মিখা পিরেগু

১৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০৯:০৯

জাবি ভিসির 'গণঅভ্যুত্থান' বনাম হল ভ্যাকেন্ট

গত ৫ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনাকে অত্যন্ত সচেতনভাবে ভিসি ফারজানা ইসলাম 'গণঅভ্যুত্থান' হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান জাতির ইতিহাসে এক নতুন যুগ-সন্ধিক্ষণের সূচনা করেছিল। দীর্ঘদিন যাবত পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামরত বাংলার ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। যার মাধ্যমে সূচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থানের। যার চেতনা মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম প্রেরণা যুগিয়েছে।

একটি সন্ত্রাসী হামলাকে সচেতনভাবে গণঅভ্যুত্থানের সাথে তুলনা করে জাবি ভিসি ফারজানা ইসলাম ১৯৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের মৌল চেতনায় আঘাত করেছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার দিনটি জাবি ভিসি ফারজানা ইসলামের জন্য কোনো বিচিত্র কারণে আনন্দের দিন হতেই পারে; এটা যদি ধরেও নিই তবুও একজন অধ্যাপক হিসেবে জাবি ভিসি ফারজানা ইসলাম সচেতনভাবে হামলার ঘটনাকে 'গণঅভ্যুত্থান' উল্লেখ করে মহান গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছেন। সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে থেকে জাবি ভিসি গণঅভ্যুত্থানের মতো মহান ইতিহাসকে জাতির সামনে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না।

তথাকথিত গণঅভ্যুত্থানের পর এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় হল ভ্যাকেন্টের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট আদতে একটি অপূর্ণাঙ্গ, মেয়াদোত্তীর্ণ ও অকার্যকর নির্বাহী পর্ষদ। জাবির ভিসি বলেছেন সিন্ডিকেটে যা সিদ্ধান্ত হবে তা আইন হিসেবে মান্য করতে হবে। সিন্ডিকেট পরিচালনা বিধিতে প্রতি মাসে সাধারণ সিন্ডিকেট নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এখানে জরুরি ও বিশেষ সিন্ডিকেট ছাড়া আর কিছু হয় না। ৭৩'এ-র অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিন্ডিকেটের সদস্য হবেন ১৯ জন। বর্তমানে ৫টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া বাকি ১৪টির মাঝে ৪টি পদে রয়েছেন মেয়াদোত্তীর্ণ সদস্য। মাননীয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্যদ্বয় ও কোষাধ্যক্ষ পদাধিকার বলে সিন্ডিকেট সদস্য হন।

অধ্যাদেশের ২২ (১)(এফ) ধারা অনুযায়ী সিনেট সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত দুই জন সিন্ডিকেটের সদস্য হবেন। বর্তমানে এ দুটি পদেও রয়েছেন মেয়াদোত্তীর্ণ সদস্য। এ পদে মনোনীত হয়েছিলেন সিনেটের রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত সদস্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির ও মো. মোতাহার হোসেন মোল্লা। ২১ (১) (এফ) ধারা অনুযায়ী একাডেমিক কাউন্সিল থেকে নির্বাচিত দুজন কলেজের অধ্যক্ষ হলেন সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ শেখ জুলহাস উদ্দীন, অপরজন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ নেহাল আহমেদ।

অধ্যাদেশের ২২ (১)(ই) ধারা অনুযায়ী- ডিন, প্রভোস্ট, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক পদে নির্বাচিত এক জন করে সিন্ডিকেটের সদস্য হবেন। কিন্তু এখানে অধ্যাপক ক্যাটাগরি ছাড়া সব পদ শূন্য আছে। মেয়াদোত্তীর্ণভাবে অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে আছেন ভিসিপন্থী অধ্যাপক লায়েক সাজ্জাদ এন্দেলাহ। সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক ক্যাটাগরির সদস্যদের পদোন্নতির কারণে পদ শূন্য হয়। এছাড়াও প্রাধ্যক্ষ ক্যাটাগরির সদস্যের দায়িত্বপালনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এই পদ শূন্য আছে। আর ডিন ক্যাটাগরিতেও নির্বাচিত সদস্য প্রেষণে উপ-উপাচার্যর দায়িত্বে যাওয়ায় এই পদ শূন্য আছে।

অধ্যাদেশের ২২(১) (জি) ধারা অনুযায়ী মহামান্য আচার্য কর্তৃক মনোনীত সদস্য হিসেবে রয়েছেন ভিসিপন্থী হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার ও অধ্যাপক হানিফ আলী। ২২ (১)(আই) ধারায় সিনেটরের ভোটে বিশেষ নাগরিক প্রতিনিধি ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ইব্রাহিম হোসেন খান সিন্ডিকেটে আছেন। এই পদেরও মেয়াদ শেষ হয়েছে। এছাড়াও ২২ (১) (এইচ) ধারায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগের সচিব ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব সিন্ডিকেটে রয়েছেন।

অধ্যাদেশের ২৩ (৩) ধারা অনুযায়ী এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ নূন্যতম ৭ জনে সিন্ডিকেট কোরাম পূর্ণ হয়। অধ্যাদেশের ২২ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে দেখা যায় ১৯ জন সদস্যের ভেতরে ১০ জন সদস্য প্রত্যক্ষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত; এর মাঝে উপাচার্য, উপাচার্যদ্বয়, কোষাধ্যক্ষ ছাড়াও ৬ জন শিক্ষক প্রতিনিধির। বর্তমানে অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে মেয়াদোত্তীর্ণ সদস্য ছাড়া বাকি ৫টি শিক্ষকদের পদই খালি আছে। যে জরুরি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হল ভ্যাকেন্টের ঘোষণা দেয়া হয় সেই সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত ছিলেন ৭ জন। সেখানে আবার ২ জন সদস্য হল ভ্যাকেন্টের বিরোধিতা করেছিলেন।

অধ্যাদেশের ৪০ ধারা অনুযায়ী সকল শিক্ষার্থী হলেই থাকবে যদি না সিন্ডিকেট কোনো বিশেষ কারণে কেবল বিশেষ অবস্থায় অন্যত্র চলে যেতে বলে। কিন্তু গত ৫ নভেম্বর সিন্ডিকেট সভার পর জনসংযোগ দপ্তর থেকে প্রেরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হল ভ্যাকেন্টের কোনো কারণ উল্লেখ ছিলো না। হল ভ্যাকেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেটের নূন্যতম কোরামেও শতভাগ ভোটে পাশ হয় নি। এই সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি নেই। নেই কোনো হল প্রভোস্টদের প্রতিনিধি কিংবা কোনো অনুষদের ডিন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদাধিকার বলে সিন্ডিকেটের সদস্যবৃন্দ ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেট সভা বারবার নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো সিন্ডিকেটে না থাকায় সকলের স্বার্থের বিপক্ষে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ভ্যাকেন্টের সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়েছে। যার ফলে ৫ নভেম্বরের সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক মতামতের প্রতিফলন ঘটে নি।

জাবি ভিসি ফারজানা ইসলাম নিজের নির্বাহী ক্ষমতায় নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী পর্ষদ হিসেবে পরিচিত সিন্ডিকেট অকার্যকর করে রেখেছেন। শূন্য কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ পদ পূরণে যথাযথ ব্যবস্থা নেন নি। শুধুমাত্র নিজের অনুগত সদস্য সংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হারানোর ভয়ে। কাজেই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধভাবে হল ভ্যাকেন্টের মতো সকলের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে ৫ নভেম্বরের সিন্ডিকেট ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। বিশেষ কারণ না দেখিয়ে অবৈধভাবে হল ভ্যাকেন্ট করে অধ্যাদেশের ৪০ ধারার লঙ্ঘন করেছেন।

৬ নভেম্বর জনসংযোগ দপ্তরের আরেক বিজ্ঞপ্তিতে জাবি কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ, মিছিল কিংবা অফিস ও আবাসিক এলাকায় অবস্থানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারে ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদে যথাক্রমে চলাফেরা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। জাবি ভিসি ফারজানা ইসলাম জনসংযোগ দপ্তর থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পুলিশি তল্লাশির ভয় দেখিয়ে নাগরিক হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার হরণ করার প্রয়াস দেখিয়েছেন। বিভিন্ন অফিস নিজের অনুগত রাখতে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে ২৩ জনকে নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন আর বিভিন্ন সময় নিজের স্বার্থে ব্যাবহার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, স্ট্যাটিটিউট, ও সিন্ডিকেট বিধিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন।

সকল শিক্ষার্থীর স্বার্থের বিপক্ষে গিয়ে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধভাবে হল ভ্যাকেন্টের সিদ্ধান্ত সর্বজনের টাকায় পরিচালিত একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণতান্ত্রিক পরিবেশকে নির্দেশ করে। জাবি ভিসি ফারজানা ইসলাম নিজের নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পরিবেশ বিনষ্ট করেছেন। শুধুমাত্র নিজেকে বহাল রাখার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় পুরো আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধভাবে হল ভ্যাকেন্ট করে পুলিশ দিয়ে হল থেকে শিক্ষার্থীদের বের করার হুমকি দিয়ে নিজেকে ব্যর্থ প্রমাণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরকে দিয়ে আন্দোলনে হামলার পর উল্টো অজ্ঞাতনামা হিসেবে শিক্ষার্থীদের নামে হত্যা চেষ্টার মামলা করে দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছেন। আর ক্ষমতার অপব্যবহার করাও এক ধরনের দুর্নীতি। সকল দুর্নীতির সাথে আর্থিক ব্যাপার জড়িত নাও থাকতে পারে।

  • মিখা পিরেগু : কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন; সংগঠক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর।
  • প্রকাশিত লেখায় মত, মন্তব্য, বিশ্লেষণ লেখকের নিজস্ব, এখানে সিলেটটুডের সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নাও প্রকাশ পেতে পারে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত