মুক্তাদীর অাহমদ মুক্তা

০৭ এপ্রিল, ২০২০ ০১:৪৫

করোনায় প্রয়োজন সহৃদয়তা

নভেল করোনাভাইরাস যেন এক নতুন অাত্মঘাতি ওলাওঠা। বাঙালির অাতংক অার নিষ্ঠুরতার সেই ওলাওঠা এখন অাগ্রাসী রূপ ধারণ করছে। সংক্রামক এই ব্যাধিতে অাক্রান্ত হলেই যে মৃত্যু অবধারিত এমন নয়। তবুও এর সংক্রমণ ক্ষমতা এতো প্রবল যে ভয়াল ওলাওঠা বা কলেরাসহ অন্যান্য ছোঁয়াছে রোগের চেয়ে এটি বেশি  প্রাণঘাতি।

করোনাভাইরাস যেমন বিশ্বের হাজার হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। তেমনি লাখ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়েছেন। অামার ঘনিষ্ঠ দুই রাজনৈতিক সহকর্মী লন্ডনে করোনা অাক্রান্ত হয়ে নিজ বাসায়ই চিকিৎসা নিয়ে অনেকটা সুস্থ। অারেক অগ্রজ নিউইয়র্কে চিকিৎসা নিয়ে এখন শংকামুক্ত। ঢাকায় অামাদের পরিচিত একজন করোনাভাইরাসে অাক্রান্ত হয়ে শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সুস্থ হয়েছেন। সিলেটের যে চিকিৎসক করোনা অাক্রান্ত হয়েছেন তিনি সেলফ কোয়ারেন্টাইন মেনে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছেন। বাংলাদেশে শুরুর দিককার অাক্রান্ত অনেকেই পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি  ফিরেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনা অাক্রান্তের সংখ্যা মারাত্বকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশ কয়েকজনকে  মৃত্যুর কাছে অাত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা উপসর্গে কয়েকজন মারা গেছেন। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য কমিউনিটি পর্যায়ে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সকল মানদণ্ড অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। এখন কেবল পরীক্ষা,নিরীক্ষা, সচেতনতা, সঙ্গনিরোধ,শারীরিক বিচ্ছিন্নতা ও ঘরে থেকে প্রার্থনা করা ছাড়া এই মহামারি নিয়ন্ত্রণের অার সকল সূযোগ হাতছাড়া।

দূর্যোগে, সংকটে বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ই একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। এবারও মানবিক সাহায্য নিয়ে মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন কিন্তু এবার যেন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। সামাজিকভাবে করোনা পেয়েছে ‘খারাপ’ রোগের তকমা।যিনি এ রোগে  অাক্রান্ত হচ্ছেন তিনি যেন পাপী, অপরাধী! বাঙালি মানসিকতার 'অচ্ছুত ' সংস্কৃতি যেন করোনায় ফিরছে। অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। কোথাও কোথাও রোগী নিজেই অাতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বাঙালি চরিত্র অনুযায়ী সামাজিকভাবে কানাঘুষা, গালমন্দ,  হেয়প্রতিপন্নের সংস্কৃতি অারো জোড়ালো হচ্ছে।যেকোনা অসুখেই মারা গেলে সবাই ধারণা করছে করোনায় মারা গেছে। অতি উৎসাহী হয়ে কেউ কেউ ফোনে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। তারা এসে করোনার নিয়মের কথা বলে  দাফন করছেন। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতাকে পাকাপোক্ত করছেন। অাত্মীয় স্বজন কেউ পাশে থাকছেন না। মৃতদেহ পুলিশ পাহারায়, কর্তব্যরতদের জানাজার মাধ্যমে দাফন করা হচ্ছে।নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত সীমায় যেন আমরা বাস করছি। করোনা রোগী সন্দেহে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া, লাশ দাফনে বাধা দেওয়া,হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় বাধা দেওয়া এগুলো তো অামাদের চারপাশেরই ঘটনা। মৃত্যুর আগে যিনি করোনা রোগী হিসেবে শনাক্তই হননি তাকে করোনা রোগীর মতো দাফন করে  সামাজিকভাবে ক্ষতের সৃষ্টি করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত বিষয়ে প্রচার ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর রোগীর পরিচয় গোপনকে উৎসাহিত করছে। এতে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। অনেকের মধ্যে  করোনা লক্ষন থাকার পরও নিজেকে পরীক্ষা নিরীক্ষার অাওতায় না নিতে পারেন। যাতে সমালোচনা বা অপদস্ত হতে না হয়। অারেকটি বিষয় করোনায় মারা যাওয়া রোগীর দাফন বা সৎকার বিষয়েও আইইডিসিআরের একটা নির্দেশনা রয়েছে। করোনায় মৃত্যুবরণকারীর দাফন-শেষকৃত্যও বেশ জটিল বিষয়। সংক্রমণের ভয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন-জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশ নিচ্ছেন না স্বজনরাও। মানুষের একটি সাধারণ ধারণা হচ্ছে- মৃত ব্যক্তির শরীর থেকেও করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এই ধারণার কোনো প্রমাণ আজও মেলেনি। কারণ মহামারীতে মারা যাওয়ার পর মানুষের শরীরে ওই এজেন্টের বেশিরভাগই দীর্ঘ সময় জীবিত থাকে না। তবে লাশের সঙ্গে সংস্পর্শ অব্যাহত রাখলে (কনস্ট্যান্টলি ইন কনকাক্ট উইথ করপসেস) যক্ষ্মা বা রক্তবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।লাশ থেকে এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত কিছু ঝুঁকি থাকে। যেমন কেউ যদি কলেরা বা রক্তপ্রদাহজনিত জ্বরে (হেমোরেজিক ফিভার) মারা যান, তা হলে এটি ঘটতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার সবশেষ রিপোর্টে বলেছে, মারা যাওয়ার পর মানুষের শরীরে জীবাণুর বেশিরভাগই দীর্ঘ সময় জীবিত থাকে না।

থাইল্যান্ডের মেডিকেল সার্ভিসের মহাপরিচালক স্যামসাক আকাসিলিফ বিষয়টি আরও খোলাসা করে ব্যাংকক পোস্টকে বলেছেন, কোনো ব্যক্তি ভাইরাসে মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবাণুও মরে যায়। তাই অন্য ব্যক্তির শরীরে সংক্রমণের সুযোগ কম।

মৃত ব্যক্তির দেহে ভাইরাসের দীর্ঘ সময় জীবিত থাকার সুযোগ নেই। এই ভাইরাস সর্বোচ্চ ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে।

অাসলে শুরু থেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে একটা হযবরল অবস্থা। তথ্যগত বিভ্রান্তি, দায়িত্বশীলদের খামখেয়ালিপূর্ণ অাচরণের পাশাপাশি অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা মানুষকে হতাশ করেছে। সরকারের সর্বশেষ পদক্ষেপগুলোতে মানুষ অাশান্বিত হয়েছে। সারা দেশে রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন এইসব সংবেদনশীল বিষয়ের বিজ্ঞানভিত্তিক সুরাহা প্রয়োজন। অাক্রান্ত হলে যে মানুষ অপরাধী নয় এটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল অাচরণ না করলে রোগী এমনিতেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমবে।প্রাণঘাতী ভাইরাস সহজেই কাবু করবে।

করোনাভাইরাস  নিয়ে যাবতীয় অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা দূর করে চিকিৎসকদের নিরাপত্তাসামগ্রী নিশ্চিত করা জরুরি। সামাজিক অপবাদ নয় সহৃদয়তার পরিচয় দেওয়া এখন সকলের কর্তব্য।অাক্রান্ত রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আমাদের নিজেদের মন মানসিকতার দৈনতা দূর করে সরকারের নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে রক্ষা করতে হবে,পরিবারকে রক্ষা করতে হবে। অাসুন দেশমাতৃকার কল্যাণে বৈশ্বিক এই দূর্যোগকে বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করি।কোভিড -১৯ প্রতিরোধে ঘরে থাকি,জনসমাগম এড়িয়ে মানবিক দায়িত্ব পালন করি।

    মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত