নিরাপদ নয়। তাই হাওরবাসীর নিরাপত্তার প্রশ্নে কিংবা সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়ন ও কৃষির স্বার্থে
হাওর পুলিশ একটি যৌক্তিক দাবি বলে মনে করি।
আপনার মন্তব্য