প্রণবকান্তি দেব

১২ এপ্রিল, ২০২০ ২১:০২

করোনার কান্না, ❛গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথে❜

করোনার কান্না এখন 'গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথে'। শহরের গলিতে আছড়ে পড়া মূর্ছনা এখন গায়ের অবুঝ পথে। এ কান্না কোথায় গিয়ে থামবে? কোন বাড়িটা হবে শেষ বাড়ি? কোন মৃত্যু হবে শেষ মৃত্যু?

করোনা জীবন থামিয়ে দিতে পারে কিন্তু সময়ের কাটা নয়। এই তো বৈশাখ এসে গেছে। আরেকটি নতুন বছর। হালখাতা কই, পালা-পার্বণ কই, চৈত্র সংক্রান্তি বিষাদে ভরা, চড়কের শিব ঠাকুর চুপচাপ, বিবর্ণ বৈশাখের রঙ। মানুষের মন ভালো নেই। মানুষের মনে বড়ো দুঃখ। মানুষের চোখে ফিকে হওয়া আশার ধূসর দৃষ্টি। গাউ গেরামে সন্ধ্যার হৈ হুল্লোড় থেমে গেছে। মসজিদের বারান্দায় বৈঠক আলসে বৈঠক নেই,আরতির আসরে একলা পড়ে আছে নিথর মৃদঙ্গ। এ বড়ো অচেনা দৃশ্যপট! এই খোশগল্পহীন, কিচ্ছা পয়ার,মেলা, এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরাঘুরি, খুনসুটি বিহীন গ্রাম বড়ো বেমানান লাগে!

বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ। আবেগী হয়ে কখনো কখনো বলি গ্রাম বাঁচলে বাঁচবে গোটা দেশটা। আমাদের গ্রামগুলো এখনো মায়ায় ভরা, সবুজে জড়ানো। সরল রোদে হেসে খেলে এখানে এখনো বড়ো হয় বিশ্বাসের ঘাস। হাতের মুঠো ভরে ভালোবাসা নিয়ে গ্রামের মানুষগুলো গড়ে দেয় আমাদের কংক্রিটের শহর। এই করোনা তাণ্ডব এখন সেই গ্রামের দিকে ছুটছে। বুকের ভেতরে তাই জেগে উঠছে একফালি দুশ্চিন্তা। শহরে এতো এতো সচেতনতা, প্রযুক্তিগত সুবিধা, তথ্য প্রবাহ, ত্রাণ সুবিধা... তারপরও মানুষ ভালো নেই। অথচ এ দেশের বহু গ্রামে এখনো স্যাটেলাইট পৌঁছেনি, অভাব আর ইন্টারনেট, প্রযুক্তি আর কুসংস্কার মুখোমুখি হয় প্রতিদিন। করোনার মহামারিতে গ্রামের মানুষগুলো এখনো বুঝে উঠতে পারছে না, তাদের করনীয় কী! ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-পুতি নিয়ে এক পাতে খাওয়া বয়োবৃদ্ধরা " সামাজিক দূরত্ব " কে কতোটুকুইবা গুরুত্ব দেবেন!

গ্রামে গ্রামে এখন কেবলই হা হুতাশ। ঘরবন্দি মানুষ, কাজ নেই। হাতের শেষ কানাকড়িও ফুরিয়ে গেছে এতদিনে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো কিছু আনতেও পারছে না, কিছু খেতেও পাচ্ছে না। বাজার নেই, ক্রেতা নেই, লেনদেনও নেই। খাঁ খাঁ সবখানে।

এ দুঃসময়ে সরকার নানাভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। তবু গ্রামের এই মানুষগুলোর কাছে যতটুকু সাহায্য পৌছার কথা, ততটুকু হচ্ছেনা। শহরে বিভিন্ন রকমের বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগেও সাহায্য, সহযোগিতা চলমান রয়েছে। কিন্তু গ্রামে তো সরকারি সাহায্যই একমাত্র সম্বল। তাও যদি গরীবের হাতে না পৌছায় - এ হাহাকার তবে গুছবে কীভাবে? তদুপরি, নানা অনিয়ম, চুরিচামারির খবর প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রচারমাধ্যমে। বিপন্ন মানুষের অথৈ কান্না নিয়েও একশ্রেণির অমানবিক মানুষ প্রতারিত করছে আরেক শ্রেণিকে। করোনার ভয়াবহতা, বিশ্বজুড়ে এতো মৃত্যু - মা,বাবার লাশ ছেলে মেয়েদের ছুঁয়ে দেখতে না পারার মতোন মর্মান্তিক, হৃদয়ভাঙা মৃত্যুর পরও বর্বর মানুষগুলোর কোনো শিক্ষা না হওয়া আমাদের বোধের গভীরে এক আশ্চর্য প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যায়। তবু্ও যাদের বিবেক জেগে আছে এখনো, তাদের বলি-একটু গ্রামের পানে তাকান, ঐসব চিন্তার বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠা গরীব, অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ান, যতটুকু সাধ্য আছে ততটুকু নিয়েই। বিত্তবানদের বলি, প্রতিবেশীকে উপোষ রেখে খাবেন না। যারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন নানাভাবে,তাদের বলি ইবাদত পালন করার এটাই উপযুক্ত সময়।

গ্রামকে হাসতে দিন, সারা বাংলা হেসে উঠবে একদিন।

  • প্রণবকান্তি দেব: শিক্ষক, লেখক ও সংগঠক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত