মোহাম্মদ মনির উদ্দিন

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:২২

চিকিৎসায় দুর্বৃত্তায়ন, নির্বিকার রাষ্ট্র

রোগীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে সবারই যেতে হয়। পরিবারের সদস্য, ক্ষেত্রবিশেষ অন্যদেরকে নিয়েও। চিকিৎসা যে বাংলাদেশে পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে অনেক আগেই বিষয়টা সবাই অবগত আছেন। ডাক্তারগণ ইচ্ছেমত, তাঁদের মর্জিমাফিক ফি নেন। এক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির আদৌ কোনো বালাই নেই। অনিয়ম কমবেশি সবারই একদম গা-সয়া হয়ে গেছে। ছোটখাটো বিষয় বাদ দিয়ে যে, ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য তা-হচ্ছে যে কোনো রোগীকেই তাঁরা বিভিন্ন ধরনের রকমারি টেস্ট, পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র রোগ নির্ণয়ের জন্যে দিলে তো তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার বা থাকার কথা নয়। কথা হচ্ছে কমিশনের ধান্ধায় বা লোভে যখন অযথা টেস্ট করানো হয় তখনই। খুব কম ডাক্তারই আছেন যারা খামোখা টেস্ট দেন না। এ সংখ্যা অতি নগণ্য। বাদবাকি সবাই কমিশন কামাইয়ে সিদ্ধহস্ত। এ যেন অনৈতিককে হকে পরিগণিত করে ফেলেছেন!

ভাবতে অবাক লাগে; আশ্চর্য না হয়ে কোনো উপায় নেই। কমিশন ক্ষেত্রবিশেষ ১৫ থেকে ৪০ ভাগ তাঁরা পেয়ে থাকেন। একারণে অসুস্থ কমিশন প্রতিযোগিতা চলছে। অবৈধ, বে-হালালকে তাঁরা একেবারে হালালে পরিণত করেছেন। এ পেশা মহৎ ও সেবামূলক পেশা বলতে বড়ই দ্বিধা লাগে। অনেকেই বলতে একেবারেই নারাজ।

দুই.
চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক হচ্ছে প্রিভিলেজ কমিউনিকেশন। অর্থাৎ রোগীর কী রোগ হয়েছে; রোগী না চাইলে কাউকে বলা যাবে না। এটাই চিকিৎসাবিদ্যার নীতি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারে দেখা যায়, একজন রোগী ডাক্তার দেখছেন আরও এক বা অধিক রোগী চেম্বারে অপেক্ষমাণ। ফলে রোগী খোলামেলাভাবে অন্যজনের অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতিতে সবকিছু বলতে পারছেন না। রোগী ও ডাক্তারের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে অনেক বিষয় অতি সহজে সমাধান হয়ে যেতো, কিন্তু তা আজকাল একেবারেই হচ্ছে না। রোগী-ডাক্তারের গোপনীয়তা রক্ষা হচ্ছে না। মেডিকেল এথিকস একে কোনোক্রমেই সমর্থন করে না। এ ধরণের অপেশাদার আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তিন.
কমিশন বাণিজ্য মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলে সুচিকিৎসা আশা তাঁদের কাছ থেকে দামা গরু অর্থাৎ বলদের নিকট দুধ চাওয়ার শামিল। এরপরও যেতে হবে তাঁদের কাছেই। একজোট হয়ে মনোপলি ব্যবসা তাঁরা করছে। এঁদের নিয়ন্ত্রণ করার যেন কেউ নেই; বরং উল্টো নিয়ন্ত্রণ তাঁরা করেই চলছেন। ডাক্তারগণ সরকারি চাকরিতে নিয়োগ নিয়ে বড়ো শহরে থেকে এই বাণিজ্য করতেই ব্যতিব্যস্ত। মফস্বলে যেতে কোনোভাবেই রাজি বা সম্মত নন। যতো ধরনের চেষ্টা- তদবির আছে তা-করে শহরেই থেকে যান। দাপটের সাথেই থাকেন।

চার.
সরকারি মেডিকেল কলেজে যারা পড়াশোনা করে ডাক্তার হচ্ছেন, তাঁদেরকে রাষ্ট্র সাবসিডি দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় বিরাট অবদান ও আনুকূল্য পেয়ে তারা ডাক্তার হয়েছেন। রাষ্ট্রকে একজন ভিক্ষুকও তাঁর বাড়ির খাজনা পরিশোধ করেন। ফলে সরকারি আনুকূল্য বা ভর্তুকি পেয়ে যারা ডাক্তার হন তাঁদের উপর ভিক্ষুকেরও হক আছে, অবদান রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে তাঁরা সেটা ডাক্তার হওয়ার পর বেমালুম ভুলে যান কিংবা এড়িয়ে চলেন। যাদের শ্রম ও ঘামে ডাক্তার হন, পরে তাঁদের কাছ থেকেই প্রতারণা করে কমিশন ও অর্থ হাতিয়ে নেন। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে নির্বিকার! যেন করার কিছু নেই। তুঘলকি কাণ্ড আর কি!

পাঁচ.
ডাক্তার পদবি নামের অগ্রভাগে সংযুক্ত করতে হলে এমবিবিএস বা বিডিএস পরীক্ষা পাশ করে নিবন্ধিত হওয়ার পরই কেবল পারা যাবে; অন্যথায় নয়। বাস্তবে পরিলক্ষিত হয় গোটাদেশে ডাক্তার পদবি লোকদের আনাচেকানাচে ছড়াছড়ি। ঔষধের দোকান খুলেই ডাক্তার হয়ে যান অনেকেই। আবার অনেকেই ভুয়া ডাক্তার হিসেবে চেম্বার খুলে দস্তুর মতো প্রতারণা ও মানুষের জীবননাশ করে চলছেন। রাজধানী শহরেই এমন প্রতারক চেম্বার খুলে সাধারণ মানুষকে ঠকাচ্ছেন। সারা দেশে তো আর কথা নেই। এতো গেলো প্রতারক, টাউট ও ভুয়া চিকিৎসকদের কাহিনী।

ছয়.
প্রকৃত পাশ ডাক্তারও অতিলোভে অহেতুক ঔষধ দিয়ে কমিশন বাণিজ্যের অসৎ উদ্দেশ্যে অনৈতিকভাবে মানুষজনকে ঠকিয়ে যাচ্ছেন; নির্বিকার সবাই!যেন সব সম্ভবের এইদেশ! বোধ হয় কোথাও কেউ নেই! এমন দেশে বাস করা অলৌকিক মনে হয়।

সাত.
কোনো একসময় হয়ত ঔষধের দোকান ছিল অথবা ঔষধ ব্যবসার কোনো অনুমতি ছিল বা কোয়াক ছিলেন তাঁরাও ডাক্তার পদবি ব্যবহার করেন। এমনকি এই ডাক্তার পদবি ব্যবহার করে উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ার উদাহরণও নেহায়েত কম নয়। অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণামূলক পন্থা অবলম্বন করে এই পদবি ব্যবহার করেন।

আট.
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন-২০১০ এর বিধান অনুযায়ী ২৯(১) ধারামতে এমবিবিএস বা বিডিএস পাশ ও নিবন্ধন ছাড়া ডাক্তার পদবি ব্যবহার করা বেআইনি। উল্লিখিত ধারা লঙ্ঘন করলে ২৯(২)ধারা অনুযায়ী ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে। বিদ্যমান এই আইনের প্রয়োগ করা না গেলে এধরণের প্রতারণা, অনৈতিকতা, বেআইনি কর্মকাণ্ড চিকিৎসাক্ষেত্রে অবিরতভাবে চলতে থাকবে।

নয়.
সাধারণ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে চিকিৎসা সেবা পাওয়া অধিকারতুল্য। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে ব্যর্থই বলা চলে। বাধ্য হয়ে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা সহায়-সম্পত্তি বিক্রয় করে মানুষকে নিতে হয়। বেসরকারি ব্যবস্থায় সেবা নিতে গিয়ে হতে হয় প্রতিনিয়ত প্রতারিত। এখানে নেই কোনো মনিটরিং বা রাষ্ট্রীয় তদারকি। ফলে মানুষ, বিশেষ করে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে প্রতারিত, নি:স্ব ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে জীবন নাশও হচ্ছে! রাষ্ট্রের কাছেই প্রতিকার চাওয়ার একমাত্র জায়গা। কিন্তু রাষ্ট্র একেবারে নির্বিকার ও উদাসিন। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা রাষ্ট্রীয়ভাবে খুবই জরুরি।

  • [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত