ভাবতে পারি না, রাশেদীন ফয়সালের আইডি থেকে কোন স্ট্যাটাস আসবে না। বনে-বাদারে ঘুরে বেড়ানোর ছবি আসবে না।

২৬ জুলাই, ২০১৫ ০২:০২

রাশেদীন ফয়সাল : মিতা ভাই, ও মিতা ভাই!

খলিলুর রহমান ফয়সাল

অনলাইনের সেই প্রিয় মুখটি চিরদিনের জন্য লগ আউট করলো শনিবার। রুমে অনেকদিন এক জায়গায় থাকা কোন আসবাব হঠাৎ সরিয়ে নিলে জায়গাটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমারও তেমন লাগছে।

সেদিন ছিল ৬ জুলাই, ২০১৩। আমার ফেইসবুকের নিচে টুং করে একটা লালবাতি জ্বলে উঠলো- রাশেদীন ফয়সাল।
- ভাই কেমন আছেন?
- ভাল আছি।
- সিলেটভিউ নামে একটা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ হয়েছে, জানেন?

সেদিন খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। আজাইরা সব অমুক টুয়েন্টিফোর, তমুক টুয়েন্টিফোর ডট কম দিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো ওয়েবপেইজ ও পত্রিকা বের হচ্ছে; আর ভাল লাগে না।
তার অনেকদিন পর আবার লাল বাতি জ্বলে উঠে খুব রাতে। টুডাং…
- এই যে ফয়সাল ভাই, আপনি আমার মিতা।
- আরে তাইতো!! আপনার নাম আর ফয়সাল, আমার নাম কিন্তু কে আর ফয়সাল। হা হা হা!

আমরা খুব হাসি। তারপর শুরু হয় জীবনের গল্প। চাকুরী পাওয়ার পর পিংকু নামে আমাদের এক কর্মকর্তার সাথে খুব খাতির হয়। তিনি সিলেটের লোকাল। বহুদিন বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলায় কাজ করছেন। আমাকে একদিন সিলেটভিউ’র অনেকগুলো ম্যাগাজিন পড়ার জন্যে এনে দেন। তখনই রাশেদীন ফয়সালের কথা মনে পড়ে।

রাশেদীন পিংকুর খুব ভাল বন্ধু। তারা অনেক ঘুরাঘুরি করে। বলতে পারেন বনে-বাদারে ঘুরে বেড়ানো রাশেদীন ও তাঁর দলের নেশা। সেদিন রাতে অনেক চ্যাট হয় রাশেদীনের সাথে। নেক্সট টাইম তাদের টুরিস্ট ক্লাবে জয়েন করার ব্যাপারেও কথা হয়।

ছাত্রাবস্থায় সিকৃবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ছিলাম। তখন থেকেই সিলেটের প্রায় সব সাংবাদিকের সাথে পরিচয় ছিল। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের নোবেল ভাই তেমন। চাকুরী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগে। সুতরাং সব সাংবাদিকের সাথে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ও সিলেটভিউ পরিবারের সদস্য রাশেদীন ফয়সাল। আমার ক্যাম্পাসের খবর থাকলে, খুব গুরুত্ব সহকারে ছাপিয়ে দিতো তারা। এভাবেই রাশেদীন দিন দিন কাছের মানুষ হয়ে উঠে।

ওয়ার্ল্ড কাপ টি-টুয়েন্টির সময় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা একটি ‘ফ্ল্যাশ মোব’ বানিয়েছিলাম। আইসিসি থেকে বলা হয়েছিল ইউটিউবে যে বেশি লাইক/ভিউ পাবে সে ফার্স্ট হবে। এতো কষ্ট করে আমাদের ছেলেমেয়েরা কাজটি করলো তার একটি প্রতিদান পাওয়া উচিত বলে আমি মনে করেছিলাম। আমরা কোন সেলিব্রেটি নই আবার লাইক পাওয়ার চুরিবিদ্যাও জানি না। সুতরাং তখন খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। অনেকের মতো সেদিন এগিয়ে এসেছিল রাশেদীন।

”ফয়সাল ভাই, আপনি ভয় পাবেন না। আমার আম্মার নাম কনকচাঁপা। ঐ যে গান গায়। তিনি তার ফেইসবুক একাউন্ট থেকে আপনাদের ফ্ল্যাশ মোবের শেয়ার দিবেন।”

কনকচাঁপা সহ বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের দ্বারে দ্বারে রাশেদীন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন দুপুরে জিন্দাবাজারের কাশফুলে বসিয়ে আমাকে বলে- ”নাম বাদেও আপনার আমার খুব মিল। বলেন তো কি কি মিল?” আমি সস মাখিয়ে সবজি রোল খাই আর নিজেদের মধ্যে মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।

একদিন ফেইসবুকে রাশেদীনকে অনুরোধ করি, “মিতা ভাই, লোভাছড়া নিয়ে চলেন। লোভ ধরিয়েছে লোভাছড়া।” যাবো যাবো করে আজো নিয়ে যায়নি রাশেদীন!

গত বসন্তের আগে এক শীতের রাতে আবার নক করি। ”ও মিতা ভাই, স্পন্সর যোগাড় করে দিন না। বসন্তবরণ অনুষ্ঠান করবো।” রাশেদীন বলে, ”কাল যদি আমার সাথে রিকশায় ঘুরেন, তাহলে কিছু ঠিকানা দিতে পারি।” হিম হাওয়ায় মায়াবী শহরে রিকশায় ঘুরে ঘুরে আমি বসন্তবরণের পরিকল্পনার কথা বলি। আরো কত কথা হয়।

কিশোর বয়সে আলোচনা হতো ক্লাস নিয়ে, পরীক্ষা নিয়ে। এ বয়সে আলোচনা হয় প্রেম নিয়ে, বিয়ে নিয়ে, ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে। আমি খুব চিন্তিত, রাশেদীন একেবারে ভাবলেশহীন।

সংস্কৃতি কলেজে পিঠা মেলায় গেলাম ভাইবোনদের নিয়ে। দূর থেকে ডাক দিলো সে- ”ও মিতা ভাই। ও মিতা ভাই।” চাদর খোলে ভেতরে গরম বুকে জড়িয়ে নিলে আমাকে, “ কতদিন পর দেখা! আপনি তো দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছেন।” ভিড়ের মধ্যেই শার্ট উচিয়ে দেখায় আমাকে- ”এই দেখেন আমার ভুড়িও উঁকি দিচ্ছে।” কত সহজ সরল, কত প্রাণবন্ত রাশেদীন ফয়সাল। দেখা হলেই কথায় কথায় জড়িয়ে ধরতো।

বন্ধু তন্বীকে নিয়ে সেদিন রিকাবীবাজারের কবি নজরুল মিলনায়তনে গিয়েছিলাম নাটক দেখতে। নাটক শুরুর আগে দুই বন্ধু ফুটপাথে দাঁড়িয়ে চা খাই। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাশেদীন। কানে ফোন কিন্তু আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।
-মিতা ভাই, ভাবীর কি খবর?
-ভাল। কানে কে?
-কানে পেত্নি। হা হা হা!
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি আমরা। যাওয়ার সময় আবারও জড়িয়ে ধরে। তন্বী বলে- ”পাগলটা কে?” আমি বলি- ”আমার স্পেশাল বন্ধু।” এটাই বোধহয় ছিল তাঁর শেষ জড়িয়ে ধরা।

গেল রমজানে অনেক রাতেই টুং টাং চলতো। তারপর ইদের ছুটিতে আমি বাড়িতে। বাড়িতে গিয়েও গভীর রাতে রসালো আলাপ চলে চ্যাট বক্সে।

হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো খবরটা। সকালে রাশেদীন ফয়সাল এক্সিডেন্ট করেছে, এখনো জ্ঞান নেই। পিংকু ভাইকে ফোন দিলাম। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে- ”ভাই জানি না বাঁচবে কি না। মস্তিষ্ক আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”

আমি আর শুনতে পারি না। যে মানুষটার সাথে কাল রাতেও ফেইসবুকে জেগে ছিলাম সে আজ চলে যাচ্ছে আমাদের ছেড়ে। সিলেট গণমাধ্যমের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। প্রকৃতির কাছে আমরা রাশেদীনকে ফেরত চাই। প্রকৃতি বলে- ”তবে যুদ্ধ হোক।” ১৩ দিন যুদ্ধ করে শনিবার (২৫ জুলাই) রাশেদীন ফয়সাল আমাদের ছেড়ে চলে গেল।

ভাবতে পারি না, রাশেদীন ফয়সালের আইডি থেকে কোন স্ট্যাটাস আসবে না। বনে-বাদারে ঘুরে বেড়ানোর ছবি আসবে না। প্রোফাইল পিকচার চেইঞ্জ হবে না। হঠাৎ করে টুং শব্দে ইনবক্সে আর মেসেজ আসবে না- মিতা ভাই, ও মিতা ভাই!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত